দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে জীবনযাত্রার ব্যয় দিন দিন বাড়ছে। স্বল্প আয়ের মানুষের বেঁচে থাকার জন্য রীতিমতো সংগ্রাম করতে হচ্ছে। শুধু তাই নয়। মরার পরও এ থেকে রেহাই মিলছে না। কারণ মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব পড়েছে লাশের দাফন-কাফনেও, বিশেষ করে রাজধানী ঢাকায়। গত তিন বছরে দফায় দফায় বেড়েছে দাফন-কাফনের ফি। এক্ষেত্রে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের কবরস্থানে দুই ধরনের বাড়তি খরচের চাপে পড়তে হচ্ছে মৃতের স্বজনদের।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) আওতাধীন এলাকার কবরস্থানে সাধারণভাবে দাফনে সর্বনিম্ন ৫,৩৬৫ টাকা গুনতে হচ্ছে। আর ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে (ডিএনসিসি) ৪,৪৭৫ টাকা। দক্ষিণে রেজিস্ট্রেশন ফি ১ হাজার টাকা, বাঁশ-চাটাই বাবদ ৭০৮ টাকা এবং ভালো মানের কাফনের কাপড়ের দাম ৩৫০০ টাকা। অন্যদিকে উত্তর সিটিতে রেজিস্ট্রেশন ফি ৫০০ টাকা, বাঁশ-চাটাই কবরস্থান ভেদে মূল্যও ভিন্ন। খিলগাঁও তালতলা কবরস্থানে বাঁশ-চাটাইয়ের ইজারামূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে বড় কবরের ক্ষেত্রে ৪৭৫ টাকা। অর্থাৎ রেজিস্ট্রেশন ফিসহ খিলগাঁও কবরস্থানে দাফন করতে খরচ করতে হচ্ছে ৪ হাজার ৪৭৫ টাকা।
দক্ষিণ সিটিতে একটি সংরক্ষিত কবরে পুনরায় পরিবারের কাউকে সমাহিত করতে চাইলে রেজিস্ট্রেশন ফি ৫০ হাজার টাকা। এক্ষেত্রে সিটি করপোরেশনের অনুমতি প্রয়োজন হয়। আজিমপুর কবরস্থানে পছন্দের কবরে দাফন করতে চাইলে খরচ বেড়ে দ্বিগুণ হয়ে যাচ্ছে, বলছেন স্থানীয়রা। কবরস্থানের প্রধান ফটকের কাছাকাছি বা সামনের দিকে কবর দিতে চাইলে রেজিস্ট্রেশন ফি হয়ে যায় ৫ হাজার টাকা। সিটি করপোরেশন নির্ধারিত ফির বাইরে এ টাকা নিয়ে থাকে ইজারাদার প্রতিষ্ঠানগুলো।
এ প্রসঙ্গে মানবাধিকার কর্মী মো. আমজাদ শেখ বলেন, দাফন-কাফনের খরচ অনেক বেড়ে গেছে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের বর্তমান মেয়র দায়িত্ব গ্রহণের পর রেজিস্ট্রশন ও বাঁশ-চাটাইসহ ২২১০ টাকা করেছিল। সাধারণ মানুষের কথা চিন্তা করে প্রতিবাদ করা হয়। এরপর রেজিস্ট্রেশন ফিসহ খরচ নির্ধারণ করা হয় ১৭০৮ টাকা। আর কাফনের কাপড় আগে ১৫০০ টাকায় পাওয়া যেত। সেই কাপড় এখন ৩৫০০ টাকা। অর্থাৎ দ্বিগুণ হয়ে গেছে।
তার দেওয়া তথ্যের সত্যতা মেলে আজিমপুর কবরস্থানের ১নং গেটের সামনের শেষ বিদায় স্টোরের মালিক মো. সাইদ উদ্দিনের কথায়। তিনি বলেন, আমার বাবার এই ব্যবসা ছিল। আমি ১৯৮২ খ্রিষ্টাব্দ থেকে কাফনের কাপড় বিক্রি করি। এবারের মতো এত দাম কখনোই ছিল না। এখন পুরুষ মৃতদেহের জন্য পুরো প্যাকেজ কাপড় (প্যাকেজে একজন মানুষের দাফনের জন্য যতটুকু কাপড় লাগে, আগরবাতি, গোলাপজল, কর্পুরসহ) ৩৫০০ টাকা। আর নারীর কাপড়ের মূল্য ৩৭০০ টাকা। এই কাপড় এক বছর আগেও ছিল ১৫০০ টাকা। এবার দাফনের কাপড়সহ সবকিছুর দামই বেড়েছে।
ডিএনসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. সেলিম রেজা বলেন, কবর সংরক্ষণকে নিরুৎসাহিত করতেই সংরক্ষণ ফি বাড়ানো হয়েছে। ঢাকা শহরে নতুন করে জায়গা পাওয়া দুষ্কর। কবরস্থান সংরক্ষণের যে পরিমাণ চাহিদা, তাতে দর না বাড়ালে ভবিষ্যতে কবর দেওয়ার জায়গা থাকবে না। মূলত কবর সংরক্ষণ নিরুৎসাহিত করতেই দাম বাড়ানো হয়েছে। আর বাঁশ-চাটাইয়ের দাম আগে যা ছিল, এখনো তাই আছে।
ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে নির্ধারিত কবরস্থান উত্তরে ৬টি, দক্ষিণে ৩টি। প্রতিটি কবরস্থানে সিটি করপোরেশনের নির্ধারিত ফরমে আবেদন করে বোর্ড সভায় অনুমোদন সাপেক্ষে কবর সংরক্ষণ করার সুযোগ রয়েছে। কবরস্থানের জায়গা সংকুলান না হওয়ায় ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন সংরক্ষণ করা নিরুৎসাহিত করতে সংরক্ষণ ফি বাড়িয়েছে বহুগুণ। এখন বনানীতে একটি কবর ২৫ বছরের জন্য কেউ সংরক্ষণ করতে চাইলে তাকে দেড় কোটি টাকা দিয়ে সংরক্ষণ করতে হবে। অন্যদিকে দক্ষিণ সিটিতে ২৫ বছরের জন্য সংরক্ষণ ফি মাত্র ২৫ লাখ টাকা।
দুই সিটি করপোরেশনের আওতাধীন কবরস্থানের সংরক্ষণ ফি দুই রকম। ঢাকা দক্ষিণে ১০ বছরের জন্য কেউ কবর সংরক্ষণ করতে হলে ৫ লাখ টাকা ফি দিয়ে অনুমতি নিতে হবে। এছাড়া ১৫ বছরের জন্য ১০ লাখ, ২০ বছরের জন্য ১৫ লাখ এবং ২৫ বছরের জন্য ২০ লাখ টাকা। অন্যদিকে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের বনানী কবরস্থানে ১৫ বছর মেয়াদি সংরক্ষণ ফি ১ কোটি টাকা, ২৫ বছরের জন্য ১ কোটি ৫০ লাখ টাকা। উত্তরা ৪নং সেক্টর কবরস্থানে ১৫ বছরের জন্য সংরক্ষণ ফি ৭৫ লাখ, ২৫ বছরের জন্য ১ কোটি টাকা, উত্তরা ১২নং সেক্টর কবরস্থানে ১৫ বছর মেয়াদি সংরক্ষণ ফি ৫০ লাখ টাকা, ২৫ বছর মেয়াদি সংরক্ষণ ফি ৭৫ লাখ টাকা, উত্তরা ১৪নং সেক্টর কবরস্থানে সংরক্ষণ ফি ১৫ বছরের জন্য ৩০ লাখ, ২৫ বছরের জন্য ৫০ লাখ, মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে ১৫ বছর মেয়াদি সংরক্ষণ ফি ২০ লাখ, ২৫ বছর মেয়াদি সংরক্ষণ ফি ৩০ লাখ এবং রায়েরবাজার স্মৃতিসৌধ সংলগ্ন কবরস্থানে ১৫ বছরের সংরক্ষণ ফি ১০ লাখ এবং ২৫ বছরের সংরক্ষণ ফি ১৫ লাখ টাকা।