আব্দুল জলিল শিক্ষক নন তবুও এমপিওভুক্ত হয়েছেন গত জুন মাসে। ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলার এ বাসিন্দা স্থানীয় একটি মাদরাসার শিক্ষক হিসেবে এমপিওভুক্ত হলেও তিনি শিক্ষক পদে নিয়োগ সুপারিশ পাননি, অর্জন করেননি শিক্ষক নিবন্ধন সনদও। এরপরও এমপিওভুক্ত হয়েছেন, পেয়েছেন ইনডেক্স। তিনি বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষের (এনটিআরসিএ) নিয়োগ সুপারিশ পত্র, শিক্ষক নিবন্ধন সনদ ও প্রতিষ্ঠানের রেজুলেশন, যোগদান ও নিয়োগ পত্র জাল করে এমপিওভুক্ত হয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। চাঞ্চল্যকর এ ঘটনা যা জানতে পেরে মাথায় হাত পড়েছে শিক্ষা প্রশাসনের কর্তাদের। বিষয়টি খতিয়ে দেখার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।
জানা গেছে, গত জুন মাসে ত্রিশাল উপজেলার উজানপাড়া এতিমখানা আলিম মাদরাসার সহকারী মৌলভী হিসেবে এমপিওভুক্ত হয়েছেন আব্দুল জলিল। তার ইনডেক্স নম্বর এম ০০৩৯২৩৭। কিন্তু মাদরাসা কর্তৃপক্ষ বলছে, তিনি প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষক নন। শিক্ষক না হয়েও তিনি এমপিওভুক্ত হয়েছেন জালিয়াতি করে। বিষয়টি জানিয়ে মাদরাসা শিক্ষা অধিদপ্তর, এনটিআরসিএ, স্থানীয় মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসসহ বিভিন্ন জায়গায় অভিযোগ দিয়েছেন প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ।
জানতে চাইলে গতকাল বুধবার ওই মাদরাসার অধ্যক্ষ মো. উসমান গনি দৈনিক আমাদের বার্তাকে বলেন, আব্দুল জলিলকে আমাদের প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক নন। তাকে আমি চিনি, তার বাড়ি মাদরাসার পাশেই। তবে শিক্ষক না হয়েও তিনি এমপিওভুক্ত হয়েছেন, যা গত জুনের এমপিও শিট থেকে জানতে পারি। বিষয়টি জানতে পেরে সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোতে অভিযোগ দিয়েছি। এনটিআরসিএতে তার সনদ যাচাইয়ের জন্য পাঠিয়েছি। মাদরাসা শিক্ষা অধিদপ্তর ও উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তাকেও বিষয়টি অবগত করেছি। বিষয়টি খতিয়ে দেখতে তদন্ত কমিটি গঠন করেছি। আর শিক্ষক না হয়েও এমপিও শিটে তিনি শিক্ষক হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন বিধায় তাকে বরখাস্ত করার প্রক্রিয়া শুরু করেছি। তার বেতনের বিল করা হয়নি, তিনি বেতনের টাকা তুলতে পারেননি।
অধ্যক্ষ আরো জানান, আব্দুল জলিল নিজেকে তৃতীয় গণবিজ্ঞপ্তিতে সুপারিশপ্রাপ্ত দাবি করে এমপিওভুক্ত হয়েছেন। তবে তিনি মাদরাসায় যোগদান করেননি। যোগদান না করেও জাল-জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে এমপিওভোগ করছেন। তিনি ২০১২ খ্রিষ্টাব্দে একবার মাদরাসায় শিক্ষকতার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু সনদ জাল থাকায় এমপিওভুক্ত হতে পারেননি। পরে হাল ছেড়ে মাদরাসায় আসা বন্ধ করে দেন। জুন মাসে এমপিও শিটে তার নাম দেখতে পেয়ে অবাক হয়েছি।
শিক্ষক না হলেও তার এমপিওভুক্তির আবেদন প্রতিষ্ঠান থেকে মাদরাসা শিক্ষা অধিদপ্তরের এমপিও সার্ভার মেমিসে কীভাবে করা হলো জানতে চাইলে অধ্যক্ষ উসমান গনি জানান, সেটা বুঝতে পারছি না। তিনি শিক্ষক না হয়েও সুপারিশ পত্র, শিক্ষক নিবন্ধন সনদ, প্রতিষ্ঠানের যোগদানপত্র, নিয়োগপত্র সব দিয়ে আমারই পাসওয়ার্ড ব্যবহার করে মেমিসে আবেদন করা হয়েছে। আমাদের প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা শিক্ষা অফিসের রাইসুল নামের একজন কর্মচারীর মাধ্যমে এমপিওভুক্তির আবেদন করেন। তার কাছে পাসওয়ার্ড ছিলো। সেখান থেকেই তিনি এমপিওভুক্তির আবেদন করেছেন বলে ধারণা করছি।
এ বিষয়ে দৈনিক আমাদের বার্তার সঙ্গে কথা হয় ত্রিশাল উপজেলার মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. মফিজুল ইসলামের। তিনি বলেন, ওই লোক মেমিসে প্রতিষ্ঠানের পাসওয়ার্ড ব্যবহার করে এমপিওর আবেদন করেছিলেন। আমরা তা অগ্রায়ণ করেছি। পরে প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ জানান তিনি শিক্ষক নন।
অগ্রায়ণের আগে যাচাই করা হয়েছিলো কি না জানতে চাইলে শিক্ষা কর্মকর্তা আরো বলেন, প্রতিষ্ঠান থেকে আবেদন পাঠানোয় বিষয়টি তেমনভাবে যাচাই করা হয়নি। তার আবেদনের সঙ্গে প্রতিষ্ঠানের প্যাডে যোগদান পত্র, নিয়োগপত্র ছিলো, প্রতিষ্ঠানের রেজুলেশনও ছিলো। এসব দেখে বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়েছে। আসলে রুটি-রুজির বিষয় হওয়ায় পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। প্রতিষ্ঠান থেকে তার ইনডেক্স কর্তনের আবেদন করলে তারা ইনডেক্স বন্ধ করে দেয়া হবে।
তিনি বলেন, আসলে ভালো করতে গেলেও মাঝে মধ্যে খারাপ হয়ে যায়, এ ঘটনার মাধ্যমে এ অভিজ্ঞতা হলো।
আব্দুল জলিল যে শিক্ষক নিবন্ধন সনদ নিয়ে শিক্ষকতা করছেন সেটি জাল বলে ইতোমধ্যে জেনেছে এনটিআরসিএ। এনটিআরসিএর পরীক্ষা মূল্যায়ন ও প্রত্যয়ন শাখার সহকারী পরিচালক তাজুল ইসলাম দৈনিক আমাদের বার্তাকে বলেন, ওই মাদরাসার অধ্যক্ষ অভিযুক্ত আব্দুল জলিলের এমপিওভুক্তিতে দাখিল করা দশম শিক্ষক নিবন্ধনের সনদটি যাচাই করতে পাঠিয়েছেন। যাচাইয়ে সহকারী মৌলভী পদের ওই সনদটি জাল বলে আমরা জানতে পেরেছি। তিনি যে প্রার্থীর সনদ জাল করেছেন তার নামও আব্দুল জলিল তবে বাবা ও মায়ের নাম ভিন্ন। অভিযুক্ত আব্দুল জলিলের বাবার নাম আব্দুল আলী ও মায়ের নাম রাশিদা খাতুন। আর সনদের আসল দাবিদার আব্দুল জলিলের বাবার নাম মো. আব্দুস সামাদ ও মায়ের নাম আজিদা খাতুন। শিগগির আমরা তার সনদটি জাল বলে যাচাই প্রতিবেদন প্রকাশ করবো। সনদ জাল করায় আব্দুল জলিলের বিরুদ্ধে মামলা করার জন্য বলা হবে প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষকে।
জানতে চাইলে অধিদপ্তরের প্রশাসন শাখার উপপরিচালক মো. জাকির হোসাইন দৈনিক আমাদের বার্তাকে বলেন, উজানপাড়া এতিমখানা আলিম মাদরাসার অধ্যক্ষ আমাদের কাছে অভিযোগ দিয়েছেন। তিনি জানিয়েছেন, এমপিওভুক্ত হওয়া আব্দুল জলিল শিক্ষক নন। আমরা এনটিআরসিএর কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানতে পেরেছি তার সনদটি জাল। তবে যাচাই প্রতিবেদন এখনো হাতে পাইনি। আর তিনি সুপারিশ পেয়েছেন কি না সে বিষয়েও এনটিআরসিএর কাছে অনুষ্ঠানিকভাবে তথ্য চাওয়া হবে। তথ্য পেলে তার ইনডেক্স কর্তন করা হবে।
এসব বিষয়ে জানতে অভিযুক্ত আব্দুল জলিলের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করে দৈনিক আমাদের বার্তা। তবে কোনো মন্তব্য করতে চাননি তিনি। এমনকি নিজেকে পরিচয় দেন ‘জলিলের ভাই সেলিম’ হিসেবে। তবে, কলার আইডি শনাক্তকরণের সফটওয়্যার ‘ট্রু কলারে’ ওই ফোন নম্বরটি জলিলের বলেই জানানো হয়েছে।
ফোনের অপরপ্রান্ত থেকে দৈনিক আমাদের বার্তাকে জানানো হয় এটি জলিলের ভাই সেলিমের নম্বর। সেলিমের কাছে আব্দুল জলিলের সঙ্গে যোগাযোগের নম্বর চাওয়া হলে তা দিতে অস্বীকৃতি জানানো হয়। অপরপ্রান্ত থেকে বলা হয়, ‘জলিল আশেপাশে নেই, আমি সেলিম তার ভাই। তার নম্বরও আমার কাছে নেই।’
দৈনিক শিক্ষা ডটকমের ইউটিউব চ্যানেল SUBSCRIBE করতে ক্লিক করুন।