শিখন একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। জন্ম থেকে মৃত্যুপূর্ব পর্যন্ত মানুষ কিছু না কিছু শিখছে। একজন মানুষ প্রথম শেখে তার মা, বাবা, ভাই, বোন অর্থাৎ তার পরিবার থেকে। অতঃপর চারপাশের পরিবেশর বিভিন্ন উপাদান, ঘটনা ও অভিজ্ঞতা থেকে। একটা নির্দিষ্ট বয়সে এসে সে বিদ্যালয়ে ভর্তি হয় তখন থেকে তার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা জীবন শুরু হয়। জ্ঞান অর্জনের পাশাপাশি বিদ্যালয়ের নিয়ম শৃঙ্খলা, সময়ানুবর্তিতা, খেলাধুলা, সৃজনশীলতা, সহযোগিতা, সহমর্মিতা ইত্যাদি বিষয়ও তাকে গড়ে উঠতে সহায়তা করে শিক্ষক। জ্ঞানের ব্যাপারে শিক্ষক সহায়ক মাত্র। প্রকৃত অর্থে মানুষ নিজেই নিজের শিক্ষক। পৃথিবীতে কেউই কাউকে কোনো কিছু শেখাতে পারে না যতোক্ষণ পর্যন্ত না একজন মানুষ নিজে থেকেই শিখতে উদগ্রীব হয়। তাই শিক্ষকের সার্থকতা শিক্ষাদান করায় নয় বরং শিক্ষার্থীকে তা অর্জন করতে সক্ষম করায়। শিক্ষক শিক্ষার্থীকে শিক্ষার পথ দেখিয়ে দিতে পারেন, তার কৌতূহলের উদগ্রীব করতে পারেন, বুদ্ধি বৃদ্ধিকে জাগ্রত করতে পারেন, তার জ্ঞানপিপাসাকেও জাগ্রত করতে পারেন, যাতে শিক্ষার্থী নিজে থেকে উদ্দীপ্ত হয়ে তার জ্ঞানপিপাসা নিবারণে সচেষ্ট হন।
আমার কাছে আদর্শ শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পর্ক হবে শ্রদ্ধা, বিশ্বাস, স্নেহ, শাসন ও সহযোগিতার মিশ্রণ। এখানে নতুন চিন্তা-ভাবনা প্রকাশে প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করতে কোনো ভয় থাকবে না। তেমনিভাবে শিক্ষার্থীদেরও থাকবে জানার আগ্রহ এবং সক্রিয়ভাবে শেখার প্রক্রিয়ায় জড়িত থাকার মনোভাব। শিক্ষকদের প্রতি থাকবে অগাধ শ্রদ্ধা ও সম্মান। একজন শিক্ষার্থীর সঙ্গে শিক্ষকের সম্পর্ক যতো বেশি অটুট থাকবে শেখার গুরুত্বতে শিক্ষার্থীরা ততো বেশি আগ্রহ পাবে।
শেখার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো অনুপ্রেরণা। বেশিরভাগ সময়েই আমরা শিখি শুধু সমাজে বা আমাদের দৈনন্দিন প্রয়োজনে আমাদের জায়গা তৈরি করতে বা ধরে রাখতে। যখন শেখার প্রয়োজনীয়তা সচেতন বা কখনো কখনো অবচেতনভাবে অনুভূত হয় তখন শেখা অনেক বেশি সক্রিয় হয়ে ওঠে। শিক্ষকতা শুধু একটি পেশা বা কাজ নয় এমন একটি বিষয় যা একজন শিক্ষার্থীর দৃষ্টিভঙ্গি সম্পূর্ণ বদলে দিতে পারে।
শিক্ষাদানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো শিক্ষার্থীদের কল্পনা করতে সক্ষম করা, নতুন জিনিস অন্বেষণ করা এবং সর্বোপরি নিজেদের অন্বেষণ করা। একজন প্রকৃত শিক্ষকই ধারাবাহিকভাবে একজন শিক্ষার্থীকে সহজ থেকে কঠিন, জানা থেকে অজানা, জ্ঞানের বিন্দু থেকে নিয়ে যান জ্ঞান সমুদ্রের দিকে। প্রত্যেক শিক্ষকের উচিত শিক্ষার্থীর শিক্ষার প্রতি অনুরাগ তৈরি করা। এই ব্যাপারে আলবার্ট আইনস্টাইনের উক্তি যথার্থই ‘একজন শিক্ষক দ্বারা জোত্যি আলোকিত হওয়ার সম্ভাবনা আমরা সবাই দেখেছি। সৃষ্টিশীল প্রকাশ এবং জ্ঞানের মধ্যে আনন্দ জাগ্রত করা শিক্ষকের সর্ব প্রধান শিল্প’।
একজন শিক্ষককে অবশ্যই তার শিক্ষার্থীর স্বার্থের দিকে নজর দিতে হবে, তার শক্তিতে বিশ্বাস করতে হবে। শিক্ষককে অবশ্যই একাডেমিকভাবে শক্তিশালী করার চেয়ে একটি শিশুকে দায়িত্বশীল করার চেষ্টা করতে হবে। কারণ, একজন দায়িত্বশীল মানুষ তার নিজের জন্য, পরিবারের জন্য, দেশের জন্য সর্বোপরি বিশ্বের জন্য কল্যাণ বয়ে আনতে পারে।
লেখক: প্রধান শিক্ষক (ভারপ্রাপ্ত)