মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নির্যাতনের মুখে ২০১৭ খ্রিষ্টাব্দে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে আসাসহ প্রায় সাড়ে ১২ লাখ রোহিঙ্গাকে মানবিক কারণে আশ্রয় দিয়েছে বাংলাদেশ সরকার। জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক দাতাসংস্থাগুলো এখন নানা সংকটের কথা বলে রোহিঙ্গাদের ওপর থেকে মনোযোগ সরিয়ে, ত্রান সহায়তার পরিমাণ কমিয়ে দিয়ে রোহিঙ্গাদেরকে বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর সঙ্গে মিশিয়ে দিতে উদ্বুদ্ধ করছে যা কখনো কাম্য নয়। ভবিষ্যতে এর পরিণাম ভয়াবহ হবার আশঙ্কা রয়েছে। বর্তমানে দেশের বিভিন্ন ক্যাম্পে থাকা রোহিঙ্গাদের অনেকে খুন-অপহরণের মতো নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়েছে এবং এর ফলে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি চরম অবনতি হয়েছে।
ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রাম (ডব্লিউ এফ পি) তহবিলের অভাবে ১ জুন থেকে রোহিঙ্গাদের জন্য মাসিক খাদ্য সহায়তা ১০ ডলার থেকে কমিয়ে ৮ ডলার করেছে। এর আগে মার্চ মাসে মাসিক বরাদ্দ ১২ ডলার থেকে কমিয়ে ১০ ডলার করা হয়েছিলো। তিন মাসের মধ্যে এই বরাদ্দ দুই বার কমানো হলো, যা হতাশাব্যঞ্জক। এর ফলে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে খাদ্য সংকট বাড়বে এবং ক্যাম্পের নিরাপত্তা পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে বলে আশঙ্কা করছে ত্রানকর্মীরা। রোহিঙ্গারা সম্পূর্ণভাবে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অর্থায়নের ওপর নির্ভরশীল। বর্তমানে জাতিসংঘের সংস্থাগুলো রোহিঙ্গাদের খাদ্য সংস্থান করতে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছে। জাতিসংঘের দারিদ্র্য বিশেষজ্ঞ ওলিভার ডি শুটার আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছ থেকে পাওয়া সহায়তা ‘অত্যন্ত অপর্যাপ্ত’ বলে উল্লেখ করে এ অবস্থায় রোহিঙ্গাদের জন্য জরুরি অর্থায়নে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এগিয়ে আসার আহ্বান জানায়।
রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠাতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ছয় বছরে কোনো অগ্রগতি দেখাতে ব্যর্থ হয়েছে। বর্তমানে এ ক্ষেত্রে সরাসরি ভূমিকা রাখতে চীন এগিয়ে এসেছে। চীন চায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু হোক। এই সমস্যা সমাধানের সঙ্গে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে চীনের ভাবমূর্তিও জড়িত। এই উদ্যোগ সফল হলে বৈশ্বিক কূটনীতিতে চীনের উত্থান আরো দৃশ্যমান হবে। চীনের উদ্যোগে মিয়ানমারের নেয়া পাইলট প্রকল্পের আওতায় বাংলাদেশ থেকে ১ হাজার ১৭৬ জন রোহিঙ্গাকে রাখাইনে প্রত্যাবাসনের প্রস্তুতি চলছে। স্বেচ্ছায় মিয়ানমারে চলে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করে ২৪ মে ভাসানচর থেকে উখিয়ার ট্রানজিট ক্যাম্পে চারটি রোহিঙ্গা পরিবারের ২৩ জন সদস্য আসে। ইউএনএইচসিআর ৫ জুন তাদের খাবার দেওয়া বন্ধ করে দেয় এবং সে সময় তাদের খাদ্য সরবরাহের কোনো বিকল্প ব্যবস্থাও ছিলো না। সে সময় বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে জরুরিভিত্তিতে তাদের খাবারের ব্যবস্থা করা হয়। পরে ৬ জুন থেকে তাদেরকে পুনরায় খাবার দেওয়া শুরু করে ইউএনএইচসিআর। না জানিয়ে এই ধরনের সিদ্ধান্তে বাংলাদেশ সরকার অসন্তোষ প্রকাশ করেছে এবং রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে ইউএনএইচসিআর যাতে বাধা সৃষ্টি না করে সে ব্যাপারে সরকারের পক্ষ থেকে ঢাকায় সংস্থার প্রধানকে সতর্কবার্তা দেওয়া হয়েছে। ইউএনএইচসিআর প্রত্যাবাসন না হওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশের ভেতরে রোহিঙ্গাদেরকে প্রয়োজনীয় সহায়তা অব্যাহত রেখে, প্রত্যাবাসনে বাধা না দিয়ে সহায়কশক্তি হিসেবে কাজ করবে বলে বাংলাদেশ আশা করে। ক্রমাগত ত্রাণ সহায়তা কমে যাওয়ার প্রেক্ষিতে উদ্ভুত অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি মোকাবিলায় বাংলাদেশকে আগে থেকেই প্রস্তুত থাকতে হবে ও সেজন্য খাদ্য সহায়তা নিশ্চিতে বিকল্প ব্যবস্থা, রিজার্ভ ও সামর্থ বাড়াতে হবে। এই ঘটনা থেকে খাদ্য সংকট সমাধানে আরো ভালোভাবে প্রস্তুতি নেয়ার বিষয়টা গুরুত্ব দিতে হবে।
মিয়ানমার পশ্চিমা দেশগুলো ও জাতিসংঘকে তাদের দেশে রোহিঙ্গাদের নিয়ে কাজ করতে না দেয়ায় জাতিসংঘ মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের সমস্যা সমাধানে কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারছে না এবং জাতিসংঘ মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে এই পর্যন্ত কোনো সমঝোতায়ও আসতে পারেনি। জাতিসংঘের মিয়ানমার বিষয়ক বিশেষ দূত নয়েলিন হেইজেল মিয়ানমার সরকারের অসহযোগিতার কারণে তার দায়িত্ব পালন করতে না পেরে পদত্যাগ করেছেন। জাতিসংঘের বিশেষ দূত দায়িত্ব নেয়ার ১৮ মাস পর পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নেয়।
রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশসহ পশ্চিমা বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও দাতাসংস্থা ত্রাণ ও মানবিক কার্যক্রমসহ বিভিন্ন বিষয় নানাভাবে জড়িত। প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া চলমান রাখার পাশাপাশি বাংলাদেশে সাময়িক অবস্থানকারী রোহিঙ্গাদের নিরাপদ ও শান্তিপূর্ণ জীবন নিশ্চিত করার জন্য ভাসানচরে আরও অবকাঠামো নির্মাণে এবং ভাসান চরে রোহিঙ্গাদের স্থানান্তরের জন্য আর্থিক সহযোগিতা নিশ্চিত করতে জাতিসংঘ ও অন্যান্য সাহায্য সংস্থাকে সমন্বিত উদ্যোগ নিয়ে দ্রুত এগিয়ে আসতে হবে। মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের জন্য ত্রাণ সহায়তা ও প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চলমান রাখার বিষয়ে চীন ও আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোকে সঙ্গে রাখতে হবে। মনে রাখতে হবে সাড়ে ১২ লাখ রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে সময় একটা বড় ফ্যাক্টর। তাই পর্যায়ক্রমে এই প্রক্রিয়া চলমান রাখতে নানা ধরনের পদক্ষেপ নিতে হবে এবং এর সফলতার জন্য সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে।
গত ৮ জুন জাতিসংঘ জেনেভা থেকে পাঠানো এক বিবৃতিতে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরানোর পাইলট প্রকল্প অবিলম্বে স্থগিত করতে বলেছে। জাতিসংঘের মিয়ানমারের পরিস্থিতি বিষয়ক বিশেষ র্যাপোর্টিয়ার টম অ্যান্ড্রুস জানান, রাখাইনে ফিরে গেলে রোহিঙ্গারা ব্যাপকতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের পাশাপাশি ভবিষ্যতে নৃশংস অপরাধের শিকারে পরিণত হতে পারে। একইসঙ্গে দ্রুত মিয়ানমারে প্রত্যাবাসন শুরু করার দাবিতে উখিয়া-টেকনাফের বিভিন্ন ক্যাম্পে বসবাসরত রোহিঙ্গারা সমাবেশ করেছে। ৮ জুন, ১৩টি ক্যাম্পে রোহিঙ্গারা এই কর্মসূচির আয়োজন করে জানায় যে তারা দ্রুত মিয়ানমারে ফিরতে চায়। রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার ইচ্ছা প্রেষণার মাধ্যমে জাগিয়ে রাখতে হবে এবং পাশাপাশি তাদের জন্য ত্রান সহায়তা চলমান রাখতে সব ধরনের প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।
দিনদিন রোহিঙ্গাদের জন্য খাদ্য সহায়তার পরিমান কমে আসছে যা কখনই কাম্য নয়। এই প্রবনতা মোকাবেলায় খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে। রোহিঙ্গাদের জন্য দ্রুত রিজার্ভ খাদ্য মজুদ গড়ে তুলতে হবে। অন্য যেকোনো সহায়তার আগে এই খাদ্য সহায়তার কথা ভাবতে হবে। রোহিঙ্গাদের মানবিক কার্যক্রম ও ত্রাণ সহায়তায় নিয়োজিত জাতিসংঘের অঙ্গসংগঠনগুলো, দাতাদেশ ও সংস্থাগুলোর উচ্চপর্যায়ে এই সমস্যার সমাধানে কার্যকরী কর্ম পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে। এগুলোর বাস্তবায়নে নেয়া বিভিন্ন পদক্ষেপ শুধুমাত্র বাংলাদেশ প্রান্তে সীমিত না রেখে মিয়ানমারকে সঙ্গে নিয়ে উপযুক্ত নীতি নির্ধারণ ও তা দ্রুত বাস্তবায়নের ব্যবস্থা করতে হবে। মিয়ানমার সরকার ও প্রত্যাবাসনে সহায়তাকারী যেকোনো দেশের সঙ্গে সরাসরি অথবা তৃতীয় কোনো পক্ষের মাধ্যমে যোগাযোগ করে সমস্যার সমাধান করতে হবে।
চীন প্রত্যাবাসনের এই উদ্যোগ নিয়ে এগিয়ে আসায় মিয়ানমার এই পাইলট প্রকল্প হাতে নিয়েছে। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে মিয়ানমারের এই পদক্ষেপ তাদের আন্তরিকতা প্রমানে সহায়ক হবে। চলমান এই উদ্যোগে মিয়ানমার আন্তরিক থাকবে এটাই প্রত্যাশা, এই প্রক্রিয়ায় আন্তরিক না হলে মিয়ানমারেরই সুনাম ক্ষুণ্ণ হবে। চীন বন্ধুভাবাপন্ন প্রতিবেশী দেশের শান্তি ও সংঘাত নিরসনে সার্থক ভূমিকা রাখবে এটাই প্রত্যাশা। এই উদ্যোগ এই অঞ্চলে চীনের কূটনৈতিক সাফল্যের একটা ইতিবাচক মাইলফলক হবে।
রোহিঙ্গা সমস্যা একটা বৈশ্বিক সমস্যা, এই সমস্যা সমাধানে কোনো বাধা আসলে তা কেবল বাংলাদেশের উপর না চাপিয়ে এর সমাধানে বিকল্প ব্যবস্থা খুঁজে বের করতে হবে। বাংলাদেশে অবস্থারত রোহিঙ্গাদেরকে জাতিসংঘ ও পশ্চিমা দেশগুলো গত ছয় বছর ধরে ত্রাণ ও খাদ্য সহযোগিতা দিয়ে আসছে ও আন্তরিকভাবে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছে। ক্রমাগত ত্রাণ ও খাদ্য সহায়তা কমে যাওয়া রোহিঙ্গা সমস্যা মোকাবেলায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। এজন্য বাংলাদেশকে সহায়তা দিতে জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো কীভাবে কাজ করবে তা নতুন করে ভাবতে হবে। পশ্চিমা দেশগুলো যদি মিয়ানমারে সরাসরি কাজ না করতে পারে তবে তারা মিয়ানমারের সঙ্গে যে সমস্ত দেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক আছে যেমন, জাপান, সিংগাপুর, থাইল্যান্ড এই দেশগুলোর মাধ্যমে তাদের সহায়তা কার্যক্রম পরিচালনার পরিকল্পনা করতে পারে। যাদের মাধ্যমে কাজ হবে সেসব দেশ, ব্যক্তি ও সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করে দ্রুত কর্মপদ্ধতি ঠিক করা যেতে পারে।
জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো রোহিঙ্গাদেরকে মিয়ানমারে ফিরিয়ে নেবার যেকোনো উদ্যোগকে সমর্থন করে যতোদিন পর্যন্ত তারা মিয়ানমারে ফিরে যেতে না পারছেন সে পর্যন্ত তাদের ত্রাণসহায়তা যেনো না কমে তার জন্য প্রয়োজনীয় কার্যক্রম চালিয়ে যেতে পারে। রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে সমন্বিতভাবে কাজ করলে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার বিষয়টি আলোর মুখ দেখতে পারে। এই সমস্যা আরও দীর্ঘায়িত হলে তা নানা ধরনের জটিল সমস্যার সৃষ্টি করবে ও ক্রমঅবনতিশীল নিরাপত্তা পরিস্থিতির উপর চাপ ফেলবে। কাজেই প্রত্যাবাসনের জন্য নেয়া যেকোনো উদ্যোগ কীভাবে সমর্থন করে ত্বরান্বিত করা যায় এবং কাদেরকে সঙ্গে নিলে তা এগিয়ে যাবে এসব বিষয় এখন ভেবে দেখার সময় এসেছে। সবারই উদ্দেশ্য একটাই, রোহিঙ্গারা যাতে মিয়ানমারে স্বেচ্ছায় ও সম্মানের সঙ্গে ফিরে যেতে পারে, সেই উদ্দেশে সামনে রেখে এখন থেকে সব কর্মপরিকল্পনা নির্ধারণ ও বাস্তবায়ন করতে হবে।
লেখক : ব্রি. জে. (অব.) হাসান মো. শামসুদ্দীন, মিয়ানমার ও রোহিঙ্গা বিষয়ক গবেষক