১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দে শহীদ নুরুল ইসলাম ছিলেন রাজশাহী সিটি কলেজের ছাত্র। করতেন পূর্ব পাকিস্থান ছাত্র ইউনিয়ন। সংগঠনের সম্মেলনে ঢাকা যান। ১১ দফা আন্দোলন তখন তুঙ্গে। একটি মিছিলে থাকা ঢাকা নবরূপ স্কুলের ছাত্র মতিউর শহীদ হলে তার রক্তে লাল হয়ে যায় ছাত্রনেতা নুরুল ইসলামের পোষাক। শহীদ মতিউরের লাশ নিয়ে ঢাকা কাঁপিয়ে দেন ছাত্র নেতা নুরুল ইসলাম। রাজশাহী ফিরে আন্দলনকে তীব্র করতে থাকেন। ১৭ ফেব্রুয়ারি সার্জেন্ট জহুরুল হক হত্যার ও গণ নির্যাতনের প্রতিবাদে পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পালিত হয় ধর্মঘট। এই দিন বিকেলে পুলিশের লাঠিচার্জ ও কাঁদানে গ্যাসে আহত হন ১৬ জন ছাত্র। খবর পেয়ে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তৎকালীন প্রক্টর, রসায়ন বিভাগের শিক্ষক প্র. ড. সৈয়দ মোহাম্মদ শামসুজ্জোহা আহত ছাত্রদের কাছে এসে তাদের বুকে টেনে নিয়ে ঘটনার প্রতিবাদ জানান। আহত ছাত্রদের নিজের গাড়িতে হাসপাতালে পৌঁছে দিয়ে বলেন, ভয় নেই আমরা আছি তোমাদের পাশে…বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষা দিবসের কর্মসুচি রূপ নিলো প্রতিবাদ সভায়। রাত ১০টায় কলা ভবনের সামনে শহীদ মিনারে প্রতিবাদ সভায় তিনি বক্তব্যে অন্যায়ের প্রতিবাদে থাকার শপথ নিলেন। ১৮ ফেব্রুয়ারি জারি করা হয় ১৪৪ ধারা। নামানো হয় ইপিআর, সেনাবাহিনী। ১৪৪ ধারা ভেঙে রাজশাহী জেলা সদরের মধ্য শহরে ছাত্র জনতার আন্দোলন তখন তীব্র।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ১৪৪ ধারা ভেঙে মধ্যশহরে আসার প্রস্তুতি নিলে বিশ্ববিদ্যালয়ের মেইন গেটের সামনে থাকা সেনাবাহিনীর অফিসাররা শিক্ষক ছাত্রদের অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করতে থাকে। এক অফিসার গুলির নির্দেশ দেয়। সেখানে গিয়ে চিৎকার করে বলেন, প্লিজ ডোন্ট ফায়ার, আমার ছাত্ররা ভেতরে চলে যাবে। সে সময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন সেনাবাহিনীর লেফটেন্যান্ট কর্নেল এম এস আলি আশরাফ। ছাত্ররা যখন ক্যাম্পাসে ফিরছে, সেখানে সেনাবাহিনীর উপস্থিতি ছাত্রদের একটি অংশ ছাত্ররা সহ্য করতে না পেরে সেনাবাহিনীর লেফটেন্যান্ট খাদেম শাহ-এর অস্ত্র নিয়ে নেবার চেষ্টা করলে ধস্তাধস্তি শুরু হয়। লেফটেন্যান্ট মিনু লেফটেন্যান্ট খাদেম শাহ্কে সৈনিকদের প্রস্তুত করতে বললে লেফটেন্যান্ট খাদেম শাহ্ বাঙালি এক সৈনিকের কাছে থাকা মার্কফোর রাইফেল নিয়ে গুলি চালান। গুলি প্র. ড. শামসুজ্জোহার শরীরের মধ্যে পেঁচিয়ে ঢুকে বেয়েনট চার্জের মতো ক্ষতবিক্ষত করে ফেলে। আহত হন প্র. ড. আব্দুল খালেক (সাবেক উপাচার্য) প্র. ড. কছিমউদ্দিন মোল্লা, প্র. ড. আব্দুল মান্নান প্রমুখ। আহত শিক্ষকরা উপস্থিত ম্যাজিস্ট্রেট নাসিমকে প্র. ড. পাঠানোর জন্য অনুরোধ করলে তারা তা উপেক্ষা করে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়। এই খবর মধ্য শহরে আন্দোলনকারীদের কাছে এলে তারা উত্তেজিত হয়ে ওঠেন। তৎকালীন পৌরসভা ভবনের ছাদে থাকা ইপিআর বাহিনী গুলি চালালে সোনাদীঘি মসজিদের সামনে ছাত্রনেতা নুরুল ইসলাম শহীদ হন। তাকে রাস্তায় পা ধরে টেনে এনে পৌরসভা ভবনে রাখা হয়। মিছিলে আসা বড় ভাই আব্দুল আজিজকে (বীর মুক্তিযোদ্ধা) খুঁজতে এসে বন্ধু মসলেমসহ অন্যান্যদের সঙ্গে আসা হাজী মুহাম্মদ মুহাসীন হাইস্কুল (হাজী মুহাম্মদ মুহাসীন হাই মাদ্রাসা) সপ্তম শ্রেণির ছাত্র আব্দুল সাত্তার রাজশাহী কলেজের মহিলা হোস্টেলের পাশে গুলিবিদ্ধ হলে তাকে টেনে পৌরসভা ভবনে আনলে এক গাড়িচালক কৌশলে তাকে চেনে বলে হাসপাতালে পাঠিয়ে দেন। তার বন্ধু মোসলেম ও সেদিন আহত হন। প্র. ড. সামসুজ্জহাকে খোলা গাড়িতে করে এনে পৌরসভা ভবনের একটি ঘরে এবং আহত শিক্ষকদের আরেকটি ঘরে বন্দি রাখা হয়।
এখানে প্র. ড. কছিমউদ্দিন মোল্লা অজ্ঞান হয়ে গেলে প্র. ড. আব্দুল খালেক সুইপারদের দিয়ে সোনাদিঘি থেকে পানি আনিয়ে তার মুখে ছিটিয়ে তার জ্ঞান ফিরান। তাদের প্রতিবাদে হাসপাতাল থেকে ডাক্তার আনা হয়। তারা প্র. ড. শামসুজ্জোহাকে দ্রুত হাসপাতালে নিতে বললে তাকে সেখানে নেয়া হয়। তিনি সেখানে বলেন, তাড়াতাড়ি তাকে নিয়ে আসলে তিনি বেঁচে যেতেন। লাশ নিতে শহীদ নুরুল ইসলামের বাবকে শর্ত দেয়া হয়। প্র. ড. শামসুজ্জহা রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে মারা যান। তার লাশ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে নিয়ে গেলে ছাত্র জনতার ভিড় বাড়তে থাকে। আহত বন্দি শিক্ষকদের মুক্তি দিয়ে রেডক্রোসের গাড়িতে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে পৌঁছে দেয়া হয়। রাজশাহীর খবরে সারা দেশ কেঁপে ওঠে।
লৌহমানব খ্যাত প্রেসিডেন্ট ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান ক্ষমতা ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। পাল্টে গেলো রাজনৈতিক পরিস্থিতি। মুক্তি পেলেন বাঙালিদের অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবর রহমান। তাকে দেয়া হলো বঙ্গবন্ধু উপাধি। আহত ছাত্র আব্দুস সাত্তারের শরীরে পচন ধরে ছয় মাস চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান। এখানেই শেষ নয়, শহীদ নুরুল ইসলামের বাবা এই অপরাধে রেলওয়ে কলোনির অবাঙালি আমজাদ রেলওয়েতে কর্মরত সুফি আব্দুল কুদ্দুসকে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পূর্ব মুহূর্তে ২০ এপ্রিল হত্যা করেন। অবাঙালিরা তার বাড়িতে লুটপাটের সময় তার আরেক সন্তান রেজাউল করিমকে নির্যাতন করেন। পরিবারটিতে দেখা দিলো সংকট। সব কিছু মেনে নিয়ে তারা স্বাধীনতার জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন। স্বাধীনতা লাভের পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান ও জাতীয় চার নেতার অন্যতম প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের স্বরাষ্ট্র ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রী, বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ এ. এইচ. এম. কামরুজ্জামান হেনা এই দুই পরিবারের খোঁজখবর রাখতেন। ১৯৭৫-এ বঙ্গবন্ধু হত্যার পরের দিন নুরুল ইসলামের ভাই সৈয়দ আব্দুল্লাহ হারুনকে কতিপয় ব্যক্তি ধরে নিয়ে গিয়ে নির্যাতন করেন। পরের বছর ২৬ জুলাই তিনি মারা যান। তাদের পরিবারের অভিযোগ ১৯৭৫-এর হত্যাকাণ্ডের পর এই দুই পরিবারের কেউ খোঁজ রাখেনি।
জানা যায় মুক্তিযোদ্ধা, ন্যাপ নেতা অ্যাড. এম আতাউর রহমান, ন্যাপ ও কমিউনিস্ট পার্টির নেতা-কর্মীরা নানাভাবে পরিবার দুটির খোঁজখবর নিতেন। কিন্তু সেটিও বন্ধ হয়ে যায়। শহীদ নুরুল ইসলামের ছোট ভাই সিদ্দিকুর রহমানকে বীর মুক্তিযোদ্ধা রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান পুলিশ বিভাগে চাকরি দেন। কিন্তু বিরোধের কারণে সেই চাকরি ছেড়ে তিনি রেলওয়েতে যোগ দেন। তারও রহস্যজনক মৃত্যু হয়। পরিবারটির সংকট তীব্র হতে থাকে। রোগে শোকে ১৯৯০ খ্রিষ্টাব্দে মারা গেলেন শহীদ নুরুল ইসলামের মা সৈয়দা আয়েশা সিদ্দিকা। এই পরিবারটি শহীদ জননী জাহানারা ইমাম ও ভাষা সৈনিক শহীদ আবুল বরকতের স্বজন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ একটি ছাত্রাবাসের নামকরণ করেন শহীদ প্র. ড. শামসুজ্জোহার নামে। তৎকালীন রাজশাহী পৌরসভা শহীদ আব্দুস সাত্তারের স্মরণে জেলা সদরের পাঠানপাড়ায় একটি রাস্তার নামকরণ করেন। কিন্তু নামফলকটির এখন আর অস্তিত্ব নেই। শহীদ নুরুল ইসলাম হাজী মুহাম্মদ মুহাসীন হাইস্কুল (হাজী মুহাম্মদ মুহসীন হাই মাদরাসা) এর ছাত্র ছিলেন। সাবেক সংসদ সদস্য ফজলে হোসেন বাদশাহর চেষ্টায় কর্তৃপক্ষ এখানকার ছাত্রাবাসের নাম শহীদ নুরুল ইসলাম-শহীদ আব্দুস সাত্তারের নামে নামকরণ করেন। জানা গেছে রাজশাহী সিটি কলেজ কর্তৃপক্ষ শহীদ নুরুল ইসলামকে স্মরণীয় করে রাখতে উদ্যোগ নিয়েছে। ১৮ ফেব্রুয়ারি শিক্ষক-ছাত্র দিবস ঘোষণার দাবি দীর্ঘদিনের। এই দিন শিক্ষক-ছাত্রের রক্তে স্বাধীনতার আন্দোলন তথা মুক্তিযুদ্ধের ফলক রচিত হয়।
লেখক: মুক্তিযুদ্ধের তথ্য সংগ্রাহক।
দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেল SUBSCRIBE করতে ক্লিক করুন।