রাজনীতিতে ধর্মের সমন্বয় ও শুভতত্ত্ব - দৈনিকশিক্ষা

রাজনীতিতে ধর্মের সমন্বয় ও শুভতত্ত্ব

রেজা সেলিম |

২০১৯ খ্রিষ্টাব্দের প্রথম দিকে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের অনুসারী নিবেদিতপ্রাণ দুই তরুণ রাজনৈতিক কর্মী এনামুল হক প্রিন্স ও সায়েম খানের সঙ্গে বর্তমান বাস্তবতায় রাজনীতিতে ধর্মের সমন্বয় নিয়ে আমার আলাপ হয়। যদিও এই আলাপ আলাদাভাবে ও আলাদা সময়ে হয়েছে। কিন্তু দুইজনই আমাকে একই স্বরে জানালো, বাংলাদেশের রাজনীতিতে যেভাবে ধর্ম সমন্বয় হচ্ছে তা কোনো লক্ষ্যে পৌঁছুতে পারছে না ও পারবে না বলেই তাদের সন্দেহ। তাদের কাছে এর কারণ কী মনে হয় বুঝতে চাইলে দুজনই আমাকে একই উত্তর দিয়েছে, ‘বাঙালির মন-মানসে ধর্ম আবেগের ও সংস্কৃতির, আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো মনে হয় তা বুঝতে পারছে না’। 

সাহিত্য ও ইতিহাসের ছাত্র হিসেবে আমি এক বাক্যে এই দুজন প্রতিশ্রুতিশীল রাজনৈতিক কর্মীর সন্দেহ-অনুভূতি স্বীকার করে নিলাম। কারণ, কিংকর্তব্যবিমূঢ় মানুষ একদিন লক্ষ্য করলো, মানবের জন্যে হিতকর সব ধর্মের অনুসারীদের মধ্যে ধর্ম পালন নিয়ে হঠাৎ কেউ কেউ ‘পারফেকশনিস্ট’ হবার চেষ্টা করছে। আর তাতে বিশেষ বিপদে পড়েছে বাঙালি জনগোষ্ঠী, কারণ এদের কাছে ধর্ম হলো ‘ধৃ ধাতুর সাথে মৎ প্রত্যয় যোগে” নিজের সকল কর্ম সম্পাদন করা। ফলে বাঙালির কাছে সব চিন্তার বহিঃপ্রকাশ ঘটে ধ্যানে ও জ্ঞানে। সংস্কৃত ধৃ-ধাতু থেকে ধর্ম শব্দের উৎপত্তি। (ধৃ+মন= ধর্ম); ধৃ-ধাতুর অর্থ হল ধারণ করা। যা মানুষকে ধারণ করে রাখে তাই ধর্ম। মৎ (মতুপ) বাংলা ব্যাকরণে ব্যবহৃত তদ্ধিত প্রত্যয় বিশেষ, এর মানে হলো ‘আমি’ (সর্বনাম পদ)। অর্থাৎ আমার কাজই আমার ধর্ম। সে কাজ আমি ‘নির্দেশিত’ হয়ে যদি করি তাহলে তা অন্তরাত্মা নির্দেশিত হয়েই হবে, এই জ্ঞান ব্যাঞ্জনার দর্শন বুঝাতে কাঙাল হয়ে অভিমানী বাঙালির মন বিচ্ছেদী হলো, ঠাঁই নিলো সে সুরের ভূবনে।

ইতিহাস সূত্রে দুনিয়ার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও শেষ ধর্মের প্রবর্তনের বয়স এখন দেড় হাজার বছরের মতো। অন্যগুলো আরও আগের। কিন্তু বাঙালি এই শেষ ধর্ম ইসলাম হাতে পেয়েছে সাত-আটশো বছর আগে। এই ধর্মের যে উদার মানবতাবাদ তা আয়ত্ত্বে নিতে বাঙালির কোন সময় লাগেনি। কারণ এই অঞ্চলের মানুষের ভাবাবেগে চিরকালই অবিনশ্বর প্রেম ও মানবতাবাদ অঙ্গীভূত হয়ে ছিলো। ফলে ধর্মের সাথে এদের জন মানসে কোন বিরোধ ছিল না অন্তত ব্রিটিশদের কুচক্রী বুদ্ধি দেবার আগ পর্যন্ত। বাঙালি প্রথম সে ফাঁদে পড়েছে ব্রিটিশের রাজনৈতিক কূটচালে, ধর্মকে সে হানাহানির রাজনীতির মধ্যে নিয়ে নিলো, আর তা থেকে আমরা বের হয়ে আসতে পারছি না বলেই এনামুল হক প্রিন্স ও সায়েম খানের সন্দেহ, “এটা কেউ বুঝতে পারছে না”। 

আমারও একই প্রশ্ন, কয়েক হাজার বছর পরে আমরা সবাই মিলে ধর্মকে নিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়লাম কেনো? এতো ওয়াজ মাহফিল আর তর্জন-গর্জন কেনো? কেনো সামান্য চিন্তার বিরোধে অপরকে খুন করে ফেলতে হবে? সাত-আটশো বছর আগে তো আমি অন্য চিন্তা ও মতের মানুষই ছিলাম? আমি যখন সর্বশেষ ধর্মের চিন্তায় নিজেকে সমর্পণ করেছি তখন তো আমাকে কেউ মেরে ফেলতে আসেনি, আমিও কাউকে মেরে ফেলিনি। তাহলে এখন কেনো?

বাংলাদেশের রাজনীতিতে এই দ্বিমতের চিন্তার বিরোধ ক্রমান্বয়ে আক্রোশী ও অন্তর্ঘাতি হয়েছে এ নিয়ে কোনই সন্দেহ নেই। কিন্তু আমরা ধর্ম প্রচারে সর্বদা আমাদের করণীয় ঠিক করেছিলাম সংস্কৃতি চর্চাকে। সুরের মোহময় অন্তর্জালে আমরা যে জগত তৈরি করেছি তাতে সৃষ্টি ও স্রষ্টার বন্দনাই মূখ্য। ভারতীয় সংস্কৃতির মৌলিক প্রভাব পড়েছে আমাদের প্রতি, আমরা জীবনের সব দুঃখকষ্টকে তাঁর কাছে সমর্পণ করি, তিনি আমাদের সব অভিমান বুঝেন, তাঁর অনুপস্থিতি আমাদের পীড়া দেয়, আমরা তাঁর কাছে যেতে চাই। এই বিরহ বেদনা ও বিচ্ছেদের যন্ত্রণাই বাঙালির মানস ধর্ম, এর সাথে রাজনীতির ইতিহাসের কোন বিরোধ নেই।

কিন্তু এখন দেশে দেশে নানা তরীকা হাজির করা হচ্ছে, অমুক পণ্ডিত তমুক পণ্ডিত পিস টিভি আর ইউটিউব চ্যানেল খুলে বসেছেন, বলছেন এই করতে হবে ওই করতে হবে। আর তাতে আমরা সায় না দিলে আমাদের মেরে ফেলার চেষ্টা চলবে এটা কোন ধর্মের বিধান? আমিইবা তাতে সায় দেবো কেন? আমি আমার স্রষ্টাকে কাছে পেতে চাই আমার মানস জগতে এতে ধর্মের সাথে বিরোধটা কোথায়? চর্চায়? সেটা তো আমি করতেই পারি। কিন্তু তা নিশ্চয়ই লোক দেখাতে নয় বা মানবসেবার কর্তব্য থেকে বিচ্যুত হয়ে নয়!

এই যে ধর্মের মূলমন্ত্রগুলো গ্রাম বাংলায় প্রচার হয়েছে তার প্রধান ধারক ও বাহক হলেন গাতক সমাজ ও আমাদের বাউল চিন্তার মহাপুরুষেরা। সঙ্গীতে ও চর্চায় এই দেশে ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ ও লালন ফকিরের জন্ম হলো কেমন করে? আমাদের মনন ও তার আবেদনে সুরের যে প্রভাব ইতিহাসবিদেরা বলেন সে কারণেই ধর্মের বাণীর প্রসার ঘটেছে খুব দ্রুত ও তা আজও বিরাজমান। রাজন্যবর্গের কেউ ধর্ম প্রচার করেছেন এমন তথ্য নেই, যা আছে তা হল পৃষ্ঠপোষকতা। প্রচারের কাজটা করেছেন সুরের ও বাণীর যাদুকরেরাই।

আজ থেকে তিন-চারশো বছর আগে ঢাকার অদূরে (বর্তমান কেরানীগঞ্জের বামনশুর গ্রামে) বসতি গড়েন ধর্মসাধক আলফু দেওয়ান পরিবার। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগরে খাঁ সাহেবের পরিবার। সিলেটে শাহজালাল, চট্টগ্রামে মাইজভান্ডার ও বাগেরহাটে খান জাহান আলী, এরকম কয়েকশত সাধক-গাতক এই দেশের মানুষের প্রাণ নিয়ে গান করেছেন আর বাণী গড়েছেন ধর্মদর্শনের আদলে। বাঙালি সেটা অপত্য মায়ায় গ্রহণ করেছে। কারণ ধর্মের বাণী তাঁদের জীবন চর্চা ও উৎপাদন সংস্কৃতির সাথে মিলে মিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল। তাঁদের মনে যে বিচ্ছেদবোধ তা তাঁর সৃষ্টিকর্তাকে খুঁজে পেতেই, জীবনের সুখ দুঃখ ও হাসিকান্নার সম্মিলনে।

কেউ যদি এখন অনুসন্ধান করেন তাহলে এই সময়ের রাজনীতির ধর্ম সমন্বয়ের হাস্যকর প্রচেষ্টা দেখে বিরক্তই হবেন। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হল আমরা কেউ তার বিরাজমান সরূপ অনুভব-অনুসন্ধান করি না কারণ আমরা সঙ্গীতকে সাধনায় না রেখে বাণিজ্য চিন্তার মধ্যে তুলে নিয়েছি। কিন্তু মানবসেবার অনন্য উদাহরণ এখনও এই ধর্ম ও গায়কী চিন্তায় মিলে মিশে আছে সে অনুসন্ধান জরুরী। তাহলে অন্তত ওই দু’জন তরুণ কর্মীর মতো ‘কেউ বুঝতে পারছে না’ এমন সন্দেহের অবসান হবে, আর তা হওয়া জরুরী।

দেওয়ান বাড়ির একজন বিদ্বান সাধক গায়ক আরিফ দেওয়ান মনে করেন, “সঙ্গীত হল আত্মমোহিনী শক্তিসসমৃদ্ধ একটি বিদ্যা, এই বিদ্যা যে ধারণ করে সে মানুষের দেহকে স্পর্শ করে না, মানুষের হৃদয়কে স্পর্শ করতে পারে। সঙ্গীত মানুষের হৃদয়কে যেভাবে নাড়া দেয় এটা পৃথিবীতে আর কোনো মাধ্যম নাই এতো দ্রুত করতে পারে”। 

দেওয়ান বাড়ির সঙ্গীত এখন পাঁচ পুরুষের একটি ঘরাণায় পরিণত হয়েছে যেমন হয়েছে আলাউদ্দিন খাঁ পরিবারের, উপমহাদেশ জুড়ে তাঁদের সুরচর্চার শক্তিমত্তার প্রভাবও পড়েছে অসীম। ভক্তের হৃদয়ের সাথে মানব কল্যাণের আদর্শ প্রচারের দর্শন এক হয়েছে বলেই এই শক্তি কোণঠাসা বটে, তবে তার কোনো ক্ষয় বা বিচ্যুতি নেই। অপরদিকে রাজনীতির সঙ্কীর্ণ চিন্তা আমাদের নানারকম ভাব দর্শনে বাধ্য করছে। কিন্তু আমরা ‘বুঝতে পারছি না’ আমাদের ভুলটা হচ্ছে কোথায়!

বঙ্গবন্ধু তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনীর নানা স্থানে কর্মীদের বা অনুসারীদের ‘ভক্ত’ বলে উল্লেখ করেছেন। ভক্ত কার হয়? যিনি ভক্তি অর্জন করেন। বঙ্গবন্ধুর মতো দেশ ও মানব সেবায় নিবেদিত মানুষেরাই সে ভক্তি অর্জন করতে পারেন; কারণ তিনি গ্রাম-বাংলার মাটির মানুষ হিসেবে উপলব্ধি করেছিলেন মুক্তির সেবাই তাঁর মহান ধর্ম। 

দেওয়ান বাড়ির অন্যতম সাধক ছিলেন খালেক দেওয়ান, যাকে ‘ভাবসম্রাট’ বলে সম্মান দেয়া হয়েছিল, আজ থেকে কয়েক যুগ আগে তিনি লিখেছিলেন- “জাতির কারণে গড় শান্তি নিকেতন, ফুল হয়ে ফুটে কর গন্ধ বিতরণ। সাধ্য যাহা কর তাহা গরীবেরে দান, ছোটকে করিবে স্নেহ বড়কে সম্মান। সৎসঙ্গে করিবে সদা কুসঙ্গ বর্জন, গর্ব অহংকার ছাড়িয়া কও বিনয় বচন। সুবিদ্যা শিখিতে করে উৎসাহ যে দান, সেই সে মানুষ বটে কয় খালেক দেওয়ান”।

এই যে মানুষ হয়ে সেবার যে রাজনৈতিক ব্রত বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা প্রমাণ করছেন আমাদের তা অনুসরণ করতে হবে। ধর্ম আপনা থেকেই এই দেশের মানুষের মনে সমন্বিত, একে আলাদা করে দেখভাল করার কিছু নেই। কালান্তরে এই ‘শুভতত্ত্ব’ আমাদের মানুষের জগতে মহান হলে সৃষ্টি নিজে থেকে ধন্য হবে, আর সে ‘কল্যাণব্রত’ আমাদের রাজনীতিতে মুখ্য হয়ে থাকা দরকার। 

লেখক: পরিচালক, আমাদের গ্রাম প্রকল্প

 

শিক্ষার সব খবর সবার আগে জানতে দৈনিক শিক্ষাডটকমের ইউটিউব চ্যানেলের সঙ্গেই থাকুন। ভিডিওগুলো মিস করতে না চাইলে এখনই দৈনিক শিক্ষাডটকমের ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন এবং বেল বাটন ক্লিক করুন। বেল বাটন ক্লিক করার ফলে আপনার স্মার্ট ফোন বা কম্পিউটারে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ভিডিওগুলোর নোটিফিকেশন পৌঁছে যাবে।

দৈনিক শিক্ষাডটকমের ইউটিউব চ্যানেল   SUBSCRIBE  করতে ক্লিক করুন।

চট্টগ্রামে সংঘর্ষে শিক্ষার্থীসহ নিহত ২ - dainik shiksha চট্টগ্রামে সংঘর্ষে শিক্ষার্থীসহ নিহত ২ ঢামেকে একজনের মৃত্যু - dainik shiksha ঢামেকে একজনের মৃত্যু জবির কোটা আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ ৪ - dainik shiksha জবির কোটা আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ ৪ বেরোবিতে ত্রিমুখী সংঘর্ষে নিহত ১, আহত ২০০ - dainik shiksha বেরোবিতে ত্রিমুখী সংঘর্ষে নিহত ১, আহত ২০০ শহীদ মিনার এলাকায় অধ্যাপককে মারধর - dainik shiksha শহীদ মিনার এলাকায় অধ্যাপককে মারধর মুক্তিযোদ্ধাদের সর্বোচ্চ সম্মান দিতে হবে : প্রধানমন্ত্রী - dainik shiksha মুক্তিযোদ্ধাদের সর্বোচ্চ সম্মান দিতে হবে : প্রধানমন্ত্রী সময়মতো যথাযথ অ্যাকশন নেয়া হবে : কাদের - dainik shiksha সময়মতো যথাযথ অ্যাকশন নেয়া হবে : কাদের সবকিছু আমাদের নিয়ন্ত্রণে নেই: ঢাবি উপাচার্য - dainik shiksha সবকিছু আমাদের নিয়ন্ত্রণে নেই: ঢাবি উপাচার্য যারা নিজেদের রাজাকার বলেছে তাদের শেষ দেখে ছাড়বো - dainik shiksha যারা নিজেদের রাজাকার বলেছে তাদের শেষ দেখে ছাড়বো সায়েন্সল্যাবে কলেজ শিক্ষার্থীদের অবরোধ, যান চলাচল বন্ধ - dainik shiksha সায়েন্সল্যাবে কলেজ শিক্ষার্থীদের অবরোধ, যান চলাচল বন্ধ র‌্যাঙ্কিংয়ে এগিয়ে থাকা কলেজগুলোর নাম এক নজরে - dainik shiksha র‌্যাঙ্কিংয়ে এগিয়ে থাকা কলেজগুলোর নাম এক নজরে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0053958892822266