মুজিব হত্যার পরে জিয়া, ফারুক, রশীদ আবারও মার্কিন অস্ত্র চান - দৈনিকশিক্ষা

মুজিব হত্যার পরে জিয়া, ফারুক, রশীদ আবারও মার্কিন অস্ত্র চান

মিজানুর রহমান খান |

সংবিধান, আইন ও সংসদ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ সাংবাদিক প্রয়াত মিজানুর রহমান খান বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড নিয়ে অনেক দুর্লভ নথি প্রকাশ করেছিলেন। তার লেখা উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলোর অন্যতম হলো- ‘মার্কিন দলিলে মুজিব হত্যাকাণ্ড’ ও  ‘১৯৭১: আমেরিকার গোপন দলিল’। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড নিয়ে  পত্রপত্রিকাতেও অনেক অনুসন্ধানী প্রতিবেদন আছে তার। এই লেখা তেমনই একটি কালোত্তীর্ণ প্রতিবেদন। এতে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর খুনিদের নানা তৎপরতার গোপন নথি প্রকাশ করা হয়েছে। সময়ের উপযোগিতা বিবেচনায় অনুসন্ধানী পাঠকদের জন্য লেখাটি পুন:প্রকাশ করা হলো।

পঁচাত্তরে শেখ মুজিব হত্যাকাণ্ডের পরে ও অক্টোবরের আগে খন্দকার মোশতাক আহমদ নিযুক্ত সেনা প্রধান হিসেবে জিয়াউর রহমান এবং ফারুক-রশীদ যুক্তরাষ্ট্র সরকারের কাছে কথিত ভারতীয় হুমকি মোকাবিলায় মার্কিন অস্ত্র- সহায়তা চেয়েছিলেন। জিয়া অক্টোবরের আগে ঠিক কখন মার্কিন অসহায়তা লাভের আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করেছিলেন, তা জানা সম্ভব হয়নি। তবে ভারতীয় হস্তক্ষেপ যে আসন্ন ছিল, তার সপক্ষে মার্কিন সরকারের শরণাপন্ন হতে মোশতাক- জিয়া-ফারুক-রশীদ এবং ভুট্টো সরকারের অব্যাহত সর্বাত্মক তৎপরতা পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট, নভেম্বর হয়ে ডিসেম্বর পর্যন্ত চোখে পড়ে। কিন্তু চরম পরিহাস হলো, মার্কিন রাষ্ট্রদূত ডেভিস ইউজিন বোস্টার বা অন্য কোনো পর্যায় থেকেই এমন কোনো নির্দিষ্ট আশ্বাস দেওয়া হয়নি যে, ভারত হস্তক্ষেপ করে বসলে যুক্তরাষ্ট্র তা ঠেকিয়ে দেবে।

বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের তরফে লাগাতারভাবে ভারতীয় হস্তক্ষেপের আশঙ্কা করা হয়। সেসব আশঙ্কার মাত্রা, যৌক্তিকতা ও কার্যকরণ ভিন্ন প্রশ্ন। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র সরকারের অবমুক্ত করা গোপন দলিলগুলো থেকে স্পষ্ট দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্র কখনোই এ বিষয়ে বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষকে এমনকি একটা মৌখিক আশ্বাসও দেয়নি। পঁচাত্তরের ৭ নভেম্বর ‘সিপাহি-জনতার বিপ্লবের’ দিনে সম্ভব্য ভারতীয় হামলা নিয়ে মার্কিন দূতাবাসকে ব্যতিব্যস্ত রাখে বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ। জিয়া ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্রসচিবকে সকালে পাঠান মার্কিন দূতাবাসে। দুপুরে মাহবুব আলম চাষী সরাসরি ফোন করেন বোস্টারকে। অনুনয় একটিই, ভারত ঠেকান। কিন্তু ভারত-জুজু ছাড়ানো যে বাস্তব ছিল না, কৌশলগত ছিল, তা স্পষ্ট করেন বোস্টার স্বয়ং। ৭ নভেম্বর তিনি এক তারবার্তায় (নম্বর ৫৩৯১) মার্কিন পররাষ্ট্র দক্প্তরকে চাষীর উদ্ধৃতিতে ‘তাঁরা বাইরের হস্তক্ষেপ ঠেকাতে অক্ষম। কিছু হলে বন্ধুরা ঠেকাবে—এই ভরসাটুকু তাঁদের চাই’ উল্লেখ করে মন্তব্য করেন, ‘চাষীর কথাবার্তা অস্পষ্ট। আসলে তাঁদের মনের কথা হলো, ভারত যাতে বর্তমান পরিস্থিতিতে কোনো হস্তক্ষেপ না করে সে বিষয়ে আমরা যেন দিল্লিকে নিষ্ক্রিয় রাখি।’ সামরিক আশ্বাস দেওয়ার যুক্তি নাকচ করে দিয়ে বোষ্টার তাঁর সরকারকে বলেন, ‘যদিও এ বিষয়ে নির্দিষ্ট আশ্বাস পেলে তা তাঁর (চাষীর) অবশ্যই পছন্দ হবে, কিন্তু আমি মনে করি না যে, এ বিষয়ে আমি যেমনটা সাধারণভাবে তাঁকে বলেছি, তার চেয়ে বেশি কিছু করার দরকার আছে।’

এর দুই বা তিন সপ্তাহের ব্যবধানে ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশনার সমর সেন তাঁর গাড়িতে আক্রান্ত হন।

এ ঘটনা নিয়ে ঢাকা-দিল্লি সম্পর্কের অবনতি ও উত্তেজনা ঘটার প্রেক্ষাপটে দেখা যায়, জিয়াউর রহমান আবার মার্কিন সরকারের কাছে ধরনা দেন। ২৬ নভেম্বর ১৯৭৫ তৎকালীন চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স আরভিং গোতলিয়ের চেসল লিখেছেন, ‘পররাষ্ট্রসচিব তোবারক হোসেন আজ রাত আটটায় আমাকে সামরিক কর্তৃপক্ষের শীর্ষ ব্যক্তি জেনারেল জিয়ার সঙ্গে বৈঠকের জন্য ফোন করেন। আমি তখন বাসায় ছিলাম। আমি রাষ্ট্রপতির বাসভবনে গেলাম। গোড়াতেই পররাষ্ট্রসচিব তোবারক বলেন, মি. সেনের জখম এমন গুরুতর ছিল না। কিন্তু ভারত থেকে আসা ভারতীয় হেলিকপ্টার তাঁকে দেশে নিয়ে গেলে আজকের নাটকীয় পরিস্থিতি আরও নাজুক মোড় নিত। যা হোক মি. সেন না যেতে সম্মত হয়েছেন, হেলিকপ্টার ফিরে গেছে। কিন্তু ভারতীয় তৎপরতায় তাঁরা এখনো বিচলিত। এ পর্যায়ে আমার সঙ্গে কথা হয় জিয়া ও কমোডর খানের সঙ্গে। জিয়া বলেন, ….  বাংলাদেশ সীমান্তে ভারতীয় সেনা-তৎপরতা, প্রশিক্ষণ ঘাঁটি স্থাপন ইত্যাদির প্রমাণ তাদের হাতে আছে। …. ১০ দিন ধরে ভারতীয় পক্ষ থেকে গুজব ছড়ানো হচ্ছে, নভেম্বরের ২৭-২৮ বা ৭ ডিসেম্বরে বাংলাদেশে কিছু একটা ঘটানো হবে। সে কারণে তাঁর ধারণা, ভারতীয় হাইকমিশন চত্বরে আজকের হামলার ঘটনা কাকতালীয় নয়। তিনি অভিযোগ করেন, আজ জাসদের দুজনকে আটক করা হয়েছে। এই সংগঠনটি ভারতীয় হাইকমিশনের কাছ থেকে সরাসরি বিপুল অর্থ পেয়ে থাকে। সাম্প্রদায়িক বিরোধ বা হিন্দু উদ্বাস্তুর বিষয়ে ভারতীয় সরকারের অভিযোগকে তিনি নাকচ করেন এবং পরিস্থিতি দেখতে বিদেশি সাংবাদিক আনার কথা বলেন।

এরপর চেসল লিখেছেন, ‘জিয়া বলেন, এ পরিস্থিতিতে ভারতের ওপর যথেষ্ট ও ব্যাপকভিত্তিক চাপ প্রয়োগ করা দরকার, যাতে তারা এই পাগলামি বন্ধ করে। তাদের বুঝতে দেওয়া উচিত, এটা একাত্তর নয়, পঁচাত্তর সাল এবং তারা এখন ৬০ হাজার সদস্যের একটি সেনাবাহিনী এবং সাড়ে সাত কোটি মানুষ তাদের জন্য বিরাট সমস্যা তৈরি করবে। সামরিক পরিভাষায় তিনি তেমন পরিস্থিতির যৌক্তিকতা দিয়ে আরও বললেন, তাঁর ধারণা, ভারতীয় সামরিক বাহিনী এমন একটি এলাকা নিয়ন্ত্রণ করতে চায় যেটির অবস্থান তাদের (মূল ভূখন্ড) এবং তাদের পূর্বাঞ্চলীয় ভূখণ্ডের মধ্যবর্তী।...’ চেসল তাঁর বার্তায় উল্লেখ করেন যে, ‘জিয়ার চূড়ান্ত যুক্তি ছিল, ভারতের দিক থেকে তেমন কোনো তৎপরতা শুরু হলে তা এমনই গোলযোগ ডেকে আনবে, যার ফলে অন্যান্য বিশ্বশক্তিকে ব্যতিব্যস্ত হতে হবে। যা কিনা প্রত্যেকের জন্য বিরাট ঝামেলা তৈরি করবে। জিয়া ও পররাষ্ট্রসচিব উভয়ে আমাকে অনুরোধ করেন যে, আমি যেন তাঁদের এই উৎকণ্ঠা অবিলম্বে মার্কিন সরকারের উচ্চপর্যায়ে অবহিত করি। ভারতকে নিষ্ক্রিয় করতে সম্ভব সব উদ্যোগ নেওয়া হয়। আমার গাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে এলেন তোবারক হোসেন। বললেন, সহায়তা চাওয়ার এই অনুরোধ ব্রিটিশ ও অস্ট্রেলিয়ার মতো মিশনকে অবহিত করতে তাঁদের সম্মতি রয়েছে।’ লক্ষণীয়, প্রাপ্ত দলিলগুলো থেকে বোঝা যায় না যে মার্কিন সরকার জিয়াকে সহায়তা দিতে সুনির্দষ্ট কোনো আশ্বাস দিয়েছিল।

উল্লেখ্য, ১৯৭৩ সালের ১১ জুলাই মেজর রশীদের মুখে ব্রিগেডিয়ার জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বাধীন কথিত কমিটির পক্ষে অস্ত্র চাওয়ার ঘটনায় জিয়ার আদৌ কোনো ভূমিকা ছিল কি না, তা জানা যায় না। জিয়ার নামটি মার্কিন দলিলে দ্বিতীয়বার আসে ২১ অক্টোবর অর্থাৎ ৭ নভেম্বরের ‘সিপাহি-জনতার’ বিপ্লবের আগে। জিয়া সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের আরেকটি গোপন দলিলের হদিস পাওয়া গেলেও তা এখনো সংগ্রহে আসেনি। ওই দলিলটি একটি টেলিগ্রাম, যা ঢাকার দূতাবাস থেকে ৭ নভেম্বর ১৯৭৫ ওয়াশিংটনে পাঠানো হয়েছিল। এর শিরোনাম হলো, ‘ট্রাবল ইন বাংলাদেশ : ফার্স্ট থটস অব জিয়া’ অর্থাৎ ‘গোলযোগপূর্ণ বাংলাদেশ, জিয়াকে নিয়ে প্রাথমিক ভাবনা’। এই টেলিগ্রামের বিষয়বস্তু হলো, বাংলাদেশে সরকার উৎখাত ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং জিয়াউর রহমান সম্পর্কে মূল্যায়ন। যোগাযোগ করা হলে মার্কিন রেকর্ডস সার্ভিস ডিভিশনের আর্কাইভস স্পেশালিস্ট ডেনিয়েল আর ল গত ১৫ এপ্রিল অন্য একটি বিভাগের শরণাপন্ন হওয়ার পরামর্শ দেন। সেখানে যোগাযোগ করা হলেও এখনো সাড়া মেলেনি। এটিসহ সংশ্লিষ্ট আরও কিছু দলিল সংগ্রহের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।

প্রাপ্ত মার্কিন নথিপত্র বিশ্লেষণে এখন দেখা যাচ্ছে, আগস্ট অভ্যুত্থানের সঙ্গে জড়িত হিসেবে আলোচিত খন্দকার মোশতাক আহমদ, মেজর ফারুক, মেজর রশীদেরই মার্কিন সম্পৃক্ততা ছিল না। জেনারেল জিয়াউর রহমানও সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জারের নেতৃত্বাধীন মার্কিন প্রশাসনকে একান্ত আপন মনে করেছিলেন। ৭ নভেম্বর জিয়া ক্ষমতা নিয়েই তাঁর দূতকে বোস্টারের কাছে পাঠান। ব্যক্তিগত শুভেচ্ছার জবাবে বোস্টার এ সময় জিয়াকে পুরোনো বন্ধু হিসেবে উল্লেখ করেন।

‘বাংলাদেশটা পাকিস্তানপন্থী, ইসলামপন্থী পাশ্চাত্যপন্থী হয়ে গেছে। ভারত এখন বাংলাদেশে সামরিক অভিযান চালাতে পারে। এটা ঠেকাতে আমরা যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন চাই।’ ১৯৭৫ সালে ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার ৮১ দিনের মাথায় ক্ষমতা নিয়েই মার্কিন সরকারের কাছে এই ছিল বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জেনারেল জিয়াউর রহমানের প্রথম বার্তা। জিয়া এদিনও সম্ভাব্য ভারতীয় সামরিক হস্তক্ষেপের আশঙ্কায় বিচলিত ছিলেন বলে মার্কিন দূতকে স্পষ্ট ধারণা দেন। ২৪ ডিসেম্বর ১৯৭৫ সকালে তৎকালীন মার্কিন চার্জ না দ্য অ্যাফেয়ার্স চেসলের কাছে জিয়া মার্কিন দূতাবাসে সামরিক অ্যাটাশে নিয়োগদানের অনুরোধ জানান। চেসল লিখেছেন, জিয়ার এই অনুরোধকে এর আগে তোবারক হোসেনের বক্তব্যের আলোকে দেখতে হবে।

বোস্টার পঁচাত্তরের ৭ নভেম্বর ওয়াশিংটনে পাঠানো টেলিগ্রামে লিখেছেন, বাংলাদেশ সরকারের ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্রসচিব নজরুল ইসলাম দ্রুতাবাসের ডেপুটি চিফ অব মিশনের (ডিসিএম) সঙ্গে বৈঠকে বলেন, তিনি আদিষ্ট হয়ে এই বার্তা পৌঁছে দিচ্ছেন যে, ভারত যদি বাংলাদেশে কোনো অভিযান চালায় তাহলে তা প্রতিহত করতে বাংলাদেশ সরকার যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন চাইছে। বিদ্যমান পরিস্থিতি তিনি চীন ও পাকিস্তানের কাছেও পোঁছে দেবেন।
 
নজরুল মার্কিন দূতাবাসে এদিন আলোচনার শুরুতেই দীর্ঘ আবেগাপ্লুত বয়ান দেন। তাঁর কথায়, সশস্ত্র বাহিনীর সবাই জেনারেল জিয়া ও মোশতাক উভয়ের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করেছেন। ভারতীয় হস্তক্ষেপের আশঙ্কায় তাঁরা প্রত্যেকেই উদ্বিগ্ন ও বিচলিত। বাংলাদেশ সরকার সীমান্ত দিয়ে এমনকি সরাসরি ভারতীয় আগ্রাসন ও স্থানীয় নাশকতার আশঙ্কাও উড়িয়ে দিচ্ছে না। তবে বাংলাদেশে ভারতীয়দের জনপ্রিয়তা নেই বলে সরকার স্থানীয় নাশকতার আশঙ্কা ততটা করে না।

মার্কিন সমর্থন আদায় প্রশ্নে তিনি বলেন, সরকার তাঁকে জানাতে বলেছে যে, মার্কিন সহায়তা প্রাপ্তিই হচ্ছে এ মুহূর্তে বাংলাদেশ সরকারের কাছে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার। সময়টা বড়ই জরুরি। তবে এই সহায়তা যুক্তরাষ্ট্র কীভাবে বাংলাদেশের জন্য নিশ্চিত করবে, তা একান্তভাবেই ওয়াশিংটনের ইচ্ছাধীন। বোষ্টার লিখেছেন, ‘বাংলাদেশ সরকার তাঁকে এ কথাও অবহিত করতে বলেছে যে, যুক্তরাষ্ট্র যেন চীন ও পাকিস্তানের কাছেও বাংলাদেশের এই যে বিদ্যমান অবস্থা তা জানিয়ে দেয়। বিশেষ করে পাকিস্তান যেন বাংলাদেশের পক্ষে মুসলিম দেশগুলোর সমর্থন আদায়ে সচেষ্ট হয়। এসব কথার পিঠে আমাদের ডেপুটি চিফ অব মিশন ডিসিএম বলেন, তিনি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তাঁর দেওয়া বার্তা ওয়াশিংটনে পৌঁছে দেবেন।’

ভারতের মোকাবিলায় মার্কিন সহায়তা : 

পঁচাত্তরের ২১ অক্টোবর বোস্টার ফারুক রশীদকে ১৫ আগস্ট অভ্যুত্থানের কেন্দ্রীয় চরিত্র আখ্যা দিয়ে লিখেন, তাদের আহবানে সাড়া দিয়ে মার্কিন দূতাবাসের পলিটিক্যাল কাউন্সিলর তাঁর বাসভবনে তাদের সঙ্গে ১৯৭৫ সালের ২১ অক্টোবরের সন্ধ্যায় বৈঠক করেন। দুই মেজর কুশলাদি বিনিময়ের পর ভারতের তরফ থেকে বাংলাদেশ বর্তমানে কীভাবে হুমকিগ্রস্ত তার বিবরণ দেন। তাঁরা বলেন, তাঁদের কাছে এমন খবর রয়েছে যে, ভারতীয়রা মোশতাক সরকারকে বিপদে ফেলতে চাইছে।

উদাহরণ হিসেবে তাঁরা উল্লেখ করেন, ‘ভারতীয় হাইকমিশনার সমর সেন প্রচার করছেন যে, সরকার নতুন করে অভ্যুত্থানের মুখোমুখি। ১৬ অক্টোবরে রাষ্ট্রপতি মোশতাকের সঙ্গে বৈঠকের আগে কতিপয় সাংসদকে টেলিফোনে সতর্ক করে দেওয়া হয়েছিল। তারা যেন বৈঠকে যোগ না দেন। ওই বৈঠক যাতে সবাই বর্জন করেন, তাতে ভারতের মদদ ছিল। চট্টগ্রামে সোভিয়েত কনসাল জেনারেল ও ভারতীয় সহকারী হাইকমিশনার সক্রিয় রয়েছেন, যাতে অস্ত্র সমার্পণের সরকারি উদ্যোগ বাধাগ্রস্ত হয়। এ জন্য এমনকি তাঁরা বাঙালিদের প্ররোচিত করে অবৈধ অস্ত্র কিনে সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে চাইছেন। ভারতীয় মদদেই টাঙ্গাইলের ঘটনা ঘটে। মেজররা বলেন, সোভিয়েত উৎসাহে ভারতীয়রা মোশতাক সরকারকে নাস্তানাবুদ করতে এ ধরনের উসকানিমূলক ঘটনা আরও ঘটাবে। মেঘালয়ের তুরায় একটি ঘাঁটি স্থাপন করা হয়েছে। এই স্থান থেকে কাঁদের সিদ্দিকী ও তাঁর অনুসারীরা বিভিন্ন তৎপরতা চালাচ্ছেন। গণতন্ত্র পুনরুজ্জীবনে যে প্রতিশ্রুতি সরকার দিয়েছে তা প্রতিহত করতে ভারত সর্বাত্মক চেষ্টা চালাবে। এ বিষয়ে তারা নিশ্চিত।’

তৃতীয় কোনো দেশ: 

মেজররা উল্লেখ করেন, তাঁরা মনে করেন না যে, চীন কিংবা পাকিস্তানের কাছে সাহায্য পাওয়া গেলেও তা ভারতীয় হুমকি নস্যাৎ করতে পর্যাপ্ত বলে গণ্য হতে পারে। মেজররা জানতে চান যে, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশ সামরিক বাহিনীকে যুদ্ধসরঞ্জাম দিয়ে সাহায্য দিতে প্রস্তুত থাকবে কি না। এটা তারা সরাসরি কিংবা তৃতীয় কোনো দেশের মাধ্যমেও দিতে পারে। বোষ্টার ১৯৭৩ সালে তাদের মিশন সম্পর্কে ইঙ্গিত না দিয়ে লিখেছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র অস্ত্র সরবরাহ প্রশ্নে অতীতে কেমন মনোভাব পোষণ করেছে, সেটা তারা পাকিস্তান আর্মিতে থেকে দেখেছিলেন। তাই মেজরা বলেন, তাঁরা অস্ত্র চাইছেন না, কিন্তু হেলিকপ্টার ও সড়কযান দরকার। তাঁরা অবশ্য উল্লেখ করেন, তাঁরা প্রত্যক্ষ ভারতীয় সামরিক হস্তক্ষেপ আশঙ্কা করছেন না। কিন্তু এসব বিষয় দরকার, কারণ তাদের ভাষায় ভারতীয়দের দ্বারা উৎসাহিত ও সমর্থিত কোনো অভ্যন্তরীণ ও গুরুতর নিরাপত্তার হুমকি মোকাবিলায় এর দরকার হতে পারে।’

বর্তমান হুমকি:

মার্কিন পলিটিক্যাল কাউন্সিলর ফারুক-রশীদকে বলেছেন, তাঁদের অনুরোধ সম্পর্কে কোনো মন্তব্য করার অবস্থানে তিনি নেই। তিনি এ ধরনের অনুরোধ ওয়াশিংটনে বাংলাদেশ দূতাবাস কর্তৃক মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে করা উচিত বলে মত দেন। মেজররা তখন জানতে চান, এ ধরনের অনুরোধ আনুষ্ঠানিকভাবে করা হলে সম্ভাব্য মার্কিন মনোভাব কী হতে পারে? তারা ইঙ্গিত দেন যে, মার্কিন সরকারের মনোভাব যদি নেতিবাচক হয়, তাহলে বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিকভাবে এই অনুরোধ জানাবে না। এ পর্যায়ে পলিটিক্যাল কাউন্সিলর পুনরায় স্মরণ করিয়ে দেন যে, তিনি এ বিষয়ে নির্দিষ্ট কোনো মন্তব্য করতে অপারগ। তবে অর্থনৈতিক সহায়তার মাধ্যমে বাংলাদেশের শ্রীবৃদ্ধি দেখতে যুক্তরাষ্ট্র সরকার উৎসাহী। তখন মেজর ফারুক উত্তর দেন, দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অবশ্যই প্রয়োজনীয়। কিন্তু যদি বর্তমান হুমকি মোকাবিলা করা সম্ভব না হয়, তাহলে সে ধরনের উন্নয়নের সুফল বাংলাদেশ যে ভোগ করতে পারবে, তার কোনো নিশ্চিয়তা নেই।

বোস্টার এ পর্যায়ে এই মর্মে নিজস্ব মন্তব্য জুড়ে দেন। যা অবিকল নিম্নরূপ-‘মেজররা এটা উল্লেখ করেননি যে, তাঁরা যে পলিটিক্যাল কাউন্সিলরের সঙ্গে বৈঠক করলেন তাতে রাষ্ট্রপতির সায় আছে কি না। তাঁরা যেহেতু অতীতে স্বেচ্ছাপ্রণোদিতভাবে কথা বলেছেন, এবারও হয়তো তেমনই ব্যক্তিগত উদ্যোগ নিয়ে মাছ শিকারে বেরিয়েছেন। যে কারণেই তারা এ উদ্যোগ নিন না কেন, পলিটিক্যাল কাউন্সিলরকে মেজররা বলেছেন যে, তাঁরা আর খেয়ালখুশিমাফিক কোনো সমস্যা সমাধান করার প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত নন, যেমনটা আগে দেখা গেছে। এবার সম্পূর্ণরূপে অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার হুমকির বিষয়ে বিচলিত হয়েই তাঁরা তাঁদের একান্ত দৃষ্টিভঙ্গির বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন। তাঁরা মনে করেন, বাংলাদেশের অখণ্ডতা ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়ন দ্বারা হুমবিগ্রস্ত। ভারত কী করছে, সে বিষয়ে আমরা মন্তব্য করতে সক্ষম নই। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার ভারত কী করছে বলে যা ধরে নিচ্ছে, তার চেয়ে হয়তো বিষয়টি অনেক কম গুরুত্বপূর্ণ।’

বোস্টার এ পর্যায়ে লিখেছেন, ‘তবে আমরা এ ধারণার বশবর্তী হয়ে নিজেদের চালিত করছি যে, মেজররা যখন তরুণ, অনভিজ্ঞ এবং সম্ভবত অর্বাচীন কিন্তু তাঁরা দায়িত্বহীন নন। এবং তাঁরা  তেমন আশঙ্কারই প্রতিফলন ঘটিয়েছেন, যা সরকারের মধ্যকার অন্যদের মধ্যেও রয়েছে।’

নিরুৎসাহমূলক প্রতিক্রিয়া:  

বোস্টার নিজের জবানিতেই এই টেলিগ্রামের উপসংহার টানেন এই বলে, ‘রাষ্ট্রদূত ইতিপূর্বে সেনাবাহিনীর প্রধান জিয়াউর রহমানকে মার্কিন সামরিক সহায়তার সম্ভাবনার প্রশ্নে নিরুৎসাহমূলক প্রতিক্রিয়া ব্যাখ্যা করেছিলেন।’

বোস্টার ওই বার্তায় বলেন, ‘পররাষ্ট্র দপ্তর যদি মেজরদের আলোচনার বিষয়ে সরাসরি কোনো কিছু জানিয়ে দিতে প্রয়োজন অনুভব করে, তাহলে দয়া করে অনুরূপ নির্দেশনা দিন। যদিও মেজরদের কাছে পলিটিক্যাল কাউন্সিলর এমনভাবে মনোভাব ব্যক্ত করেছেন, যাতে আমরা ইচ্ছা না করলে এ বিষয়ে তাদের আর কিছু বলার দরকার পড়বে না।’ 

শিক্ষার সব খবর সবার আগে জানতে দৈনিক শিক্ষার ইউটিউব চ্যানেলের সাথেই থাকুন। ভিডিওগুলো মিস করতে না চাইলে এখনই দৈনিক শিক্ষাডটকমের ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন এবং বেল বাটন ক্লিক করুন। বেল বাটন ক্লিক করার ফলে আপনার স্মার্ট ফোন বা কম্পিউটারে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ভিডিওগুলোর নোটিফিকেশন পৌঁছে যাবে।

দৈনিক শিক্ষাডটকমের ইউটিউব চ্যানেল  SUBSCRIBE করতে ক্লিক করুন।

চট্টগ্রামে সংঘর্ষে শিক্ষার্থীসহ নিহত ২ - dainik shiksha চট্টগ্রামে সংঘর্ষে শিক্ষার্থীসহ নিহত ২ ঢামেকে একজনের মৃত্যু - dainik shiksha ঢামেকে একজনের মৃত্যু জবির কোটা আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ ৪ - dainik shiksha জবির কোটা আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ ৪ বেরোবিতে ত্রিমুখী সংঘর্ষে নিহত ১, আহত ২০০ - dainik shiksha বেরোবিতে ত্রিমুখী সংঘর্ষে নিহত ১, আহত ২০০ শহীদ মিনার এলাকায় অধ্যাপককে মারধর - dainik shiksha শহীদ মিনার এলাকায় অধ্যাপককে মারধর মুক্তিযোদ্ধাদের সর্বোচ্চ সম্মান দিতে হবে : প্রধানমন্ত্রী - dainik shiksha মুক্তিযোদ্ধাদের সর্বোচ্চ সম্মান দিতে হবে : প্রধানমন্ত্রী সময়মতো যথাযথ অ্যাকশন নেয়া হবে : কাদের - dainik shiksha সময়মতো যথাযথ অ্যাকশন নেয়া হবে : কাদের সবকিছু আমাদের নিয়ন্ত্রণে নেই: ঢাবি উপাচার্য - dainik shiksha সবকিছু আমাদের নিয়ন্ত্রণে নেই: ঢাবি উপাচার্য যারা নিজেদের রাজাকার বলেছে তাদের শেষ দেখে ছাড়বো - dainik shiksha যারা নিজেদের রাজাকার বলেছে তাদের শেষ দেখে ছাড়বো সায়েন্সল্যাবে কলেজ শিক্ষার্থীদের অবরোধ, যান চলাচল বন্ধ - dainik shiksha সায়েন্সল্যাবে কলেজ শিক্ষার্থীদের অবরোধ, যান চলাচল বন্ধ র‌্যাঙ্কিংয়ে এগিয়ে থাকা কলেজগুলোর নাম এক নজরে - dainik shiksha র‌্যাঙ্কিংয়ে এগিয়ে থাকা কলেজগুলোর নাম এক নজরে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0093939304351807