লবণ জলে জীবন জ্বলে - দৈনিকশিক্ষা

লবণ জলে জীবন জ্বলে

গুরুদাস ঢালী |

‘চিক চিক করে বালি, কোথা নেই কাদা, একধারে কাশবন ফুলে ফুলে সাদা। কিচিমিচি করে সেথা শালিকের ঝাঁক, রাতে ওঠে থেকে থেকে শিয়ালের হাঁক। রবীন্দ্রনাথ নাথ ঠাকুরের ‘আমাদের ছোট নদী’ কবিতাটি পড়েননি এমন লোক খুঁজে পাওয়া কঠিন। দেশের অনেক গ্রামে একটা সময় এমন নদী দেখা যেতো, কবিতার কথার সঙ্গে একেবারে মিলে যেতো। হায়রে জীবন, কোথায় গেলো সেই দিনগুলো! আসবে কি আর ফিরে সেই সময়টা! মন ভরে বলতে পারবো আমার গাঁয়ের রূপ আমি দেখেছি পৃথিবীর আর কোথাও যেতে চাই না। এই আক্ষেপটা আমার নিজের না। খুলনা অঞ্চলের বিস্তীর্ণ এলাকার বিশেষত গ্রামগুলোর অতি সাধারণ মানুষের। 

কেউ কি কখনো দেখেছেন জলে আগুন জ্বলে! আমি, আমরা দেখেছি। আরো দেখেছেন যাদের বাড়ি খুলনা জেলার পাইকগাছা, কয়রা এবং দাকোপ উপজেলাতে। 

বর্তমান এটাকে কোনো জনপদ বলা যাবে না। এটা একটা ‘জলপদে’ পরিণত হয়েছে। আর আমার মনের, ভালোবাসার মানুষগুলোর চেহারা হয়েছে কাঠ কয়লায় পুড়ে পুড়ে অঙ্গার হওয়া মানুষের মতো। ৯০’র দশকে এলাকায় আসে লোনাপানির মাছের চাষ। তৎকালীন বহুল প্রশংসিত টেলিভিশন চ্যানেলের সংবাদ উপস্থাপকরা হাঁটু পানিতে নেমে সাদা সোনা বলে খ্যাত বাগদা চিংড়ির ব্যবসা সফল সংবাদ লাইভ প্রচার করেছিলেন। কিন্তু তারা তো জানতো না এই সোনা সেই সোনা না, এই সোনা মানুষের মন ও চেহারার অবয়বের পরিবর্তন ঘটাতে পারে। বাস্তবে তাই হয়েছে।

প্রথমতঃ যে সমস্যা সৃষ্টি করেছে সেটা হলো জীব ও বৈচিত্রকে ধুলিসাৎ করছে। আপনি যদি ওই সব জনপদে বেড়াতে যান দেখতে পাবেন বসত ঘর ছাড়া কোথাও বসার মতো বা বিশ্রাম নেয়ার মতো পরিবেশ নেই। কারণ, এলাকায় কোনো গাছ পালা নেই। জলাভূমির মধ্যে শুধু জল আর জল। জলাভূমির মধ্যে জনভূমি বিরান হয়ে মনুষ্য বসতির জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। গরমের সময় বদ্ধ জল পচে এমন একটা গন্ধ ছড়ায় কেউ সেখানে না থাকলে বিশ্বাস করবেন না যে এখানে মানুষ কীভাবে বাস করে। যে দিক তাকাবেন জল আর জল, মাঝে মাঝে মনুষ্য আস্তানা টিনের ঘরগুলো অসহায়ের মতো মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। 

দ্বিতীয়তঃ জল ও সুপেয় পানীয় জল। জলের অপর নাম জীবন। এখানে জল মানে যুদ্ধ, জল মানে হতাশা, জল মানে দীর্ঘশ্বাস, জল মানে মেয়েদের এই এলাকায় বিয়ে না দেয়া। আগেও জলের সমস্যা ছিলো কিন্তু এতোটা প্রকট ছিলো না। এখন নানা- নানি ও দাদা-দাদিরা নাতিনাতনিদের সঙ্গে ঘুম পাড়ানি গল্প বলতে ভুলে গেছে এখন তারা পরের দিন খাবার জল সংগ্রহের গল্প বলে।    

পানির অপর নাম জীবন। পানি থাকলেই জীবন থাকবে। পানি ছাড়া জীবনের অস্তিত্ব কল্পনাও করা যায়না। পরিবেশের প্রধান চারটি উপাদানের মধ্য অন্যতম একটি উপাদান হচ্ছে পানি। পানির অধিকার মানে জীবনের অধিকার ।

পৃথিবীর মোট আয়তনের চার ভাগের তিন ভাগ পানি এবং এক ভাগ স্থল। পৃথিবীর বেশিরভাগ অংশই জলাভূমি হলেও পানযোগ্য পানির পরিমাণ নিতান্তই অল্প। পৃথিবীর মোট জলভাগের শতকরা ৯৭ ভাগ কঠিন বরফ, দুই ভাগ পান অযোগ্য সামুদ্রিক লোনাপানি এবং অবশিষ্ট এক ভাগ মিষ্টিপানি। কিন্তু এর বেশিরভাগই ময়লা আবর্জনা জীবাণু দ্বারা পরিপূর্ণ ও পানের অযোগ্য। তাই পানযোগ্য পানির সংকট ছিলো সবসময়। সভ্যতার শুরু থেকেই মানুষ পানযোগ্য পানির জন্য নদীনালা, পুকুর, কুয়া বা অন্যান্য নিম্নস্থল যেখানে বৃষ্টির পানি জমা থাকতো সে ধরনের উৎসের ওপর নির্ভরশীল ছিলো। প্রাচীন সবকটি সভ্যতাই গড়ে উঠেছিলো সুপেয় পানির উৎসের অনুকূলে। টাইগ্রিস-ইউফ্রেটিস নদীর অববাহিকায় মেসোপটেপিয়া সভ্যতা, হোয়াংহো নদীর তীরে চীন সভ্যতা, সিন্ধু নদীর তীরে মহেঞ্জোদারো সভ্যতা, ইরাবতী নদীর তীরে হরপ্পা সভ্যতা, নীলনদের তীরে মিসরীয় সভ্যতা ইত্যাদি গড়ে উঠেছিলো সুপেয় পানির পর্যাপ্ত জোগানের কারণেই। তাই সুপেয় পানিপ্রাপ্তির সুযোগ বর্তমানে বিশ্বব্যাপী মানবাধিকার হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। জাতিসংঘ পানি অধিকারকে মানবাধিকার হিসেবে ঘোষণা করেছে। কিন্তু অধিকার হিসেবে স্বীকৃত হলেও এখনো এ অধিকার থেকে বঞ্চিত ৭৬ কোটিরও বেশি মানুষ। তাই সুপেয় পানির অধিকার রক্ষা করা আজ জরুরি।

জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়নের ১৭টি লক্ষ্যের মধ্যে ৬ নম্বরটি সুপেয় পানি। ২০৩০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে শতভাগ নাগরিকের জন্য যা নিশ্চিত করতে হবে৷

বিশ্বব্যাংক, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং ইউনিসেফের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশের ৯৮ ভাগ মানুষের আওতার মধ্যে পানির কোনো-না-কোনো উৎস রয়েছে৷ কিন্তু এর সবটাই পানযোগ্য নয়৷ নিরাপদ বা সুপেয় পানি পাচ্ছে শতকরা ৫৬ ভাগ মানুষ৷ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, ইউনিসেফ এবং বাংলাদেশ সরকারের জয়েন্ট মনিটরিং প্রোগামের সর্বশেষ হিসেবে তা শতকরা ৮৭ ভাগ বলা হচ্ছে বলে ডয়চে ভেলেকে জানান ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন ফর রুর‌্যাল পুওর (ডরপ)-এর রিসার্চ, প্ল্যানিং অ্যান্ড মনিটরিং পরিচালক মোহাম্মদ যোবায়ের হাসান৷ 

এক গবেষণায় দেখা যায় লবণাক্ততার প্রভাবে উচ্চ রক্তচাপ, প্রি-এক্লাম্পসিয়ার (গর্ভকালীন খিঁচুনি) মতো আরো অনেক স্বাস্থ্যগত সমস্যা উপকূল এলাকায় প্রকট হচ্ছে। বিশেষ করে নারীদের এই সমস্যা বেশি ভোগাচ্ছে। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় অঞ্চলের সাতক্ষীরা ও খুলনা জেলার শ্যামনগর, আশাশুনি, কালিগঞ্জ, তালা, দেবহাটা, কয়রা, পাইকগাছা, দাকোপ, বটিয়াঘাটা, ডুমুরিয়া  উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে পানি সংকট আছে। এই এলাকার প্রায় ৫০ লাখ মানুষ কমবেশি খাবার পানির সংকটে রয়েছে। এক কলস পানি সংগ্রহের জন্য নারী ও শিশুরা ছুটে যান এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে। কোনো কোনো গ্রামে মিষ্টি পানির আধার বলতে আছে দু-একটি পুকুর। তবে অধিকাংশ গ্রামে পুকুরও নেই।

জলে অধিক লবনাক্ততার জন্য ভুগর্ভস্থ পানিও লবনাক্ততায় পরিপূর্ণ। এখানে টিউবওয়েলে পানি লবনাক্তের সঙ্গে আর্সেনিকও আছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শ অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তির প্রতিদিন ৫ গ্রামের বেশি লবণ খাওয়া উচিত না। কিন্তু এই উপকূলীয় এলাকার মানুষজনকে প্রতিদিন ১৬ গ্রাম লবণ খেতে হচ্ছে, যা অনান্য এলাকার মানুষজনের তিনগুণ বেশি। যুক্তরাজ্যের মতো উন্নত দেশগুলোয় অনেক বছর ধরে লবণ খাওয়ার বিরুদ্ধে সচেতনতা তৈরির চেষ্টা করছেন অধিকার কর্মীরা। এর ফলে হাইপার টেনশন, স্ট্রোকের ঝুঁকি বৃদ্ধি, হার্ট অ্যাটাক, গর্ভবতী নারীদের গর্ভপাত হওয়ার ঝুঁকির কথা বলেছেন। সেখানে আমরা লবণ ও লবণাক্ততাকে লালন করছি।

ঋতুস্রাব চলাকালে লোনা ও নোংরা পানির ব্যবহার কমাতে জন্মনিয়ন্ত্রণকরণ পিল খেয়ে মাসিক বন্ধ করছে দক্ষিণাঞ্চলীয় উপকূলের কিশোরীরা। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চিকিৎকের পরামর্শ ছাড়া মাসের পর মাস এ ধরনের পিল খাওয়া স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। তবে বিষয়টি কিশোরীদের প্রজনন স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর বলে মত দিয়েছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। ‘পিল খেয়ে এক মাস পিরিয়ড বন্ধ করা যেতে পারে। তবে দিনের পর দিন পিরিয়ড বন্ধ রাখলে তার ব্রেনে যেখান থেকে স্টিমুলাস আসে, সেখানে নেগেটিভ ইফেক্ট হবে। একটা সময়ে তার নিয়মিত পিরিয়ড হবে না। যা তাকে বন্ধ্যাত্ব পর্যন্ত নিয়ে যেতে পারে।

এ অঞ্চলের নারীরা ঘর গৃহস্থালি কাজের বাহিরে যেসব অর্থনৈতিক কাজের সঙ্গে জড়িত তার মধ্যে চিংড়ি পোনা ধরা ও মাছের ঘেরে কাজ অন্যতম। পোনা সংগ্রহের কাজে এ এলাকার কয়েক লাখ নারী ও শিশু নিয়োজিত। লবণাক্ত পানিতে নারী ও শিশুদের স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি অনেক বেশি। লবণাক্ত পানির কারণে নারীরা এখন জরায়ু ক্যানসারের মতো জটিল রোগে ভুগছেন।

পানির অভাবে রোজকার খাবার তালিকা থেকে জানা যায়, চার দিনে কোনো পরিবার একবার ডাল, কখনো কখনো একবার মাছ এবং বাকি দিনগুলোতে শুধু আলু বেগুনের ভাজি খেয়ে থাকেন। এমনও সময় আসে তিন বেলাই হয়তো আলু দিয়ে ভাত খেতে হয়। বর্ষা মৌসুমে হয়তো দু-একটা সবজি লাগানো গেলেও বছরের বাকি সময় এখানকার মাটিতে ঘাসও জন্মে না। তাহলে অতো পুষ্টিকর শাক-সবজি কোথায় পাবে? সারা বছর তরকারি কিনে খাওয়ার শক্তি তো সবার থাকে না। তবে নদী বা খালে নামলে টুকটাক খাবার মাছ হয়। দিনে দিনে তাও বিলীন হয়ে যাচ্ছে। কারণ, নদীতে এখন মাছের তুলনায় মাছ ধরার লোক বেশি।

সরকার চাইলে এ এলাকাতে আবার শস্য শ্যামলে ভরে দেবার চেষ্টা করতে পারে। বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থা কাজ করছে কিন্তু তাতে কিছু হবে না, যতোদিন না লোনা জলের মাছের ঘের বন্ধ হবে। 

লেখক: শিক্ষাসংশ্লিষ্ট বেসরকারি উন্নয়ন সহযোগী সংস্থায় টেকনিক্যাল অফিসার 

 

সব প্রাথমিকে তারুণ্যের উৎসবে জুলাই-আগস্ট বিপ্লব নিয়ে কর্মসূচি - dainik shiksha সব প্রাথমিকে তারুণ্যের উৎসবে জুলাই-আগস্ট বিপ্লব নিয়ে কর্মসূচি ভর্তি হয়ে প্রতারিত হলে দায় নেবে না ইউজিসি - dainik shiksha ভর্তি হয়ে প্রতারিত হলে দায় নেবে না ইউজিসি কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে পঞ্চম গণবিজ্ঞপ্তি: কপাল খুললো ভুল চাহিদায় সুপারিশ পাওয়াদের - dainik shiksha পঞ্চম গণবিজ্ঞপ্তি: কপাল খুললো ভুল চাহিদায় সুপারিশ পাওয়াদের কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক - dainik shiksha কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক সরকারি-বেসরকারি স্কুলে ভর্তি আবেদন শেষ হচ্ছে কাল - dainik shiksha সরকারি-বেসরকারি স্কুলে ভর্তি আবেদন শেষ হচ্ছে কাল দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে এসএসসির ফরম পূরণ শুরু রোববার - dainik shiksha এসএসসির ফরম পূরণ শুরু রোববার অনার্স ২য় বর্ষে ফের ফরম পূরণের সুযোগ - dainik shiksha অনার্স ২য় বর্ষে ফের ফরম পূরণের সুযোগ আলামত ধ্বংস বিভাগ থেকে বের হতো প্রশ্ন, কর্মচারী আকরামের স্বীকারোক্তি - dainik shiksha আলামত ধ্বংস বিভাগ থেকে বের হতো প্রশ্ন, কর্মচারী আকরামের স্বীকারোক্তি please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.003173828125