‘অন্ধকার থেকে মুক্ত করুক একুশের আলো’ এই স্লোগান নিয়ে প্রতি বছরের ন্যায় এবারও নড়াইলের সরকারি ভিক্টোরিয়া কলেজের কুড়িরডোব মাঠে ভাষা শহীদদের স্মরণে প্রজ্বলন করা হয়েছে এক লাখ মঙ্গল প্রদীপ। মঙ্গলবার (২১ ফেব্রুয়ারি) সন্ধ্যায় সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় প্রদীপ প্রজ্বলন।
সন্ধ্যা ৬টার দিকে নড়াইলের সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের শিল্পীরা ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি....’ এই গান পরিবেশনের সঙ্গে সঙ্গে মঙ্গল প্রদীপ প্রজ্বলনের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করেন নড়াইলের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান।
স্কয়ার গ্রুপের আর্থিক সহযোগিতায় নড়াইল একুশের আলো উদযাপন পর্ষদ-২০২৩ ভাষা শহীদদের স্মরণে এ মঙ্গল প্রদীপ প্রজ্বলন অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।
কুড়িরডোব মাঠের প্রায় ৬ একর জায়গাজুড়ে হাজারো স্বেচ্ছাসেবীর অংশগ্রহণে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি, শহীদ মিনার, জাতীয় স্মৃতিসৌধ, বাংলা বর্ণমালা, আল্পনাসহ গ্রাম-বাংলার নানা ঐতিহ্য তুলে ধরা হয় প্রদীপ প্রজ্বলনের মধ্য দিয়ে। সেই সঙ্গে ভাষা দিবসের ৭২তম বার্ষিকী উপলক্ষে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ ৭২টি ফানুস উড়িয়ে দেয়।
১৯৯৭ খ্রিষ্টাব্দে সুলতান মঞ্চে ১০ হাজার মোমবাতি প্রজ্বলনের মাধ্যমে এই অনুষ্ঠানের যাত্রা শুরু হয়। পরবর্তী বছর থেকে কুড়িরডোব মাঠে মোমবাতির সংখ্যা বাড়িয়ে লাখের কোটায় আনা হয়। সেই থেকে নড়াইলে ধারাবাহিকভাবে ২৬ বছর ধরে ভাষা শহীদের স্মরণে একুশে ফেব্রুয়ারি পালন করছে মঙ্গল প্রদীপ প্রজ্বলনের মাধ্যমে।
পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন জেলা থেকে আগত হাজার হাজার দর্শনার্থীর ভিড়ে কুড়িরডোব মাঠটি কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায়। মঙ্গল প্রদীপ প্রজ্বলন অনুষ্ঠান জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সব মানুষের মিলনমেলায় পরিণত হয়।
শিক্ষার্থী ওসমান খন্দকার বলেন, ভাষা আন্দোলনে ভাষার জন্য শহীদের সম্মানার্থে নড়াইলে দীর্ঘ দিন ধরে এমন আয়োজনে গর্ববোধ করি। এই দিনটাকে ঘিরে আশপাশের বিভিন্ন জেলা থেকে দর্শনার্থীরা ছুটে আসেন। যেটি খুবই ভালো লাগে।
সন্তানদের সঙ্গে নিয়ে প্রদীপ প্রজ্বলন দেখতে আসা শেখ সাইদুর রহমান বলেন, চাকরিসূত্রে দেশের বিভিন্ন জেলায় থাকার সুযোগ হয়েছে। কিন্তু নড়াইলের মতো এমন আয়োজন আমি আগে কোথাও দেখিনি। বাচ্চাদের দেখাতে নিয়ে আসছি। তারা দেখুক নিজের ভেতর থেকে আগ্রহ জন্মাক আমরা ভাষা শহীদের কেন স্মরণ করি। এ ধরনের আয়োজন কেন হয়? একুশের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করতে সন্তানদের নিয়ে আসছি।
জান্নাতুল ফেরদৌস লিমা বলেন, ভাষা শহীদদের স্মরণে একমাত্র নড়াইলেই এমন আয়োজন হয়। নড়াইলবাসী হিসেবে গর্ববোধ করি।
স্বেচ্ছাসেবকদের দলনেতা জাহিদুল ইসলাম বলেন, সেই প্রথম দিকে আমরা বাড়িতে বাড়িতে মোমবাতি বিক্রি করে অর্থ সংগ্রহ করে এই অনুষ্ঠান করতাম। সেই ক্ষুদ্র চেষ্টা থেকে পর্যায়ক্রম আজ এই বৃহৎ আয়োজন। মুলত মোমবাতি প্রজ্বলন করার আলোটা একটি রূপক আলো। এই আলোর মাধ্যমে ভাষার অন্ধকার (ভাষার বিকৃতি) দূরীভূত হওয়ার পাশাপাশি নিজেদের ভেতরের অন্ধকারও দূরীভূত হোক সেটাই কাম্য। একজন স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে এ ধরনের আয়োজনে নিজেকে সম্পৃক্ত করতে পারাটা অনেক বড় ভাগ্যের ব্যাপার।
একুশের আলো উদযাপন পর্ষদের সাধারণ সম্পাদক ও নাট্যব্যক্তিত্ব কচি খন্দকার বলেন, লাখো প্রদীপ প্রজ্বলনের মাধ্যমে নিজেরা ও জ্বলে উঠি। শান্তিপূর্ণ বসবাসের উপযোগী সুখী সমৃদ্ধশালী বাংলাদেশ গড়ে তোলার জন্য শপথ গ্রহণ করি। শুধু নড়াইলে নয় বাংলাদেশসহ বহির্বিশ্বে নিজেদের সংস্কৃতি রক্ষায় একসঙ্গে কাজ করে আমাদের ঐতিহ্যকে ছড়িয়ে দেই। লাখো মোমবাতি প্রজ্বলনের মাধ্যমে আমরা কুসংস্কার, ধর্মীয় গোঁড়ামি থেকে বের হয়ে অসাম্প্রদায়িক সোনার বাংলা গড়ি, যা আমাদের ভাষা শহীদরাও চেয়েছিলেন।
জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান বলেন, ভেদাভেদ ভুলে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, নানা শ্রেণিপেশার মানুষ, শিক্ষিত সমাজসহ সাধারণ নাগরিকরা মোমবাতির একটি শিখা প্রজ্বলনের জন্য কুড়িরডোব মাঠে সমাবেত হয়েছেন। নড়াইলবাসীর এই লাখো প্রদীপ প্রজ্বলন শুধু দেশেই নয়, আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতির সঙ্গে সঙ্গে সমাজ থেকে কুসংস্কার, সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ নির্মূল হয়ে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির সোনার বাংলা গড়ার লক্ষে এ আয়োজন। নড়াইল জেলা হাজারো বছরে ইতিহাস নিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা ক্রীড়া, শিল্প, সংস্কৃতি ও মুক্তিযুদ্ধের একটি জেলা। এমনি করে ধাপে ধাপে নড়াইল জেলা উন্নয়নের সোপানে পৌঁছে যাবে।
নড়াইল একুশের আলো উদযাপন পর্ষদের সভাপতি অ্যাডভোকেট ওমর ফারুকের সভাপতিত্বে ও সরফুল আলম লিটুর উপস্থাপনায় মঙ্গল প্রদীপ প্রজ্বলন অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন জেলা পুলিশ সুপার সাদিরা খাতুন, নড়াইল সরকারি ভিক্টোরিয়া কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর মো. রবিউল ইসলাম, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সদর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান নিজাম উদ্দিন খান নিলু, নড়াইল পৌরসভার মেয়র আঞ্জুমান আরা, একুশের আলো উদযাপন পর্ষদের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সায়েদ আলী শান্ত, নড়াইলের সরকারি বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তা ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব প্রমুখ।