মেধার বিকাশ ঘটানোর সুযোগ দেয় না বিশ্ববিদ্যালয়গুলো - দৈনিকশিক্ষা

মেধার বিকাশ ঘটানোর সুযোগ দেয় না বিশ্ববিদ্যালয়গুলো

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

আমার কাছে সিমপ্লি মনে হয়, বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এবং এদের ভবিষ্যৎ নিয়ে তেমন কোনো গবেষণা নেই, নেই সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা! এ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কীভাবে এগোবে, রাষ্ট্রের অর্থনীতিতে বা রাজনৈতিক বিনির্মাণে এগুলোর কোন ধরনের অবদান থাকা উচিত, এগুলো নিয়ে আদৌ কেউ ভাবেন কিনা সন্দেহ আছে! যাদের নিয়ে রাষ্ট্র নিজে কোনো গভীর পরিকল্পনা করে তার বাস্তবায়নে উদ্যোগী হয় না, তখন তার থেকে কোনো ইতিবাচক ফলাফল আসবে, এমনটা আশা করাই অনুচিত। বিদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যায়ন করে আমার কাছে মনে হয়েছে, এ দেশের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এক ধরনের লস প্রজেক্ট বা সরকারি অর্থের অপচয়। সত্যি কথা বলতে গেলে, বুয়েট আর ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া এ দেশের জিডিপিতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর খুব উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নেই। অথবা ভূমিকা রাখার জন্য কোনো চেষ্টা সরকারের পক্ষ থেকে তেমন একটা দেখা যায় না। রোববার (২৮ মে) বণিক বার্তা পত্রিকায় প্রকাশিত সম্পাদকীয়তে এ তথ্য জানা যায়।

সম্পাদকীয়তে আরও জানা যায়, সাধারণ পাঠকের উদ্দেশে জানাচ্ছি যে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় আর কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় শুধু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই নয়, বরং জিডিপির এক বড় পার্টনার। এরা বছরে বিলিয়ন পাউন্ডের অর্থনৈতিক অর্জনের মাধ্যমে তাদের দেশের ক্রমবর্ধমান জিডিপি ধরে রাখতে সাহায্য করে। শুধু অক্সফোর্ড আর কেমব্রিজ নয়, বরং কিউএস রÅাংকিংয়ে থাকা বিশ্বের প্রথম ২০০-এর মধ্যে থাকা বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাদের অর্থনীতিতে বিশাল অংকের উপার্জন যোগ করে। কীভাবে করে, সেটা এখন বলছি। বিশ্ববিদ্যালয়ের এ উপার্জনের বড় অংক আসে তাদের সায়েন্স ফ্যাকাল্টিগুলো থেকে। বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়ের শিক্ষকরা যেমন ইঞ্জিনিয়ারিং, আইটি, বায়োমেডিকেল সায়েন্স, লাইফসায়েন্স, মেডিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং, ফার্মেসি, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং, কেমিস্ট্রি, ফিজিকস বিভাগের শিক্ষকরা দিন-রাত গবেষণার মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের বৈজ্ঞানিক উদ্ভাবন করে চলেছেন। এগুলোর পেটেন্টের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা, তাদের প্রতিষ্ঠান এবং তাদের অধীন গবেষক সবাই একাডেমিক্যালি ও অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা তাদের উদ্ভাবনী আবিষ্কারগুলো দিয়ে নিজেরাই বিভিন্ন কোম্পানি খুলে ফেলেন। সেই কোম্পানিগুলো বাণিজ্যিকভাবে ওই আবিষ্কারগুলো জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে নিয়ে আসে এবং মিলিয়ন ডলারের মুনাফা তুলে নেয়। তখন বাজারে থাকা অন্যান্য বাণিজ্যিক কোম্পানি কোটি কোটি টাকা দিয়ে তাদের পেটেন্টগুলো আবার কিনে নেয়। এভাবে তারা একাধিকবার বিশাল অংকের মুনাফা তুলে নেয়। তাদের লাভের একটা অংশ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যেমন পায়, তেমনি জাতীয় অর্থনীতিতে যোগ হয়। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এমন উপার্জন ভাগ-বাটোয়ারা করে পকেটস্থ করে না, বরং এ উপার্জনগুলোকে রিসাইক্লিং করে নতুন নতুন গবেষণালব্ধ প্রজেক্ট চালু করে; যেখানে তারা দেশ-বিদেশের মেধাবীদের বৃত্তি দিয়ে গবেষণার সুযোগ তৈরি করে দেয়। 

আমি বর্তমানে যে বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চতর শিক্ষায় অধ্যয়নরত আছি, সেখানে সায়েন্সের বিভিন্ন সাবজেক্টের পিএইচডি বা পোস্টডক গবেষকদের কাছ থেকে শুনি যে তারা এবং তাদের সুপারভাইজার প্রফেসররা প্রায় বিভিন্ন কোম্পানির সঙ্গে মিটিং করেন। না, তাদের কোম্পানিগুলোর পেছনে ছুটতে হয় না, বরং কোম্পানিগুলো গবেষক, বিজ্ঞানী বা শিক্ষকদের অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে বসে থাকে নতুন নতুন উদ্ভাবনের ওপর বাণিজ্যিক চুক্তি করার জন্য। আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা  

করোনাকালীন বিভিন্ন করোনা উপসর্গ পরীক্ষার উপকরণ তৈরি করে আর ওষুধ বাজারে এনে আর্থিকভাবে সংশ্লিষ্ট দেশের জিডিপিতে অবদান রেখেছে। বিভিন্ন ক্যান্সারের নিরাময় ওষুধ তৈরির মাধ্যমে এদের যে উপার্জন হয় তা আমাদের চিন্তারও বাইরে। উন্নত বিশ্বের প্রথম সারির বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় প্রায় সবখানে এমন চর্চা দেখা যায়। উন্নত বিশ্বে দেশের বিজ্ঞান, প্রযুক্তি আর অর্থনীতিতে সবচেয়ে বেশি অবদান রাখে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আর গবেষকরা। পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন দেশী-বিদেশী নামকরা প্রতিষ্ঠানে চাকরি দেয়ার জন্য তাদের গ্র্যাজুয়েশন শেষ হওয়ার আগেই কোম্পানির হিউম্যান রিসোর্স ডিপার্টমেন্টগুলো এসে নিজ উদ্যোগে জব ফেয়ার করে, তাদের কোম্পানিতে চাকরির সুযোগ করে দেয়। এসব নব্য গ্র্যাজুয়েটও তাদের মেধা আর উদ্ভাবনী ক্ষমতা দিয়ে চাকরিদাতা কোম্পানিগুলোর উন্নয়নে বিরাট অবদান রাখেন। এভাবেই তাদের দেশ ও দেশের প্রতিষ্ঠানগুলো এগিয়ে চলে, উন্নত হয়।

অথচ আমরা চলছি উল্টো পথে! আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো যেন বেকারত্ব তৈরির কারখানা। বিশ্ববিদ্যালয়, শিক্ষা বা উচ্চশিক্ষা নিয়ে আমাদের কোনো সুচিন্তিত আর দীর্ঘস্থায়ী পরিকল্পনা নেই। আমাদের সবকিছুই লোক দেখানো। আমাদের তথাকথিত শিক্ষার মান, সাক্ষরতার হার, উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠানগুলোর সংখ্যা শুধুই কিছু কাগুজে পরিসংখ্যান মাত্র। কোনো যৌক্তিক কারণ ছাড়া শুধু রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য আমরা জেলায় জেলায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বানানোর প্রজেক্ট বাস্তবায়ন করে যাচ্ছি। যেখানে ভালো স্কুল-কলেজ নেই, সেখানে তথাকথিত বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি করে, অবকাঠামো নির্মাণের বরাদ্দ তছরুপ করা আর নিয়োগ বাণিজ্যের বাইরে বেশি কিছু হচ্ছে বলে মনে হয় না। এসব প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞানের উৎকর্ষ সাধনের কোনো চেষ্টা আছে বলে খুব একটা দৃশ্যমান হয় না। সেখানে না আছে ভালো গবেষক, না আছে উপযুক্ত অবকাঠামো। মেধাবীদের মেধার বিকাশ ঘটানোর সুযোগ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দেয় না। শিক্ষক রাজনীতি, ছাত্ররাজনীতি আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর বিকাশের ক্ষেত্রে অন্তরায় হয়ে দাঁড়াচ্ছে। কিছু শিক্ষক প্রতিষ্ঠানে রাজনীতির অযাচিত চর্চা করে চলেছেন শুধু তাদের পার্সোনাল ক্যারিয়ার তৈরির জন্য। বিশ্ববিদ্যালয়ের যাবতীয় নিয়োগ আজ রাজনৈতিক হওয়ার কারণে গবেষকদের মান কমেছে, কমেছে চর্চা। অপ্রয়োজনীয় আর অতিরিক্ত বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি করে, বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণার জন্য একদিকে তেমন বরাদ্দ হয় না; তেমনি যা বরাদ্দ হয় তারও যথাযথ বাস্তবায়ন হয় না। আসে না কাঙ্ক্ষিত সাফল্য। দেশের জিডিপিতে যোগ হয় না বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্যক্ষ অবদান বা উপার্জন।

মোটা দাগে এ দেশের সরকারগুলো জাতীয় প্রবৃদ্ধির জন্য শুধু বিদেশে জনবল পাঠানো আর পোশাক শিল্পের মুনাফার ওপর নির্ভর করে। কিন্তু এগুলোর বাইরেও যে অসংখ্য খাত থেকে উপার্জন করা সম্ভব, সেদিকে সরকারগুলোর তেমন নজর থাকে না। আসলে সুচিন্তিত পরিকল্পনা নিয়ে সরকারগুলো এগোয় না। নিজস্ব পলিটিক্যাল এজেন্ডার বাইরে এরা তেমন একটা আসতে চায় না। বাংলাদেশে মেধার অভাব ছিল না; কিন্তু অভাব ছিল মেধার সদ্ব্যবহারের। মেধাবীদের রাজনৈতিক ট্যাগ দিয়ে, ধামাধরা আর ব্যক্তিত্বহীনদের মতামত নিয়ে পরিকল্পনা তৈরি করলে তা দেশের কোনো কাজে লাগবে না; বরং অপচয় হবে সরকারি অর্থের। আমাদের আসলে দেশপ্রেম নেই, জবাবদিহিতা নেই; আমাদের আছে পেশাদারিত্বের সাংঘাতিক ঘাটতি। আমরা জাতীয় আয়ের নতুন নতুন খাত আসলে তৈরিই করতে পারিনি বা চাইনি। সোজা পথে অল্প আয়েই আমরা সন্তুষ্ট ছিলাম। মেধা খাটিয়ে বড় পরিসরের উপার্জনের পথগুলো আমরা এড়িয়ে গেছি বারবার।

লেখক : এম আর ইসলাম, শিক্ষক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

চট্টগ্রামে সংঘর্ষে শিক্ষার্থীসহ নিহত ২ - dainik shiksha চট্টগ্রামে সংঘর্ষে শিক্ষার্থীসহ নিহত ২ ঢামেকে একজনের মৃত্যু - dainik shiksha ঢামেকে একজনের মৃত্যু জবির কোটা আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ ৪ - dainik shiksha জবির কোটা আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ ৪ বেরোবিতে ত্রিমুখী সংঘর্ষে নিহত ১, আহত ২০০ - dainik shiksha বেরোবিতে ত্রিমুখী সংঘর্ষে নিহত ১, আহত ২০০ শহীদ মিনার এলাকায় অধ্যাপককে মারধর - dainik shiksha শহীদ মিনার এলাকায় অধ্যাপককে মারধর মুক্তিযোদ্ধাদের সর্বোচ্চ সম্মান দিতে হবে : প্রধানমন্ত্রী - dainik shiksha মুক্তিযোদ্ধাদের সর্বোচ্চ সম্মান দিতে হবে : প্রধানমন্ত্রী সময়মতো যথাযথ অ্যাকশন নেয়া হবে : কাদের - dainik shiksha সময়মতো যথাযথ অ্যাকশন নেয়া হবে : কাদের সবকিছু আমাদের নিয়ন্ত্রণে নেই: ঢাবি উপাচার্য - dainik shiksha সবকিছু আমাদের নিয়ন্ত্রণে নেই: ঢাবি উপাচার্য যারা নিজেদের রাজাকার বলেছে তাদের শেষ দেখে ছাড়বো - dainik shiksha যারা নিজেদের রাজাকার বলেছে তাদের শেষ দেখে ছাড়বো সায়েন্সল্যাবে কলেজ শিক্ষার্থীদের অবরোধ, যান চলাচল বন্ধ - dainik shiksha সায়েন্সল্যাবে কলেজ শিক্ষার্থীদের অবরোধ, যান চলাচল বন্ধ র‌্যাঙ্কিংয়ে এগিয়ে থাকা কলেজগুলোর নাম এক নজরে - dainik shiksha র‌্যাঙ্কিংয়ে এগিয়ে থাকা কলেজগুলোর নাম এক নজরে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0064091682434082