শিরোনামটা একটু চমকে দেবার মতো। একজন শিক্ষককে ফ্রেন্ড, ফিলসোফার, গাইড, বুদ্ধিজীবী ইত্যাদি বিশেষণে বিশেষায়িত না করে মেধাজীবী বলা হচ্ছে। কিন্তু কেনো? একজন শিক্ষক কি তবে বুদ্ধিজীবী নন? বুদ্ধিজীবীর সংজ্ঞা এবং ভূমিকা নিয়ে বিস্তর আলোচনা করেছেন ফরাসি চিন্তক জুলিয়েন বেন্দা তার ‘ট্রিজন অব দ্য ইন্টেলেকচুয়ালস’ গ্রন্থে, ইটালীয় মারক্সিস্ট দার্শনিক আন্তোনীয় গ্রামসি তার ‘প্রিজন নোটবুকস’ গ্রন্থে এবং প্যালেস্টিনিয়ান-আমেরিকান দার্শনিক এডওয়ার্ড সাঈদ তার ‘ওরিয়েন্টালিজম’ এবং ‘রিপ্রেজেন্টেশন অব দ্য ইন্টেলেকচুয়ালস’ গ্রন্থে। এ ছাড়াও ফ্রান্স ফানো এবং এইমে সেজায়ারও বুদ্ধিজীবীগণের কাজ নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা করেছেন। সাম্প্রতিককালে ভারতের ইতিহাসবিদ গৌতম ভদ্র বুদ্ধিবৃত্তিক পেশাজীবীদের ‘বুদ্ধিজীবী’ পরিচয় নাকচ করে দিয়ে রণজিৎ গুহ-র মতাদর্শকে গুরুত্ব দিয়ে বলেছেন, এদের নাম হোক মেধাজীবী। গৌতম ভদ্র আরো বলেছেন, বুদ্ধি আর মেধা এক জিনিস নয়, বুদ্ধির সঙ্গে দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি যুক্ত হলেই সে মেধার চেহারা নেবে। আর তখনই সামগ্রিকতার মধ্যে নিজেকে খতিয়ে দেখার জ্ঞান অর্জিত হবে, উচিত-অনুচিতের পার্থক্য বোঝার অনুভূতি তৈরি হবে। মেধাজীবীদের দায়িত্ব হলো নিরন্তর প্রশ্ন তোলা, নিজেকে প্রশ্ন করা। একজন মেধাজীবী তার পেশায় আত্মমর্যাদাকে গুরুত্ব দেবেন, তার চারিত্রিক দৃঢ়তা থাকবে এবং তার চরিত্রগত ধর্মবোধ এবং নৈতিকতার লক্ষণ দেখে বুঝা যাবে তিনি একজন মেধাজীবী। সেই অর্থে এ আলোচনায় আমরা সত্যিকার একজন শিক্ষককে বুদ্ধিজীবী বলার চেয়ে বরং মেধাজীবী হিসেবে আখ্যায়িত করতেই অধিক পছন্দ করছি।
বুদ্ধিজীবী এবং মেধাজীবীর মধ্যে পার্থক্যটা অনেকখানি জ্ঞান ও প্রজ্ঞার মতই। এ বিষয়ে আরেকটু স্পষ্ট হবার জন্য আমরা আরো একবার গ্রামসি এবং গৌতম ভদ্রের শরণাপন্ন হতে পারি। আন্তোনীয় গ্রামসি বুদ্ধিজীবীদেরকে ট্র্যাডিশনাল (ঐতিহ্যিক) এবং অরগানিক (জৈবিক) এই দুই বর্গে ভাগ করেছেন। বুদ্ধিবৃত্তিক তৎপরতা এবং সামাজিক প্রক্রিয়া নিয়ে গড়ে তোলা তার তত্ত্বের একেবারে কেন্দ্রে রয়েছে এই বিভাজন। বুদ্ধিবৃত্তিক পরিসর গড়ে ওঠে বিশেষ বিশেষ সামাজিক শ্রেণি বা গোষ্ঠীর জৈবিক বুদ্ধিজীবী এবং বৃহত্তর সমাজের ঐতিহ্যিক বুদ্ধিজীবীদের মিশেলে।
ঐতিহ্যিক বুদ্ধিজীবী বলতে মোটা দাগে আমরা যাদেরকে বুঝি গ্রামসি’র ভাষায় তারা দার্শনিক, শিল্পী, লেখক, সাংবাদিক, শিক্ষক এবং ধর্মীয় নেতাও হতে পারেন। এরা পরিশীলিত বা সুশীল ভাষায় কথা বলেন, উচ্চশিক্ষার সুবিধাপ্রাপ্ত এবং অভিজাত সংকৃতির চর্চা করেন। তারা নিজেদেরকে সমাজের রূপান্তরশীল অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রবাহের ছোঁয়ামুক্ত ভাবতে চান যদিও বাস্তবে তারা বিযুক্ত নন। অপরদিকে জৈবিক বুদ্ধিজীবী বলতে গ্রামসি নির্দিষ্ট সামাজিক শ্রেণি বা গোষ্ঠীভুক্ত সেইসব মানুষদের বুঝিয়েছেন যারা বিশেষ ধরণের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে ঐ সামাজিক গোষ্ঠীর সঙ্গে নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত। জুলিয়েন বেন্দা বুদ্ধিজীবী বলতে সীমিতসংখ্যক মহাপ্রতিভাধর ও নৈতিকতায় অবিচল দার্শনিক –রাজগণকে বুঝিয়েছেন যাদের সমন্বয়ে গড়ে উঠে মানবজাতির বিবেক। সত্যিকারের বুদ্ধিজীবী হিসেবে তিনি যীশু ও সক্রেটিসের নাম উল্লেখ করেছেন, তবে পরবর্তীকালে স্পিনোজা, ভল্টেয়ার আর রেনানের নামও ঐ তালিকায় স্থান পায়। সত্যিকারের বুদ্ধিজীবী বলতে তিনি এমন কাউকে বুঝিয়েছেন যিনি কিনা পৃথিবীর কোনো শক্তির ভয়েই ভীত নন এবং সত্য উচ্চারণের জন্য তিনি ক্রুশবিদ্ধ হতে, আগুনে পুড়তে কিংবা শূলে চড়তেও দ্বিধা করেন না। আজকের বাস্তবতায় হয়ত এমন বুদ্ধিজীবী আদৌ খুঁজে পাওয়া যাবে না।আমাদের আজকের আলোচনা বুদ্ধিজীবী বা মেধাজীবী শিক্ষককে নিয়ে, তিনি কেমন হবেন, তিনি কী কী দায়দায়িত্ব পালন করবেন অর্থাৎ একজন আদর্শ শিক্ষক কেমন রূপ নিয়ে আমাদের সামনে হাজির হবেন, তিনি কী করবেন, আর কী করা থেকে নিজেকে বিরত রাখবেন। প্রথমেই বলে রাখা ভালো- একজন মেধাজীবী শিক্ষকের কন্ঠে কালের যাত্রাধ্বনি অনুরণিত হয়ে উঠবে, যিনি হবেন জ্ঞানের আধার, মানবতা ও স্বদেশ-চেতনায় উদ্দীপ্ত এবং একজন মহামানবের মূর্ত প্রতীক যাকে দেখলেই শ্রদ্ধায় শির নত হয়ে আসবে শিক্ষার্থীর, অভিভাবকসহ যেকোনো মানুষের। চারিদিকের প্রতিকূল পরিবেশের অন্ধকার অতিক্রম করে তিনি সামনে এগিয়ে যান জ্ঞানবিতরণের আলোকবর্তিকা হাতে যার পূণ্য করস্পর্শে ধন্য হয় অজস্র শিক্ষার্থীর ভবিষ্যত। এই মেধাজীবীর বাণী থেকেই একজন শিক্ষার্থী পেয়ে থাকেন জীবন সুগঠনের মূলমন্ত্র। এ রকম একজন আদর্শ শিক্ষক হয়ে থাকেন বৈচিত্রে ভিন্নতর কিন্তু আকর্ষণে অনন্য, সংখ্যায় কম হলেও এমন শিক্ষক শিক্ষার্থীদের স্মৃতিতে থাকেন সর্বদা সমুজ্জ্বল। তার অপূর্ব বাচনভঙ্গি, সুনির্বাচিত শব্দাবলীর উচ্চারণ, আর সহানুভূতিসমৃদ্ধ স্নেহসুধা শ্রেণিকক্ষের সবাইকে আচ্ছন্ন করে রাখে। একজন প্রকৃত শিক্ষককে সর্বদা স্মরণ রাখতে হবে- তিনি শিক্ষার্থীদের জীবনে বিশুদ্ধ জ্ঞানের উৎসের সন্ধান দেবেন, রসহীন পাঠ্য বিষয়বস্তুকেও তিনি রসমধুর করে তুলবেন যেনো শিক্ষার্থীরা মনে করে তারা ক্লাসে পাঠ নিচ্ছেন না, বরং মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে অমৃতসুধা পান করছেন। যেকোনো দুর্বোধ্য পাঠও শিক্ষার্থীর মনে প্রবেশ করানোর কুশলী নির্দেশক হবেন শিক্ষক নামের এই জ্ঞানাধার। শিক্ষার্থীদের জীবনের যাত্রাপথ কুসুমাস্তীর্ণ করে তোলার দায়িত্ব তো শিক্ষকেরই, তার অবদানের পুষ্পবৃষ্টি পাঠের আঙিনা ছাড়িয়ে শিক্ষার্থীর জীবনের নানাদিক সুরভিত করে তুলবার দায়িত্ব একজন মহান শিক্ষকের - এ দায়িত্বের কথা বিস্মৃত হলে চলবে না। শিক্ষা শুধু পরীক্ষা পাশের একটা সনদপত্র নয়, বরং সুষ্ঠু, সুন্দর জীবনের জন্যই শিক্ষা – এ ধারণা শিক্ষক তার শিক্ষার্থীদের মনে প্রবেশ করিয়ে দেবেন শক্তভাবে। একজন মেধাজীবী শিক্ষকের ব্যক্তিত্ব শিক্ষার্থীদের জন্য অবশ্যই অনুকরণীয় এবং অনুসরণীয় হতে হবে এবং তিনি হবেন এমন পুষ্পিত মহীরুহ যার ছায়ায় পূর্ণরূপে বিকশিত হবে শিক্ষার্থীর জীবন, যার সৌরভে বিমোহিত হবে চারিদিক, যার নির্ভয় আশ্রয় নিশ্চিত করবে প্রজন্মের সুখময় জীবন গঠন।
খুব স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে, শুধু একজন শিক্ষকের কাঁধেই এত দায়, তবে শিক্ষার্থীদের এবং সরকারের দায় কি কোনো দায় নেই? একজন মেধাজীবীশিক্ষক কতটুকু মর্যাদা পাবার যোগ্য? এর সংক্ষিপ্ত জবাবে দিল্লীর বাদশাহ আলমগীরের শিক্ষকের প্রতি সম্মানবোধ সম্পর্কে কবি কাজী কাদের নেওয়াজ এর লেখা ‘শিক্ষকের মর্যাদা’ কবিতার শেষাংশের কয়েকটি চরণ স্মরণ করা যেতে পারে –‘সেদিন প্রভাতে/ দেখিলাম আমি দাঁড়ায়ে তফাতে/নিজ হাতে যবে চরণ আপনি করেন প্রক্ষালণ/ পুত্র আমার জল ঢালি শুধু ভিজাইছে ও চরণ/ নিজ হাতখানি আপনার পায়ে বুলাইয়া সযতনে /ধুয়ে দিল না’ক কেন সে চরণ,স্মরি ব্যাথা পাই মনে।’ এ তো গেলো শিক্ষকের প্রতি শিক্ষার্থীদের সম্মান প্রদর্শনের উদাহরণ, রাষ্ট্রের কী দায়িত্ব আছে মহান শিক্ষকদের প্রতি? এ প্রশ্নের জবাবও আরো সংক্ষিপ্ত আকারে দেয়া যায়। রাষ্ট্রের উচিত শিক্ষককে এমন বেতন এবং সুযোগ-সুবিধা দেয়া যাতে তাকে নিজের এবং তার পরিবারের ভরণপোষণের প্রয়োজনীয় অর্থের জন্য অন্যদিকে নজর দিতে না হয়। তিনি যেনো অত্যন্ত নিবিষ্ট চিত্তে তার দায়দায়িত্বের প্রতি মনোযোগ দিতে পারেন, পাঠদানে অধিক যত্নবান হতে পারেন এবং শিক্ষার্থীদের সঠিক পথে পরিচালনা করতে পারেন। তবেই একজন মেধাজীবী শিক্ষকের জীবন সার্থক ও সুন্দর হবে এবং তার প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে রাষ্ট্রে সুনাগরিক গড়ে উঠবে।
লেখক: যুগ্মপরিচালক, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়।