লটারির মাধ্যমে ভর্তির যৌক্তিকতা - দৈনিকশিক্ষা

লটারির মাধ্যমে ভর্তির যৌক্তিকতা

মাছুম বিল্লাহ |

দেশের সব সরকারি ও বেসরকারি বিদ্যালয়ের সব শ্রেণিতে শিক্ষার্থী ভর্তির প্রক্রিয়ায় লটারি পদ্ধতি চালু হয়েছে ২০২১ শিক্ষাবর্ষে, করোনা মহামারি চলাকালে। এর আগে শুধু প্রথম শ্রেণিতে ভর্তিতে লটারি পদ্ধতি চালু হয় ২০১১ শিক্ষাবর্ষ থেকে। করোনায় এক বছরেরও বেশি সময় বিদ্যালয়গুলো বন্ধ থাকার পর লটারিতেই সব নতুন ক্লাসে ভর্তি নেওয়া শুরু হয়। তার আগ পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন শ্রেণিতে ভর্তি-যুদ্ধ নামে এক ভয়াবহ যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে যেতে হতো কোমলমতি শিশুদের। চার থেকে ছয় বছর বয়সি শিশুদেরও সারা বছর ধরে ভর্তি কোচিংয়ের নামে অমানুষিক চাপ দিয়ে এই সমাজ তাদের ভর্তি যুদ্ধে নামিয়ে দিতো। তাই শিক্ষার্থীদের ওপর শারীরিক ও মানসিক চাপ কমাতে এবং ভর্তির তদবির বন্ধে এই সিদ্ধান্ত। 

আগে প্রথম শ্রেণিতে লটারি ও অন্যান্য শ্রেণিতে ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থী  নির্বাচন করে ভর্তি করা হতো। এতে মেধা যাচাই করার সুযোগ ছিল বলে অনেকে মনে করেন। আসলেই কি তাই? মেধা যাচাইয়ের পরীক্ষা হয়, নাকি কে কতটা তথ্য মুখস্থ করে ধরে রাখতে পারে এবং ভর্তি পরীক্ষার খাতায় সেগুলো উগরে দিতে পারে তার পরীক্ষা হয়?

ঢাকা সিটির নামকরা কিছু বিদ্যালয়ে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির ভর্তি পরীক্ষায় প্রশ্ন এসেছিল- বাংলাদেশে স্বাধীন বিচার ব্যবস্থার যাত্রা কবে শুরু হয়। এটি দ্বিতীয় শ্রেণির জন্য কি ধরনের প্রশ্ন? অতি সৃজনশীল না বিসিএস পরীক্ষার প্রশ্ন? 

তথাকথিত ভাল স্কুল নামে যেগুলো পরিচিত সেগেুলোতে আসন সংখ্যা যত, তাতে এসব খুদে যোদ্ধাদের সবার সংকুলান হতো না স্বাভাবিকভাবেই, ফলে যুদ্ধের মাঠে মারা যেত তাদের উৎসাহ, উদ্দীপনা ও ভেতরকার মানসিক শক্তি। নিজেদের আকাঙ্খা অনুযায়ী সন্তান ভর্তি করাতে না পারার শোকে অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের মানসিক অবস্থার খবর রাখার সময় পান না। তাই অভিভাবকদের কেউ কেউ এই যুদ্ধের বিরোধী ছিলেন, লটারি ব্যবস্থা তাদের জন্য আর্শীবাদ হয়ে এসেছে। কোচিং, ভর্তি বাণিজ্য, শিশুদের অন্যায্য প্রতিযোগিতার চাপ থেকে রক্ষা করতে এই ব্যবস্থা চালিয়ে যাওয়ার কথা বলছেন শিক্ষামন্ত্রী। 

গত ২৫ নভেম্বর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি সংক্রান্ত সংবাদ সম্মেলনে শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন, সরকারি ও বেসরকারি স্কুলে প্রথম থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত লটারির মাধ্যমে নতুন শিক্ষার্থী ভর্তি করা হবে। এ বছর ক্যাচমেন্ট এরিয়া ৪০ শতাংশের পরিবর্তে ৫০ শতাংশ করার কথাও তিনি বলেছেন। ক্লাস্টারভিত্তিক ভর্তির ক্ষেত্রে লটারিতে পাঁচটি স্কুলের চয়েস দেওয়া  যাবে। এতে মেধা দক্ষতা থাকা সত্ত্বেও অনেক শিক্ষার্থী আশানুরূপ প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা লাভের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবেন বলে অনেকেই মনে করছেন। 

তবে এ বছর লটারি ব্যবস্থার বেশ কিছু দুর্বলতা নিয়ে সমালোচনা শুরু হয়েছে। পত্রপত্রিকায় খবর এসেছে যে, একই তালিকায় এক শিশুর নাম বার বার এসেছে । লটারি ব্যবস্থার ফাঁকফোঁকর খুঁজে বের করে অনিয়ম শুরু করেছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অসৎ শিক্ষক-কর্মচারী থেকে শুরু করে কিছু অভিভাবকও। একই শিশুর নামে অবৈধভাবে একাধিক জন্মসনদ তৈরি করে প্রাণপনে তারা পছন্দের স্কুলে সন্তানকে ভর্তির চেষ্টা চালাচেছন। দৈনিক শিক্ষাডটকমে প্রকাশ, একজন শিক্ষার্থীর নাম দশবার মেধা তালিকায় ও চারবার অপেক্ষমান তালিকায় এসেছে। এ কেমন খবর? এসব কারণে প্রশ্নের মুখে পড়ে যাচেছ পুরো পদ্ধতিটিই। ভাগ্য পরীক্ষায় উত্তীর্ণ না হওয়া অভিভাবকদের অসন্তোষ তো রয়েছেই। 

অনেকে বলছেন, লটারির কারণে অনেক মেধাবী শিশু ভাল স্কুলে ভর্তি হতে পারছেন না। জীবনে সব পর্যায়েই যেহেতু পরীক্ষা দিতেই হয়, শৈশব থেকেই তার অভ্যাস করাতে হবে, এমন যুক্তিও দিচেছন কেউ কেউ। লটারিতে সুযোগ না পেয়ে শিশুদের মানসিক যন্ত্রণার কথাও বলছেন অনেক অভিভাবক।  

ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে গিয়ে শিক্ষার্থীরা অনেক কিছু জানতে পারেন। কিন্তু লটারির মাধ্যমে ভর্তির প্রক্রিয়ায় এ বিষয় দুটোতে ছেদ পড়ে বলেও বলছেন কেউ কেউ।

কিন্তু স্কুল সমাপনী পরীক্ষা, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিতে হয় যে বয়সে, সে বয়সে হয়তো এই চাপ নেওয়া যায়, কিন্তু স্কুলপড়ুয়া ছোট ছোট শিশুদের সেই চাপ দেওয়া কোনভাবেই বিজ্ঞানসম্মত নয় এবং তাদের প্রতি এটি সঠিক মানবিক আচরণও নয়। 

শিশুরা তাদের বাড়ির পাশে নিজ ক্যাচমেন্ট এরিয়ার বিদ্যালয়ে পড়াশুনা করবে, এটি আদর্শিক কথা, যুক্তির কথা একং হওয়ার কথাও তাই। তাহলে ট্রাফিক জ্যাম কম হবে, শিশুর শারীরিক ও মানসিক কষ্ঠ লাঘব হবে, অভিভাবকদের অর্থ, সময় এবং টেনশন কমবে। আর দেশের বিদ্যালয়গুলো সমতা অর্জনের দিকে আগাবে, অসুস্থ প্রতিযোগিতা দূর হবে, যদি তথাকথিত ভর্তি পরীক্ষা না নেওয়া হয়। কিন্তু লটারির মাধ্যমে ভর্তি প্রক্রিয়ায় যেসব খবর এসেছে সেগুলোও সুখকর নয়। 

এছাড়াও আমাদের সরকারি প্রাথমিকের শিক্ষা দু’ চারটে ব্যতিক্রম ছাড়া এখনও আনন্দময় তো নয়ই, মানসম্মত শিক্ষা থেকেও  অনেক দূরে। ফলে একটু সচ্ছল অভিভাবক হলেই তার সন্তানকে আর সরকারি প্রাথমিকে দিতে চান না। অন্তত যেখানে ব্যক্তি চালিত কিন্ডারগার্টেন আছে। তবে, মাধ্যমিকে প্রায় ৯৮ শতাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানই বেসরকারি। আর এই বেসরকারি হওয়ার কারণে কোনো সমতা কিংবা  সাধারণ বৈশিষ্ট্য নেই বিদ্যালয়গুলোতে। নেই প্রয়োজনীয় সংখ্যক কিংবা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বা মানসম্মত ও বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক। যেসব বিদ্যালয়ের নাম ডাক আমরা শুনি সেগুলো বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও কমিটির বদৌলতে  হয়েছে। সেসব প্রতিষ্ঠানে রাষ্ট্রীয় আনুকূল্যে মানসম্মত শিক্ষা আসেনি। অতএব, তাদের অধিকার আছে তাদের পছন্দমতো শিক্ষার্থী ভর্তি করানার। তারা শিক্ষকদের সেভাবে তৈরি করেন, প্রতিষ্ঠানের সার্বিক পরিবেশ বহু ত্যাগ তিতিক্ষার মাধ্যমে, বহু অবাঞ্ছিত অবস্থা মোকাবিলা করে ধরে রেখেছেন। এসব প্রতিষ্ঠানে একটি নির্দিষ্ট মানের শিক্ষার্থী ভর্তি করার অধিকার তাদের আছে। তা না হলে মানসম্মত শিক্ষার কোনো উদাহরণই থাকতো না। লটারির মাধ্যমে ভর্তির ফলে এ বিষয়টিতে বড় ধরনের এক ধাক্কা লেগে যাবে। কারণ মানসস্মত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষকরা এখনও একই শ্রেণিতে বহু ধরনের শিক্ষার্থীদের সমাহার ঘটানো এবং সে পরিস্থিতি মোকাবিলা করে পাঠদান করতে প্রস্তুত নয়। তবে, সমাজ যেভাবেই চিন্তা করুক না কেন, শিক্ষার্থীদের অর্থাৎ দেশের ভবিষ্যত নাগরিকদের অধিকার আছে দেশের ভাল প্রতিষ্ঠানে, তাদের বাড়ির কাছের প্রতিষ্ঠানে পড়াশুনা করার। 

জন্মসনদ তোলায় অনিয়ম, স্কুলে দুর্নীতি- এই ঘটনাগুলো দেশের সব পর্যায়ে ছড়িয়ে পড়ছে। এটি রাষ্ট্রকে দেখতে হবে। তা না হলে অসদুপায় যারা অবলম্বন করেন, তারা ভর্তি পরীক্ষার ক্ষেত্রেও একই ধারা বজায় রাখবেন। 

ভর্তিযুদ্ধ নামে শিশুদের ওপর যে নির্যাতন চালানো হয়েছে তা আবার ফিরে আসুক তা কারোই কাম্য নয়। কোভিড পরবর্তী সময়ে ২০২১ শিক্ষাবর্ষে সব শ্রেণিতে ভর্তি পরীক্ষা বাতিল করে লটারির মাধ্যমে শিক্ষার্থী ভর্তি করার কথা ঘোষণা করা হলে এর সুবিধা ও অসুবিধা নিয়ে তখন থেকেই অভিভাবক ও শিক্ষকদের মধ্যে  মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। কেউ বলেছিলেন ভালো পড়ালেখা করলেও ভালো স্কুলে ভর্তি হওয়ার নিশ্চয়তা নেই। তাই প্রস্তুতি থাকলেও পছন্দের বিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া থেকে অনেক শিক্ষার্থী বঞ্চিত হন এবং হবেন। 

আবার কেউ কেউ মনে করছেন, এ পদ্ধতিতে ভর্তি নেওয়া হলে সমাজে ধনী ও গরীবের বৈষম্য কমতে পারে। আবার কোনো কোনো অভিভাবক মনে করেন, মেধা দক্ষতা ও সৃজনশীলতার ভিত্তিতে শিক্ষার্থী নির্বাচন করা দরকার। লটারিতে সে সুযোগ থাকেনা। আবার লটারির পক্ষের কেউ কেউ মনে করেন, কারো সন্তান তুলনামূলক কম মেধাবী হলে তাকে একটি বেনামি প্রতিষ্ঠানেই পড়তে হয়। যার মেধা ভাল সে সবসময় নামিদামি প্রতিষ্ঠানে পড়বে। এটি চলতে থাকলে ধনী আরও ধনী, গরিব আরও গরিব হওয়ার মতো অবস্থা চলতে থাকবে, যা চলতে দেওয়া উচিত নয়। এতে সমাজে বৈষম্য আরও প্রকট হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এটিও ফেলে দেওয়ার মতো কথা নয়। তবে, শিক্ষা ও সমাজের পাহাড়সম বৈষম্যের বিষয়ে আর নীরব থাকাও ঠিক নয়। কোনো এক জায়গা থেকে শুরু করা উচিত, তাতে সমস্যা একটু হবে। তারপরেও শুরু করা উচিত। লটারির মাধ্যমে শিক্ষার্থী ভর্তি তেমনই হয়তো একটি পদক্ষেপ। কিন্তু এখানকার ঘটে যাওয়া অনিয়মগুলোও কোনোভাবে উপেক্ষা করার মতো নয়। 

লেখক : মাছুম বিল্লাহ, প্রেসিডেন্ট-  ইংলিশ টিচার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ ( ইট্যাব)

 

 

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে আবারো ভর্তি পরীক্ষা চালু হবে - dainik shiksha জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে আবারো ভর্তি পরীক্ষা চালু হবে সরকারি-বেসরকারি স্কুলে ভর্তি: দুই দিনে আবেদন প্রায় দুই লাখ - dainik shiksha সরকারি-বেসরকারি স্কুলে ভর্তি: দুই দিনে আবেদন প্রায় দুই লাখ শিক্ষক নিয়োগেও নামকাওয়াস্তে মনস্তাত্ত্বিক পরীক্ষা হয়: গণশিক্ষা উপদেষ্টা - dainik shiksha শিক্ষক নিয়োগেও নামকাওয়াস্তে মনস্তাত্ত্বিক পরীক্ষা হয়: গণশিক্ষা উপদেষ্টা পাঠ্যপুস্তক থেকে শেখ মুজিব ও শেখ হাসিনার বিষয়বস্তু অপসারণের দাবি - dainik shiksha পাঠ্যপুস্তক থেকে শেখ মুজিব ও শেখ হাসিনার বিষয়বস্তু অপসারণের দাবি এসএসসির ফরম পূরণ শুরু ১ ডিসেম্বর - dainik shiksha এসএসসির ফরম পূরণ শুরু ১ ডিসেম্বর কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের গল্প - dainik shiksha পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের গল্প কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক - dainik shiksha কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক পাঠ্যপুস্তকে একক অবদান তুলে ধরা থেকে সরে আসার আহ্বান হাসনাতের - dainik shiksha পাঠ্যপুস্তকে একক অবদান তুলে ধরা থেকে সরে আসার আহ্বান হাসনাতের ৬ষ্ঠ ও ৮ম শ্রেণির বাদপড়া শিক্ষার্থীদের রেজিস্ট্রেশনের সুযোগ - dainik shiksha ৬ষ্ঠ ও ৮ম শ্রেণির বাদপড়া শিক্ষার্থীদের রেজিস্ট্রেশনের সুযোগ দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0030670166015625