প্রতি বছর ৫ অক্টোবর বিশ্ব শিক্ষক দিবস পালন করা হয়। ইউনেস্কো ১৯৯৫ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ধারাবাহিকভাবে দিবসটি পালন করে আসছে। ইউনেস্কোর মতে, “বিশ্ব শিক্ষক দিবস শিক্ষা ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে শিক্ষকদের অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ পালন করা হয়।’’ শিক্ষার্থী ও সমাজকে বিকশিত করতে আর উন্নয়নের নিরব আন্দোলনের অংশ হিসেবে শিক্ষকরা নিরলসভাবে কাজ করে যান নিরন্তর। তাদের এই অসামান্য অবদানকে স্বীকৃতি জানাতেই প্রতি বছর পালন করা হয় বিশ্ব শিক্ষক দিবস। প্রশ্ন হচ্ছে শিক্ষকরা কী আদৌ তাদের কাজের স্বীকৃতি পাচ্ছেন? নাকী সবকিছু ঐ দিবসের আনুষ্ঠানিকতাতেই বন্ধী! প্রতি বছরান্তে এই দিবস আসছে, দিবস যাচ্ছে আর শিক্ষকদের জীবনমান উন্নয়নে দেয়া নানান প্রতিশ্রুতির ফাঁকাবুলি জমা হচ্ছে আস্তাবলে! এই হচ্ছে আমাদের দেশে শিক্ষকদের অসামান্য কাজের নজিরবিহীন স্বীকৃতি।
একদা এ. পি. জে. আবদুল কালাম বলেছিলেন, “যদি কোন দেশ দুর্নীতিমুক্ত হয় এবং সবার মধ্যে সুন্দর মনের মানসিকতা গড়ে ওঠে, আমি দৃঢ়তার সঙ্গে বিশ্বাস করি সেখানকার সামাজিক জীবনে তিন রকম মানুষ থাকবে, যারা পরিবর্তন আনতে পারেন। তারা হলেন পিতা, মাতা ও শিক্ষক।” এ. পি. জে. আবদুল কালামের উক্তি ধরে বলা যায় ব্যাক্তি মানুষ, সমাজ ও একটি দেশের পরিবর্তনের নিরব কারিগর হলেন শিক্ষক। শিক্ষকদের কর্ম, শ্রম ও অবদানকে স্বীকৃতি দিতে হবে সামাজিকভাবে, আর্থিকভাবে এবং ন্যায্যতা ও যথাযথ মর্যাদার সাথে।
সেই স্বীকৃতি আমার দেশের শিক্ষকরা পাচ্ছেন কই? খোঁজ নিয়ে দেখুন, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কোথাও শিক্ষকরা ভাল নেই। শিক্ষকদের নেই আর্থিক সচ্ছলতা, নেই সামাজিক মর্যাদা, ক্ষেত্র বিশেষে নেই জীবনের নিরাপত্তা। যদি কিছু থাকেই তবে কেন শিক্ষকদের ক্লাস বন্ধ রেখে রাস্তায় দাঁড়াতে হবে তাদের ন্যায্য দাবি আদায়ের জন্য? কেন শিক্ষকরা আন্দোলন করবে তাদের আর্থিক মুক্তির জন্য? কেন শিক্ষকদের দাঁড়ে দাঁড়ে ঘুরতে হবে তাদের অবস্থার দৈন্যদশা কাটানোর জন্য? এই প্রশ্নোগুলোর অনেক উত্তর বা পাল্টা যুক্তি আপনার কাছে থাকতে পারে। আপনি এটাকে অনেকভাবেই পাশ কাটিয়ে যেতে পারেন বটে, তবে দিনশেষে ক্ষতিটা হচ্ছে এই সমাজের তথা এই দেশের।মালালা ইউসুফজাই একবার তার একটি বক্তব্যে বলেছিলেন “আমাদের মনে রাখতে হবে- একটি বই, একটি কলম, একটি শিশু এবং একজন শিক্ষক বিশ্বকে পরিবর্তন করতে পারে।” তিনি বিশ্বকে পরিবর্তনের অন্যতম একটি হাতিয়ার হিসেবে শিক্ষকদের অবদানের কথা উল্লেখ করেছেন। অথচ আমাদের দেশে পরিবর্তনের সেই মূল্যবান হাতিয়ারকে আমরা নানাভাবে অবমূল্যায়ন করে যাচ্ছি দিনের পর দিন। ঠিক কবে এই সকল অচলায়তন ভেঙে একটি নতুন ভোর দেখবে শিক্ষক সমাজ? সেই সময় কখন আসবে, যখন দিবসের আনুষ্ঠানিকতা থেকে সত্যিকার স্বীকৃতি পাবে এ দেশের শিক্ষকরা? এর উত্তর আমার জানা নেই। বোধ করি এর উত্তর আমাদের সকলেরই অজানা।
জুলাই আন্দোলনের পর দেশে শুরু হয়েছে সংস্কার আন্দোলন। দেশের প্রায় প্রতিটা ক্ষেত্রে নানান বৈষম্যের বিরুদ্ধে জোরদার সংস্কার কার্যক্রম দেশের জনসাধারণের মধ্যে আশা জাগানিয়া হয়ে উঠছে। এই সংস্কার আন্দোলনে যেন দেশের সকল শ্রেণীর শিক্ষকরাও সংস্কারের ছোঁয়া পায়, তারা যেন তাদের যথোপযোক্ত মর্যাদা আর সার্বিক স্বীকৃতি পায় এটাই কাম্য। শুধু বিশ্ব শিক্ষক দিবসের অনুষ্ঠানে নয় শিক্ষকদের বন্দনা হোক প্রতিটা দিবসে, প্রতিটা সাফল্যে। একজন শিক্ষক যেন নিঃসঙ্কোচে সমাজে সর্বত্র বুক উঁচু করে বলতে পারেন ‘আমি একজন শিক্ষক’।
লেখক : পরীক্ষণ বিদ্যালয়ের শিক্ষক, প্রাইমারী টিচার্স ট্রেনিং ইনস্টিটিউট (পিটিআই), ব্রাহ্মণবাড়িয়া