রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে (রাবি) শিক্ষার্থীর তুলনায় আবাসিক হলগুলোতে সিটের সংখ্যা অপ্রতুল। আবার যে সংখ্যক সিট রয়েছে সেগুলো বণ্টনেও রয়েছে নানা অনিয়মের অভিযোগ। ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন ছাত্রলীগ নেতাদের সিটবাণিজ্য ও তাদের তদবির এবং শিক্ষকদের সুপারিশেই শুধু মেলে হলের সিট। শিক্ষার্থীদের হলে সিট বরাদ্দের ক্ষেত্রে বয়োজ্যেষ্ঠতা, পরীক্ষায় ভালো ফলাফল এবং পারিবারিক অবস্থার ভিত্তিতে একসময় আবাসিকতা দেওয়ার যে রীতি ছিল, সেই নিয়ম যেন এখন শুধুই ইতিহাস।
অ্যাকাডেমিক শাখা থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে বিদেশি ও সান্ধ্যকালীন মাস্টার্স কোর্সের শিক্ষার্থী ছাড়া রাবিতে নিয়মিত শিক্ষার্থী রয়েছেন ২৬ হাজার ৩১৫ জন। এর মধ্যে ছাত্র ১৬ হাজার ৯৬৯ জন। এর বিপরীতে ছাত্রদের ১১টি হলে রয়েছে ৫ হাজার ৩৮৩টি আসন। ফলে অধিকাংশ ছাত্রকে অনাবাসিক হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়সংলগ্ন এলাকাগুলোতে মেস বা বাসা ভাড়া নিয়ে থাকতে হয়।
অভিযোগ আছে, কোনো হলেই প্রতি বছর অ্যালোটমেন্টের (বরাদ্দ) বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয় না। শিক্ষার্থীরা বলছেন, ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনের নেতারা টাকার বিনিময়ে শিক্ষার্থী হলে তোলেন। পরে এসব শিক্ষার্থী হলে আবাসিকতা কার্ড করে নেন। এর ফলে যাদের প্রকৃতপক্ষে হলে সিট দরকার তারাই বঞ্চিত হয়। দিনের পর দিন প্রাধ্যক্ষের (প্রভোস্ট) কাছে ঘুরেও কোনো লাভ হয় না।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক শিক্ষার্থী বলেন, প্রায় হলেই আবাসিকতার আবেদন করতে গেলে হলের নেতাদের সুপারিশ আছে কি না তা জানতে চাওয়া হয়।
অন্যদিকে ছাত্রী হলগুলোতে সিটবাণিজ্যের অভিযোগ না থাকলেও পর্যাপ্ত আবাসন সুবিধা না থাকায় ছাত্রীদের হলগুলোতে রয়েছে গণরুম। তাদের নিরাপত্তা ও পারিবারিক অবস্থা বিবেচনা করে গণরুমে সিট দেওয়া হয়। যেখানে গাদাগাদি করে থাকেন প্রায় দেড় হাজার ছাত্রী। বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রী রয়েছেন ৯ হাজার ৩৪৬ জন। এর বিপরীতে হলে মোট সিট রয়েছে ৪ হাজার ৩৫৪টি। পর্যাপ্ত আবাসন সুবিধা না থাকায় ছাত্রীদের ছয়টি আবাসিক হলেই গণরুমের সৃষ্টি হয়েছে।
হলে সিট বরাদ্দে অনিয়মের অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে মাদার বখ্শ হলের আবাসিক শিক্ষক ও ফোকলোর বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আমিরুল ইসলাম কনক বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের হল প্রশাসন নিরুপায়। হল প্রশাসনের মাধ্যমে কাউকে বৈধ সিটে তুলে দিলে দেখা যায় পরে তাকে হুমকি, বের করে দেওয়া এমনকি মারধর করা হচ্ছে। এমনকি হল প্রশাসন এ নিয়ে কথা বলতে গেলে বিভিন্ন সময় শিক্ষক লাঞ্ছনার ঘটনাও ঘটেছে।’
এ প্রসঙ্গে বিএনপিপন্থি শিক্ষক ও সোহরাওয়ার্দী হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, ‘কিছুদিন আগে আমরা হল প্রশাসন অভিযান চালিয়ে অনাবাসিক ছাত্রদের বের করে আবাসিক ছাত্রদের আসন দিয়েছিলাম। আমার হলে বর্তমানে ১৩৭টি আসনে আবাসিক ছাত্র নেই। এসব আসনের অধিকাংশই দখল করে আছে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। এমনকি প্রতিবন্ধী ছাত্রদের সংরক্ষিত আসনও তারা অবৈধভাবে দখল করে অবস্থান করছেন। ক্ষমতাসীন ছাত্রলীগের কাছে আমরা হল প্রশাসন যেন জিম্মি হয়ে রয়েছি।’ তিনি আরও বলেন, ‘ছাত্রলীগ সিটবাণিজ্য করে আসন দখল করে আছে। এজন্য মেধাবী, অসহায় ছাত্রদের আমরা সিট দিতে পারছি না। প্রায় পাঁচ মাস আগে আমার হলে ছাত্রদের ভাইভা নিলেও তাদের সিট দিতে পারেনি।’
অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন খান বলেন, ‘আমাদের শিক্ষার্থীর তুলনায় হলে সিটসংখ্যা অনেক কম। আবার অব্যবস্থাপনার কারণে যারা প্রকৃত অর্থে সিটে ওঠার যোগ্য তারা বঞ্চিত হচ্ছে। ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে প্রায়ই হলে সিটবাণিজ্য, হল থেকে শিক্ষার্থীদের নামিয়ে দেওয়ার অভিযোগ শোনা যায়। এ নিয়ে বিভিন্ন সময় আন্দোলন, প্রতিবাদ জানানো হলেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। ফলে তারা আরও বেশি উৎসাহিত হয় এবং এমন কাজকর্ম দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।’
প্রাধ্যক্ষ পরিষদের আহ্বায়ক অধ্যাপক হাসনা হেনা দখলে থাকা সিট উদ্ধারে অপারগতা প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, ‘যে দলই ক্ষমতাই আসে তাদের ছাত্রসংগঠন কিছু সিট দখল করে রাখে। আমরা প্রশাসনের সহায়তায় সিটগুলো তাদের দখল থেকে মুক্ত করার চেষ্টা করি, কিন্তু পারি না।’
সার্বিক বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য সুলতান-উল ইসলাম বলেন, ‘বর্তমানে প্রায় ৬০ ভাগ শিক্ষার্থীকে হলের বাইরে থাকতে হচ্ছে। তবে এ সংকট কিছুটা দূর করতে দশতলা দুটি হল নির্মাণ হচ্ছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘হলে সবসময় কোনো না কোনো ঘটনা ঘটছে। প্রশাসন যদি তৎপর না হতো তবে ঘটনাগুলো স্তিমিত হতো না। সব হয়তো সমাধান করা সম্ভব হয় না। তবে প্রশাসন যদি তৎপর না হতো তবে তার থেকেও খারাপ ঘটনা ঘটতে পারত। যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে তাদের জাতীয় পর্যায়ে যারা আছে, তাদের সঙ্গে এবং সরকারকেও এসব বিষয়ে আমরা তথ্য জানিয়েছি যে, এগুলো একসময় না একসময় আমদের বন্ধ করার কঠোর পদক্ষেপ নিতেই হবে। এখন কে ক্ষতিগ্রস্ত হবে তা আমরা বুঝি না। আমরা দেখব ছাত্রদের স্বার্থ।’