দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সরকারি প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষা চলছে। সংবাদমাধ্যমে যেসব সংবাদ জানতে পেরেছি তারমধ্যে পজিটিভ নিউজ হলো- এই পরীক্ষার ১৮সেট প্রশ্নপত্র বুয়েটের সহায়তায়, সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে তাদের প্রেস থেকে ছাপা হয়। তারপর দ্বৈবচয়ন ভিত্তিতে একজন কর্মকর্তা প্রশ্ন বাছাই করেন, যিনি প্রাথমিক ও গণশিক্ষা কিংবা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সাথে সংশ্লিষ্ট নন। পরীক্ষা শেষ না হওয়া পর্যন্ত তিনি অন্তরীণ থাকেন এবং থাকেন সব ধরনের ডিভাইসের বাইরে। পরীক্ষার হলে বুয়েটের সিগন্যাল পাওয়ার পর পরীক্ষার দশ মিনিট আগে প্রশ্নপত্রের প্যাকেট খোলা হয়। এটি জেনে খুব ভাল লেগেছে।
শিক্ষার মান উন্নয়নের জন্য শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে মন্ত্রণালয়ের এই পদক্ষেপ সত্যিই প্রশংসনীয়। এভাবেই হতে হয় পরীক্ষা। মৌখিক পরীক্ষায়ও যাতে শিক্ষানুরাগী নামে কোনো রাজনৈতিক ব্যক্তি ভাইভা বোর্ডে থাকতে না পারেন সেজন্যও ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। তারপরেও বিভিন্নভাবে অসৎ লোকজন এই নিয়োগ পরীক্ষায় টিকতে চান। কর্তৃপক্ষের কঠোর পদক্ষেপ ও আইন শৃংখলা বাহিনীর নজরদারির ফলে দেশের বিভিন্ন স্থানে এ ধরনের অসৎ উপায় অবলম্বনকারীদের সনাক্ত করে আইনের আওতায় আনা হচেছ। এটিও ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য। কারণ যারা দেশের কোমলমতি শিশুদের জ্ঞানদান করে রাষ্ট্রের ভবিষ্যত সুযোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলবেন তাদের সে ধরনের সততা ও মানসিকতা থাকতে হবে।
বর্তমানে দেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর উন্নয়নে পিইডিপি-৪ প্রকল্প চলমান, এটি মূলত অবকাঠামোগত কাজ করছে। ঢাকায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মূল সমস্যা অবকাঠামোগত। এ সমস্যা দূর করার জন্য ৩৪৬টি বিদ্যালয়ে দৃষ্টিনন্দন ভবন নির্মাণের কাজ চলছে। এর পরের প্রকল্পে জোর দেয়া হবে মানস্মমত শিক্ষায়। এটি আমরা একটি ভাল অবস্থায় দেখতে চাই। প্রাথমিক শিক্ষা সরকারি হওয়ায় এখন অনেক মেধাবী ও উচচশিক্ষিত প্রার্থী প্রাথমিক শিক্ষকতায় যোগ দিচেছন এটিও একটি ভাল লক্ষণ। তবে, মেধাবীদের ধরে রাখা এবং তাদের উপরে ওঠার পদসোপান এখনও মসৃণ নয়। এটি নিয়ে কাজ করার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। দেশজুড়ে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপনের উদ্দেশ্য ছিলো বিনামূল্যে মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা। সেটি থেকে আমরা এখনও অনেক দূরে অবস্থান করছি। তবে, এটিও ঠিক যে, পুরো প্রাথমিক শিক্ষাই রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে থাকলে মান রক্ষা করা এবং সার্বিক বিষয়ে তদরকীতে সমস্যা হওয়ার কথা এবং তাই অনেক ক্ষেত্রে হচেছ।
আমাদের প্রাথমিক শিক্ষা পরিবার অনেক দেশের মোট জনসংখ্যার চেয়েও অনেক বড়। কাজেই এটিকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত করা চাট্টিখানি কথা নয়। তাই রাষ্ট্রের মূল বিষয়গুলোকে ঠিক রেখে যেখানে বেসরকারি পর্যায়ে মানসম্মত শিক্ষাদান করা সম্ভব সেটিও নিয়মনীতির মধ্যে থেকে পরিচালনা করার বৈধ অনুমতি থাকা প্রয়োজন। তাতে একটি প্রতিযোগিতাও থাকে।
ঢাকা সিটিতে বহু ধরনের মানুষ বাস করে। উচচবিত্ত, উচচ মধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত, ছিন্নমূল জনসাধারণ, বস্তিবাসী ইত্যাদি। কাজেই ঢাকার সরকারি প্রাথমিক অন্যান্য এলাকার প্রাথমিকের চেয়ে আলাদা হবে এটিই স্বাভাবিক। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর একটি চমৎকার তথ্য প্রকাশ করেছে যে, ঢাকা সিটিতে সরকারি প্রাথমিক ও প্রাক-প্রাথমিকে পড়ছেন মাত্র ২০ শতাংশ শিক্ষার্থী, বাকী ৮০ শতাংশই অধ্যয়ন করছেন বিভিন্ন বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে।
ঢাকা সিটিতে রয়েছে বিদেশি স্কুল, ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল, কিন্ডারগার্টেন, ব্যক্তি মালাকানাধীন স্কুল, মাধ্যমিকের সাথে প্রাথমিক, সরকারি মাধ্যমিকের সাথে সরকারি প্রাথমিক। এখানে প্রাথমিক শিক্ষা বিভিন্নভাবে পরিচালিত হচেছ। তারপরেও নিম্নবিত্ত ও ছিন্নমূল এবং বস্তিবাসীদের জন্য উন্নতমানের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থাকা প্রয়োজন, সেটির অভাব রয়েছে।
ঢাকার বাইরে প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীর অর্ধেকের বেশি পড়াশুনা করছেন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। বিভাগীয় শহরগুলোর মধ্যে চট্টগ্রামে ৫৬ দশমিক ৩৪ শতাংশ, রাজশাহীতে ৬৪ দশমিক ১১ শতাংশ, রংপুরে ৪৮ দশমিক ৯ শতাংশ, খুলনায় ৬৪ দশমিক ১৯, ময়মনসিংহে ৫৭ দশমিক ২৪, সিলেটে ৬৭ দশমিক ২ এবং বরিশালে ৭৭ দশমিক ৬৭ শতাংশ শিক্ষার্থী পড়াশুনা করছেন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে।
প্রাথমিক পরিসংখ্যানে উঠে এসেছে, ঢাকায় প্রাক-প্রাথমিক পর্যায়ে মোট শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৩ লাখ ২২ হাজার ৯০৭ জন। তাদের মধ্যে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ছেন ৪৫ হাজার ৪১৮ জন। যা মোট শিক্ষার্থীর মাত্র ১৪ দশমিক ৬ শতাংশ। অন্যদিকে প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত মোট শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১৩ লাখ ৫২ হাজার ৭২৩ জন। তাদের মধ্যে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ছেন মাত্র ২ লাখ ৯০ হাজার ৬০৩ জন যা মোট শিক্ষার্থীর ২১ দশমিক ৪৮ শতাংশ। সব মিলিয়ে এখানে প্রাক-প্রাথমিক ও প্রাথমিক পর্যায়ে মোট শিক্ষার্থীর মাত্র ২০ দশমিক ৬ শতাংশ পড়াশোনা করছেন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে।
অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধার অভাব, নিরাপত্তা ব্যবস্থার অপর্যাপ্ততা, বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অধিক্য এবং আর্থিকভাবে সচছল ব্যক্তিদের অনীহার কারণেই ঢাকায় প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোয় শিক্ষার্থীরা কম ভর্তি হচেছন। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর অবকাঠামো জরাজীর্ণ, নিরাপত্তাব্যবস্থা অপর্যাপ্ত। মূলত এসব কারণেই শিক্ষার্থী কম ভর্তি হন। এ ছাড়া অনেক জায়গায় দেখা যায়, সরকারি প্রাথমিকের শিক্ষকরা কোচিং ব্যবসায় জড়িত এবং শিক্ষার্থীদের ভাল ফল করতে কোচিংয়ে ভর্তি হতে হচেছ। ফলে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আপাতদৃষ্টিতে খরচ কম হলেও কোচিংয়ের কারণে খরচ বেড়ে যাচেছ। এ কারণেও অনেক অভিভাবক সরকারি প্রাথমিকে সন্তানকে পড়াতে চান না। অনেক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নেই কোনো খেলার মাঠ। এমনকি অনেক বিদ্যালয়ের জমিও বেদখল হয়ে গেছে।
শিক্ষক ও প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এসব বিদ্যালয়ে যারা পড়াশুনা করছেন, তাদের প্রায় সবাই নিম্নবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। এসব শিক্ষার্থীর ৩০-৪০ শতাংশই প্রায় নিয়মিত ক্লাস অনুপস্থিত থাকেন।
ঢাকার অধিকাংশ বিদ্যালয়ই জরাজীর্ণ ভবনে কার্যক্রম চালাচেছ। জানা যায়, রমনা থানার নয়টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মধ্য একটির জায়গা সম্পূর্ণরূপে কাঁচাবাজার বসিয়ে দখল করা হয়েছে। বাকিগুলোর মধ্যে দিলকুশা বিদ্যালয়ের জমি নিয়ে সমস্যার কারণে কাজ শুরুই করা যাচেছ না। আর বাকি সাতটির মধ্যে পাঁচটিরই খেলার মাঠ নেই এবং ভন জরাজীর্ণ। এ ছাড়া স্কুলগুলোয় পরিচছন্নতাকর্মী এবং গেটে দারোয়ন রাখার ব্যবস্থা নেই। ফলে অনেক সময় বিদ্যালয়গুলো নোংরা থাকছে। নিরাপত্তাও নিশ্চিত করা যাচেছ না। স্বাভাবিকভাবেই এমন পরিবেশে অভিভাবকরা সন্তানদের পড়াতে চান না।
আর ঢাকায় যেহেতু বিকল্প শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সুযোগ বেশি, অর্থ ব্যয় করে হলেও তারা সেখানে যাচেছন। কিছু কিছু বিদ্যালয় আছে তিনতলা বা চারতলার ওপর (যেমন বাংলমোটরের খোদেজা খাতুন বিদ্যালয়)। মূল সড়কের কাছাকাছি অবস্থিত স্কুলটিতে নেই কোনো খেলার মাঠ বা খোলা জায়গা। এখানে কাগজে কলমে ২০০ শিক্ষার্থী থাকলেও দেখায় ৪০-৫০ জনকে। আর সাতজন শিক্ষকদের মধ্যে উপস্থিত থাকেন তিনজন, এমনকি প্রধান শিক্ষকও অনুপস্থিত থাকেন। এমতাবস্থায় মধ্যবিত্ত শ্রেণির যারা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সন্তানদের পাঠান তারা বেসরকারি বিদ্যালয়ে ভর্তির প্রস্তুতি ও স্কুলের পরিবেশের সাথে পরিচিতির জন্য এখানে পাঠান। আবার কোথাও স্কুল ভবন নির্মানাধীন থাকায় ভাড়া করা একটি বা দুটি রুমে স্কুলের কাজ চালান, এতে কোনো অভিভাবক আকৃষ্ট হন না। মাধ্যমিক পর্যায়ে উঠে স্কুল পরিবর্তনের ঝামেলা এড়াতেও অনেক অভিভাবক সন্তানদের সরকারি প্রাথমিকে ভর্তি করাতে চান না।
দেশব্যাপী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো চিত্রও এক নয়। কোথাও কোথাও একটু ভালো, খুব কম জায়গাতেই একটু বেশি ভালো, তবে অধিকাংশ জায়গাতেই বেহাল অবস্থা। বিশাল এই প্রাথমিক শিক্ষার দেখভাল করাও কঠিন। তারপরেও মাঝে মাঝে প্রাথমিক শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তর দুএকটি তথ্য প্রকাশ করে যা খুবই প্রয়োজন। এ ধরনের সমীক্ষা ও গবেষণা আরো প্রয়োজন। অনেকেরই এ কাজে এগিয়ে আসা প্রয়োজন। অনেকের তথ্য এবং তথ্যের সাথে বাস্তবায়নযোগ্য কিছু পদক্ষেপের উল্লেখ থাকলে প্রাথমিক শিক্ষা কর্তৃপক্ষের জন্য পদক্ষেপ নেয়া সুবিধাজনক হবে।
কাজেই, ঢাকা সিটির চেয়ে দেশের সার্বিক প্রাথমিক শিক্ষা নিয়ে প্রচুর গবেষণা প্রয়োজন, সঠিক পদক্ষেপ প্রয়োজন। ঢাকা সহ অন্যান্য সিটিগুলোর প্রাথমিক বিদ্যালয় নিয়ে ভিন্নভাবে চিন্তা করে এসব শহরে বসবাসরত নিম্নবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্তদের জন্যও মানসম্পন্ন প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করা জরুরি।
লেখক: ক্যাডেট কলেজের সাবেক অধ্যাপক