শিক্ষার্থী সংকটে খাঁ খাঁ করছে শিক্ষানগরী হিসেবে পরিচিত ময়মনসিংহ নগরীর শতবর্ষী ৪ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এগুলোতে পড়ুয়ার চেয়ে শিক্ষক ও কর্মচারীর সংখ্যাই এখন অধিক। তারা স্কুলে এসে অলস সময় কাটালেও সরকারি তহবিল প্রতিমাসে ঠিকই তুলে নিচ্ছেন লাখ লাখ টাকা।
এক সময় এসব স্কুল মুখরিত থাকতো শিক্ষার্থীদের পদচারণায়। এসব স্কুল থেকে তৈরি হয়েছেন দেশের প্রেসিডেন্ট, মন্ত্রী, এমপি, সাংবাদিক, সচিবসহ অনেক খ্যাতিমান ব্যক্তি। কিন্তু ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর দশা এখন বেহাল।
সম্প্রতি সরেজমিনে ঘুরে ১৪০ বছরের পুরনো সিটি কলেজিয়েট স্কুল, ১২০ বছরের পুরনো অ্যাডওয়ার্ড ইনস্টিটিউশন, ১২০ বছরের পুরনো মৃত্যুঞ্জয় স্কুল এবং ৯৬ বছরের পুরনো রাধা সুন্দরী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে এমন বেহাল চিত্র দেখা গেছে।
যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আপগ্রেড হতে না পারা, শিক্ষকদের উদাসীনতা এবং শিক্ষক ও কমিটির দ্বন্দ্বে এসব ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের এমন হাল বলে অভিযোগ রয়েছে। যদিও নগরীতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে গড়ে ওঠা নন এমপিও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষার্থীদেরকে এসব শতবর্ষী স্কুলে ভর্তি দেখিয়ে সরকারি বই তোলা হচ্ছে। এসব ভাড়া করা শিক্ষার্থীদের অর্থের বিনিময়ে বোর্ড পরীক্ষাতেও অংশ নেয়ার সুযোগ দেয়া হচ্ছে।
সিটি কলেজিয়েট স্কুল
ভারতীয় উপমহাদেশের প্রথম র্যাংলার আনন্দমোহন বসুর পৈত্রিক ভিটায় প্রায় এক একর জমিতে ১৮৮৩ খ্রিষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠা হয় সিটি কলেজিয়েট স্কুল। শুরুতে আনন্দমোহন ইনস্টিটিউশন নাম দিয়ে প্রতিষ্ঠানটির যাত্রা শুরু হয়। এটিতে প্রথম শ্রেণি থেকে উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণিতে পাঠ চালু হয়। কিন্তু এটি ডিগ্রি পর্যন্ত উত্তীর্ণ করা হলে জায়গা সংকুলান না হওয়ায় উচ্চ মাধ্যমিক ও ডিগ্রি শাখা স্থানান্তরিত হয় কাঁচিঝুলিতে বর্তমান আনন্দমোহন কলেজে। স্কুল আলাদা রাখতে গিয়ে তৎকালীন নিয়ম অনুযায়ী একই শহরে এক ব্যক্তির নামে দুটি প্রতিষ্ঠান থাকার সুযোগ ছিলো না। ফলে আনন্দমোহন বসুর কোলকাতার সিটি কলেজিয়েট স্কুল অ্যান্ড কলেজের শাখা হিসেবে ১৯০১ খ্রিষ্টাব্দে ময়মনসিংহে নিজ ভিটের শিক্ষালয়টির নাম দেওয়া হয় সিটি কলেজিয়েট স্কুল। এই শাখার প্রথম প্রধান শিক্ষক ছিলেন গিরিশ চন্দ্র চক্রবর্তী। নব্বই দশক পর্যন্ত ময়মনসিংহ নগরীর নামকরা এই স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা ও ফলাফল ছিল অভাবনীয়। কিন্তু এখন চিত্র উল্টো।
স্কুল কর্তৃপক্ষের তথ্যমতে, প্রথম থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত এখন শিক্ষার্থী রয়েছেন ৩১৪ জন। এমপিওভুক্ত শিক্ষক আছেন ৯ জন, খণ্ডকালীন শিক্ষক ২ জন এবং কর্মচারী আছেন ৫ জন। কাগজপত্রে ৩১৪ জন শিক্ষার্থী থাকলেও বাস্তবে স্কুলটিতে তার নমুনা দেখা যায়নি। সম্প্রতি হওয়া নতুন ভবনের দুটি কক্ষে সম্প্রতি গিয়ে একটিতে মাত্র একজন এবং অপরটিতে ৩ জন শিক্ষার্থীর দেখা মেলে। অথচ নব্বই দশকেও স্কুলটিতে প্রায় ৮০০ শিক্ষার্থী নিয়মিত পাঠ নিতেন।
শিক্ষকরা জানান, শিক্ষার্থী কম থাকলেও স্কুলের আয় কম নয়। বিশাল মার্কেট গড়ে তোলা হয়েছে। সেখান থেকে আসছে মোটা অংকের দোকান ভাড়া।
বিদ্যালয়টির সিনিয়র শিক্ষক মো. নুরুল ইসলাম দৈনিক আমাদের বার্তাকে জানান, কিন্তু কমিটি নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে স্কুলটির অবস্থা দিনদিন অবনতির দিকে গেছে।
বিদ্যালয়টির প্রধান শিক্ষক টিআইএম বদরুদ্দৌলা সিদ্দিক ফরহাদ দৈনিক আমাদের বার্তাকে বলেন, আশপাশে স্বীকৃতি ছাড়া স্কুল হওয়ায় এখানে শিক্ষার্থী কমে গেছে।
অ্যাডওয়ার্ড ইনস্টিটিউশন
১৯০৩ খ্রিষ্টাব্দে স্থাপিত হয় অ্যাডওয়ার্ড ইনস্টিটিউশন। প্রথম শ্রেণি থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের পাঠদানের সুযোগ রয়েছে এ বিদ্যালয়ে। আছে প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য বিশেষ শিক্ষা কার্যক্রম। কিন্তু, তিনতলা ভবনের বিশাল বিদ্যালয়টির প্রায় প্রতিটি কক্ষই এখন শিক্ষার্থী শূন্য।
সরেজমিন বিদ্যালয়টিতে গিয়ে দেখা যায়, মিলনায়তনে আড্ডায় মশগুল শিক্ষকরা। প্রধান শিক্ষকের কাছে শিক্ষার্থীদের পরিসংখ্যান জানতে চাইলে তিনি বলতে অনিহা প্রকাশ করেন। যদিও খাতাপত্রে প্রতিষ্ঠানটিতে প্রাথমিক শাখায় ৮৮ জন এবং মাধ্যমিকে ২৮১ জন শিক্ষার্থী রয়েছেন বলে দেখা গেছে। কিন্তু, বাস্তবে শিক্ষার্থী খুবই নগন্য। আশির দশকে স্কুলটিতে শিক্ষার্থী ছিলেন হাজারের বেশি।
মৃত্যুঞ্জয় স্কুল
১৯০১ খ্রিষ্টাব্দে বিশিষ্ট শিক্ষানুরাগী ও আইনজীবী প্রয়াত অনাথ বন্ধু গুহ তার বাবা মৃত্যুঞ্জয় গুহের নামে ব্রহ্মপুত্র পাড়ে মৃত্যুঞ্জয় স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। আশির দশক পর্যন্ত স্কুলটির ছাত্র সংখ্যা ও ফলাফল ছিলো ঈর্ষণীয়। উপমহাদেশের প্রখ্যাত সাংবাদিক, সাহিত্যিক ও রাজনীতিক প্রয়াত আবুল মনসুর আহম্মদ ছিলেন এই স্কুলের প্রথম মুসলিম ছাত্র। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন, প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান, সাবেক রাষ্ট্রপতি ও প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহম্মদ, বিশিষ্ট সাংবাদিক বজলুর রহমান, কথা সাহিত্যিক রাহাত খান, বর্তমান সংসদের বিরোধী দলের নেতা বেগম রওশন এরশাদের বাবা খান বাহাদুর উমেদ আলী, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের প্রধান ড. অরবিন্দ গোস্বামী, সাবেক ধর্মমন্ত্রী অধ্যক্ষ মতিউর রহমানসহ অবিভক্ত ভারতের বহু খ্যাতিমান সাহিত্যিক, রাজনীতিক, সাংবাদিক, আইনজীবী ও পদস্থ কর্মকর্তা এই স্কুলের ছাত্র ছিলেন।
বর্তমানে প্রথম শ্রেণি থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষা কার্যক্রম চালু আছে স্কুলটিতে। কাগজপত্রে এখন শিক্ষার্থী আছেন ৫১৭ জন। জেনারেল শাখায় ১৬ জন, ভোকেশনাল শাখায় ১১ জন ও প্রাথমিক শাখায় ১০ জন শিক্ষক এবং ৪ জন কর্মচারী রয়েছেন। তবে সরেজিমেন স্কুলটিতে হাতে গোনা কজন শিক্ষার্থীর দেখা মিলেছে।
বিদ্যালয়টির প্রধান শিক্ষক রুকুন উদ্দিন দৈনিক আমাদের বার্তাকে বলেন, শিক্ষার্থী কমে যাওয়ার কারণ স্কুলের পাশের রাস্তা বন্ধ হয়ে যাওয়া, শিক্ষকদের গ্রুপিং, পাঠদানে অনিহা ইত্যাদি। এলাকার মানুষও সহযোগিতা প্রবণ নয়।
রাধা সুন্দরী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়
জমিদার অঘোরবন্ধু গুহ তার মা রাধা সুন্দরীর নামে ১৯২৭ খ্রিষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠা করেন রাধা সুন্দরী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়। বর্তমানে ৮ জন শিক্ষক ও ৩ জন কর্মচারী রয়েছেন স্কুলটিতে। প্রধান শিক্ষকসহ বেশ কয়েকটি পদ শূন্য। কাগজপত্রে বিদ্যালয়টিতে প্রথম শ্রেণি থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থী আছেন ২১০ জন। কিন্তু বাস্তবে চিত্র ভিন্ন। ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষককে নিয়ে শ্রেণি কক্ষের অবস্থা দেখতে গেলে, দুইটি শ্রেণিকক্ষে দুজন ছাড়া বাকি ক্লাস ফাঁকা পাওয়া যায়। সপ্তম শ্রেণিতে লিসা হরিজন ও দশম শ্রেণিতে ঝুমা আক্তার নামে দু’জন শিক্ষার্থী পাওয়া যায়। কিছুক্ষণ স্কুলে অবস্থান করার পর বেলা ১১টার দিকে আরও তিনজন শিক্ষার্থী আসতে দেখা যায়।
তাদের মধ্যে সপ্তম শ্রেণির তায়েবা আক্তার নীলা দৈনিক আমাদের বার্তাকে জানান, তাদের ক্লাসে বড়জোড় ৭ জন ছাত্রী ক্লাসে আসেন। নুসরাত জাহান নূর ও সাবিকুন নাহার জানান, তাদের ক্লাসে শিক্ষার্থী আসেন ৪ জন।
ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক কাজীম উদ্দিন দৈনিক আমাদের বার্তাকে বলেন, প্রথম থেকে দশম শ্রেণির অনুমোদনের কাগজ হারিয়ে গেছে। সে কারণে প্রাথমিকের শিক্ষক নেই একজনও। এতে শিক্ষার্থী খুব কম। ২০০২ খ্রিষ্টাদ্বের দিকে কমিটির সঙ্গে দ্বন্দ্বে তৎকালীন প্রধান শিক্ষক স্কুল ছেড়ে চলে গেলে আর ঘুরে দাঁড়ানো যায়নি।
শিক্ষার সব খবর সবার আগে জানতে দৈনিক শিক্ষার ইউটিউব চ্যানেলের সাথেই থাকুন। ভিডিওগুলো মিস করতে না চাইলে এখনই দৈনিক শিক্ষাডটকমের ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন এবং বেল বাটন ক্লিক করুন। বেল বাটন ক্লিক করার ফলে আপনার স্মার্ট ফোন বা কম্পিউটারে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ভিডিওগুলোর নোটিফিকেশন পৌঁছে যাবে।
দৈনিক শিক্ষাডটকমের ইউটিউব চ্যানেল SUBSCRIBE করতে ক্লিক করুন।