মানুষ সাপকে যতোটা ভয় করে, সাপ মানুষকে তারচেয়েও বেশি ভয় পায়। মানুষের উপস্থিতি টের পেলে সাপ পালায়। গা ছমছম করা ভয় ও দ্রুত ছড়িয়ে পড়া রাসেলস ভাইপার আতঙ্কের মধ্যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রাসেলস ভাইপার সতর্কতার প্রয়োজনীয়তা আছে।
সাপ ও মানুষের পাশাপাশি অবস্থান ধর্ম, দেশ ও সমাজ বাস্তবতায় চিরন্তন সত্য। বাইবেল, কোরআনের বর্ণনায় আদম হাওয়া বা ইভ অ্যাডাম-কে শয়তানের প্রভাবিত করার কল্প কাহিনির বাহন হয় সাপ। হযরত মুসার (আ.) নবুয়তকে পাপীষ্ঠ ফিরাউন চ্যালেঞ্জ করলে, মহান আল্লাহর নির্দেশে তিনি তার হাতের লাঠি নিক্ষেপ করার পর লাঠিটি সাপে পরিণত হয়। সুরা ত্বা-হার ২০ নম্বর আয়াত ও অন্যান্য বর্ণনায় এটাও সত্য।
বর্তমানে চন্দ্রবোড়া উলুবোড়া, শিকলবোড়া নামের সাপটি রাসেলস ভাইপার ভার্সনে আপগ্রেট হয়েছে মাত্র। বাংলাদেশে প্রাপ্ত সাপের মধ্যে রাসেলস ভাইপার সবচেয়ে বিষাক্ত।
বর্তমান বিশ্বে প্রায় তিন হাজার প্রজাতির সাপের ৫০০ প্রজাতি বিষধর হলেও অন্য সবই নির্বিষ। বাংলাদেশে প্রায় ১০৪ প্রজাতির সাপের মধ্যে বিষধর ৩০টি প্রজাতি রয়েছে। নির্বিষের মধ্যে আছে- ঢোঁড়া, ঘরগিন্নি, কুকরি, মেটে, দুধরাজ, ফণীমনসা, পাইন্যা, দাঁড়াশ, অজগর। বিষধরের মধ্যে কালনাগিনি, গোখরো, পদ্মগোখরা, কিং-কোবরা, চন্দ্রবোরা বা রাসেলস ভাইপার, পাতালনাগ, ইন্দুরকুমার, লাউডুগি অন্যতম।
মহান আল্লাহ কোনো কিছুই অনর্থক সৃষ্টি করেননি। সাপও মহান আল্লাহরই সৃষ্টি এবং তারই অনুগত। ঔষধের কাঁচামালের যোগান, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা, ফসল রক্ষা, ক্ষতিকর পোকামাকড় দমন ইত্যাদি উপায়ে সাপ মানষের কল্যাণকর প্রয়োজনে ব্যবহৃত হয়। এমনকি বিজ্ঞান সম্মত উপায়ে সাপের বিষ সংগ্রহের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা আয় করাও সম্ভব। তবে বাংলাদেশে বন্য প্রাণি সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী সাপ ধরা ও সাপ মারা নিষিদ্ধ এবং অপরাধ।
সাপ মাত্রই বিষাক্ত নয়। কাউকে কামড়ালেই সাপের ক্ষুধা মেটে না। সাপ ভীরুতম প্রাণি; আতঙ্কিত ও আত্মরক্ষার কৌশল হিসেবে সাপের ছোবল দেয়ার কাজে ব্যবহৃত হয় দাঁত। তখন তাৎক্ষণিক জৈবিক প্রক্রিয়ায় সাপের শরীরে তৈরি বিষ অপর প্রাণির দেহে ছড়ায়। এমন সাপও আছে, যার সামান্য বিষ মুহূর্তে একাধিক প্রাণি ও মানুষের প্রাণনাশে সমর্থ্য হয়।
সম্প্রতি সারা দেশে বিরাজ করছে রাসেলস ভাইপার আতঙ্ক। বিলুপ্ত প্রায় বিষধর এ সাপটি দ্রুতই দেশব্যাপী বিস্তৃত হচ্ছে, সাপটি এরই মধ্যে দাপুটে উপস্থিতি জানান দিয়েছে অন্ততঃ ২৫ জেলায়। এ সাপের কামড়ে মারা গেছে খোদ সাপুড়েসহ বেশ কিছু মানুষ।
কিছুটা অজগরের বাচ্চার মতো দেখতে রাসেলস ভাইপার। ছোট ও সরু লেজের সরীসৃপটির মাথা চ্যাপ্টা, ত্রিভুজাকৃতির এবং ঘাড় থেকে আলাদা। শরীরজুড়ে অনেকটা চাঁদের মতো গাঢ় বাদামি গোল গোল চিহ্ন। দৈহিক এ বৈশিষ্ট্যের কারণে শুকনো পাতা বা ধান ক্ষেতের মধ্যে খুব সহজেই লুকিয়ে থাকতে পারে রাসেলস ভাইপার।
রাসেলস ভাইপারের পিঠের দিক দিয়ে দাগ বা ফোটাগুলো শেকলের মতো, একটির সঙ্গে আরেকটি সংযুক্ত থাকে। তাই অনেকে এদের চেইন ভাইপার বা শেকলবোড়া নামে ডাকে।
ভাইপারিডি পরিবারভুক্ত সাপটি দীর্ঘ বিষদাঁতের অধিকারী, বিশ্বে যার অবস্থান দ্বিতীয় (অপর তথ্যানুযায়ী- অবস্থান পঞ্চম)। যা দিয়ে সে শত্রু কিংবা শিকারের দেহের গভীরে বিষ ঢেলে দিতে সক্ষম হয়। সাপের জগতে হিংস্রতা আর আক্রমণের ক্ষিপ্রতায় অন্যতম স্থান রাসেলস ভাইপারের। আক্রমণের গতি এতোই তীব্র যে এক সেকেন্ডের ১৬ ভাগের একভাগ সময়ের মধ্যে ছোবলকার্যটি সম্পন্ন করতে পারে রাসেলস ভাইপার। এ জন্যই রাসেলস ভাইপার কিলিং মেশিন নামেও পরিচিত।
সাপটি অন্যান্য সাপের মতো ডিম দেয় না। সরাসরি বাচ্চা প্রসব করে। সদ্যপ্রসূত বাচ্চা ৮- ১০ ইঞ্চি লম্বা হয়। সাপটির প্রজননহার অত্যধিক, রাসেলস ভাইপার সর্বোচ্চ আশিটি পর্যন্ত বাচ্চা প্রসব করে।
‘দেড় দুই দশক ধরে উত্তরাঞ্চলের বরেন্দ্র অঞ্চলের স্থায়ী বাসিন্দা হিসেবে পরিচিতি পেলেও রাসেলস ভাইপার এখন ছড়িয়ে পড়েছে সারা দেশে। প্রাপ্ত তথ্যমতে, গত ২০২০ খ্রিষ্টাব্দের বর্ষাকালে রাজশাহীর পাশের জেলা পাবনায় হঠাৎ করেই রাসেলস ভাইপারের উপদ্রব বেড়ে যায়। পদ্মার চরের ফসলের মাঠ, ঝোপঝাড় এমনকি বসতবাড়িতেও ব্যাপকহারে দেখা যায় সাপটিকে। তথ্য আছে, শুধু বাংলাদেশেই নয়, সাপটির বিচরণ ভারত, ভুটান, থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া, চীন ও মিয়ানমারেও। এটি সাধারণত ঘাস, ঝোপ, বন, ম্যানগ্রোভ ও ফসলের খেতে বাস করে।
প্রাণি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাসেলস ভাইপারের প্রজননকাল মে থেকে জুলাই পর্যন্ত। যে কারণে সাপটির দেখা মিলছে বেশি। সাপটির অভিযোজন ক্ষমতা বেড়ে যাওয়ায় সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে।
গাজীপুরের শেখ কামাল ওয়াইল্ড লাইফ সেন্টারের সরীসৃপ বিশেষজ্ঞ সোহেল রানা বলছেন, বরেন্দ্র অঞ্চলের শুষ্ক এক ফসলি জমিতে ইঁদুর খেতে রাসেলস ভাইপারের আনাগোনা ছিলো বেশি। তবে এখন দুই তিন ফসলি জমি বেড়ে যাওয়ায় খাবারের জোগান বাড়ছে এবং সাপটির প্রজননও বেড়ে যাচ্ছে।
সাম্প্রতিক সময়ে রাসেলস ভাইপার সারা দেশে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ার কারণ হিসেবে সোহেল রানা বলেন, আগের চেয়ে সাপটির নিজেকে প্রকৃতির সঙ্গে মানিয়ে নেয়ার সক্ষমতা অনেক বেড়েছে। এমনকি কচুরিপানার মতো ভাসমান কোনো কিছুর সঙ্গে ভেসে ভাটি অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ছে। অনেকেই বলছেন, খেতের সবজি, ফসল বা কৃষিপণ্যের সঙ্গেও সাপটির স্থানান্তর ঘটতে পারে।
বাংলাদেশে রাসেলস ভাইপারের পুনরাবির্ভাব ও মানুষের ঝুঁকির বিষয়ে ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দে ‘জার্নাল অব দি এশিয়াটিক সোসাইাটিতে প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখা যায়, দেশের ৬৪টি জেলার মধ্যে ১৭টি জেলাতেই রয়েছে রাসেলস ভাইপারের উপস্থিতি। উত্তর ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোতে রাসেলস ভাইপারের সবচেয়ে বেশি বিচরণ লক্ষ করা যায়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মোখলেসুর রহমান প্রসঙ্গত বলেন, রাসেলস ভাইপার প্রজাতিকে তাদের মতো করেই প্রাকৃতিক পরিবেশে থাকতে দিতে হবে। এতে তারা কারো ক্ষতি করবে না। সাপটির যেমন ক্ষতিকর দিক আছে, তেমনি সামাজিক ইকোসিস্টেমে উপকারী দিকও আছে। সেটা মানুষকে বোঝাতে হবে। যখনই সাপটি নিয়ে ‘ইন্টারফেয়ার’ করা হবে তখনই ওরা আক্রমণাত্মক হয়ে উঠবে।
সাপ বিষয়ে গবেষক ও বিশেষজ্ঞ হিসেবে দীর্ঘকাল ধরে সুপরিচিত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ফরিদ আহসানও বললেন, রাসেলস ভাইপার নিয়ে অনেকে না জেনে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে। সাপ দেখে সবাই ভয় পায় এবং এর কামড়ে মারা যায় এটাই মনে গেঁথে গেছে। চিকিৎসা নিলে যে ভালো হয়, সেটা সবাই জানে না বলেই আতঙ্কিত হয়। তবে এ সাপে কামড়ালে ১০০ মিনিটের মধ্যে চিকিৎসা নেয়া না হলে মৃত্যু হতে পারে। তাই খুব দ্রুত নিকটস্থ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গেলেই সমাধান অনেকটা এগিয়ে নেয়া যায়। তিনি বলেন, রাসেলস ভাইপার গর্ত এবং ঝোপঝাড়ের মধ্যে থাকে, বর্ষা এলে এরা বেরিয়ে আসে। তাই বিলে যাওয়ার সময় গামবুট এবং জিন্স পরে নিরাপদে থাকা যাবে।
বর্ষা এলেই চারদিকে সাপের উৎপাত ক্রমশ বাড়তে থাকে। যদিও শহরাঞ্চলের থেকে গ্রামাঞ্চলে সাপ বেশি দেখা যায়। ঘর, রান্নাঘর, বাগান, আনাচে-কানাচে সাপের উৎপাত বাড়তেই থাকে।
যে কারণে ভয়, আতঙ্ক তৈরি হয় গ্রামের লোকদের মধ্যে। সবসময় যে বাড়িতে কার্বলিক অ্যাসিড থাকে, তা কিন্তু নয়। যদি আপনার বাড়িতে কার্বলিক অ্যাসিড না থাকে তাহলে কোন উপায় দ্রুত সাপ তাড়াবেন সাপ? চলুন জেনে নিই সাপের উপদ্রব কমানোর উপায়-
যদি আপনার হাতের কাছে কার্বলিক অ্যাসিড না থাকে তাহলে আপনি লাল রঙের সাবান ব্যবহার করতে পারেন। কারণ লাল সাবানে কার্বনিল থাকে। আপনি এই সাবান টুকরো টুকরো করে কেটে নিন। তারপর ঘরের চারপাশে ছড়িয়ে দিন। তাহলে কিন্তু সাপ ঘরে প্রবেশ করবে না।
সালফারের গুঁড়ো দিয়ে খুব সহজেই আপনি বাড়ি থেকে বিষধর সাপের উপদ্রব কমাতে পারেন। বাড়িতে যেসব জায়গায় আপনার সাপের আনাগোনা রয়েছে, সেই জায়গাগুলোতে সালফারের গুড়ো ছড়িয়ে দিন। কারণ সালফারের গুঁড়ো সাপের গায়ে লাগলে জ্বালা হয়। ফলে সাপ একবার সেখানে এলে দ্বিতীয়বার আর একদমই আসবে না।
কার্বলিক অ্যাসিড ছাড়াও আপনি কিন্তু রসুন, সরিষার তেল দিয়ে খুব সহজেই বাড়ি থেকে সাপ এড়াতে পারেন। রসুন বেটে তাতে সরষের তেল মিশিয়ে তা রেখে দিন। বাড়ির যে কোনো কোনে বা বাড়ির চারপাশে ছড়িয়ে দিতে পারেন।
এ পরামর্শগুলো প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সাপের উপদ্রব কমাতেও সহায়ক হবে। তবে পরিচ্ছন্নতার কোনোই বিকল্প নেই; পরিষ্কার রাখতে হবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের চারপাশ এবং সরিয়ে ফেলতে হবে সব জঞ্জাল, স্তুপ করে রাখা পুরানো জিনিসপত্র।
সাপে কামড়ালে বর্জনীয়
আতঙ্কিত না হওয়া এবং চিকিৎসা সেবা নিতে দেরি হয় এমন কাজ থেকে বিরত থাকা।
অ্যাসপিরিন বা কোনো ব্যাথানাশক ওষুধ না দেওয়া।
ক্ষতস্থান অতিরিক্ত শক্ত করে না বাঁধা।
ক্ষতস্থান কেটে বিষ বের করার চেষ্টা করা যাবে না।
সাপুড়ে বা ওঝাদের ডেকে অযথা সময় নষ্ট করা যাবে না।
বমি হলে, মুখ দিয়ে ফেনা বের হলে বা কথা বলতে কষ্ট হলে মুখ দিয়ে কিছু দেওয়া যাবে না।
কোনো রাসায়নিক ব্যবহার করে বা অন্য কোনোভাবে ক্ষতস্থানের মুখ বন্ধের চেষ্টা করা যাবে না।
কোনো ধরনের পাথর, লালা, পটাসিয়াম পারম্যাঙ্গানেট, কাদা, গোবর, কোনো ধরনের বীজ বা ভেষজ ওষুধ প্রয়োগ করা যাবে না। অ্যালকোহল বা এ ধরনের কোনো কিছু প্রয়োগ করা যাবে না।
সাপে কাটা রুগীকে চিকিৎসা নিতে বিলম্ব হয় এমন কাজে বিরত থাকতে হবে। মহান আল্লাহ্ দুনিয়া আখিরাতের সব সাপ অভিশাপ থেকে সবাইকে হিফাজত করুন।
লেখক: বিভাগীয় প্রধান ইসলামিক স্টাডিজ, কাপাসিয়া ডিগ্রি কলেজ, গাজীপুর