শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায় দেশজুড়ে শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালিত হয়েছে গতকাল মঙ্গলবার। প্রতি বছরের মতো এবারও দিবসটি যথাযোগ্য মর্যাদায় পালন করেছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি) প্রশাসন। কিন্তু দিবসটিকে ঘিরে শহীদ মিনারে শ্রদ্ধাঞ্জলি দেওয়ার ক্ষেত্রে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ ছিল না আশানারূপ। হলগুলোতে শুধু প্রাধ্যক্ষ ও কর্মকর্তা-কর্মচারীরা শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন। বিভাগগুলোতেও শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাতে অংশগ্রহণ ছিল কম। আবাসিক হল ও বিভাগ বাদে বিভিন্ন সংগঠনের ব্যানারে দিবসটির কর্মসূচিতেও শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি ছিল না উল্লেখযোগ্যসংখ্যক।
বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যেষ্ঠ অধ্যাপকরা বলছেন, শিক্ষার অনিবার্য অঙ্গগুলোর মধ্যে স্বদেশপ্রেম অন্যতম। বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সবাই তো শিক্ষিত ও সচেতন। দেশের মুক্তির সংগ্রাম ও ভাষাশহীদদের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ থাকা দরকার। কিন্তু শিক্ষার্থীরা জাতীয় চেতনাবোধ থেকে দূরে সরে যাচ্ছেন। তাদের জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ হওয়া উচিত।
সরেজমিনে দেখা যায়, গতকাল শহীদ দিবসের কর্মসূচিতে রাবির আবাসিক হলগুলো থেকে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি ছিল খুবই কম। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি ছিল না। শুধু হলের প্রাধ্যক্ষ, আবাসিক শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীরা উপস্থিত থেকে শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ করেন। মাদার বক্স হলে ছিলেন দুই-তনিজন শিক্ষার্থী। মতিহার হলে শিক্ষার্থী ছিল না। শুধু প্রাধ্যক্ষ ও কর্মকর্তারা ছিলেন। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী হলে ছিল মাত্র ১০ জন শিক্ষার্থী। অন্যান্য হলেও একই চিত্র দেখা যায়। তবে নারীদের হলের চিত্র ছিল ভিন্ন। তাদের প্রতিটি হল থেকে ৮০ থেকে ১২০ জন শিক্ষার্থী উপস্থিত ছিলেন। বিভাগগুলোর কর্মসূচিতে শিক্ষার্থীর অনুপাতে উপস্থিতি ছিল কম। যেসব বিভাগে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৫০০ থেকে ৬০০, সেখানে ১০০ থেকে ১৫০ শিক্ষার্থী উপস্থিত ছিলেন। শিক্ষকদের ক্ষেত্রেও উপস্থিতি ছিল নগণ্য। কোনো বিভাগে ৫ থেকে ১০ জনের বেশি শিক্ষকের উপস্থিতি দেখা যায়নি।
আবাসিক হলের প্রাধ্যক্ষ ও বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষকরা বলছেন, জাতীয় দিবসগুলো কর্মসূচি জানাতে সব সময় একাধিক স্থানে বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়। যাতে হলের শিক্ষার্থীরা একসঙ্গে সেখানে অংশগ্রহণ করতে পারেন। কিন্তু শিক্ষার্থীরা তেমন একটা আসেন না।
এ প্রসঙ্গে শহীদ হবিবুর রহমান হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক শরিফুল ইসলাম বলেন, ‘এটা খুবই দুঃখজনক। নোটিস দেওয়ার পরও শিক্ষার্থীরা হলের হয়ে কোনো জাতীয় দিবসে শ্রদ্ধাঞ্জালি দিতে যায় না। তবে হলের হয়ে না গেলেও বিভাগ বা অন্য সংগঠনের হয়ে যান। কিন্তু তার সংখ্যাটাও খুবই কম। দেশপ্রেম একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আমাকে নোটিস দিয়ে বলতে হবে কেন? আমি আমার নিজের জায়গা থেকে যাব। যাদের রক্তের বিনিময়ে আজ আমরা বাংলা ভাষায় কথা বলতে পারছি তাদের ন্যূনতম শ্রদ্ধাটুকু জানানো উচিত।’
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে রাবির গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী আসিফ আজাদ সিয়াম বলেন, ‘স্বেচ্ছায় অংশগ্রহণের পরিমাণটা কমে যাচ্ছে। আমরা ভাষা আন্দোলন দেখিনি, মুক্তিযুদ্ধ দেখিনি। পরোক্ষভাবে শুনে এসেছি। এভাবে চলতে থাকলে হয়তো ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ কালের বিবর্তনে একসময় এই জাতি সব ভুলে যাবে। আমাদের উচিত দিবসগুলোতে অংশগ্রহণ করা। যাতে আমরাও যেন পরোক্ষভাবে পরবর্তী প্রজন্মকে জানাতে পারি।’ এ বিষয়ে রাবির ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক আবুল কাশেম বলেন, ‘দেশপ্রেমের জায়গাটা শুধু শিক্ষার্থীদের ওপর চাপিয়ে দিলে হবে না। সব পর্যায়ের মানুষের মধ্যে এই ঘাটতিটা আছে। এটাকে দেশপ্রেমের ঘটতির প্যারামিটারে না দেখে সব সেক্টরের প্রতিনিধিরা আসছে কি না, সেটা দেখতে হবে। সবাই এলে তো আর জায়গা দেওয়া যাবে না। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের সবাই তো শিক্ষিত ও সচেতন। তাদের জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ হওয়া উচিত। দেশের সংগ্রাম কিংবা মুক্তির সংগ্রাম এবং ভাষাশহীদদের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ থাকা দরকার।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগের অধ্যাপক আতাউর রাহমান রাজু বলেন, ‘শিক্ষার অনিবার্য অঙ্গগুলোর মধ্যে স্বদেশপ্রেম একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। স্বদেশের প্রতি মমতা ও শ্রদ্ধা রেখে জাতীয় দিবসগুলোতে প্রত্যেক নাগরিকের স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করা দায়িত্ব। কিন্তু শিক্ষার্থীরা জাতীয় চেতনাবোধ থেকে যে দূরে সরে যাচ্ছে, এটি আসলে খুব সুখকর ব্যাপার না।’