আমার দীর্ঘ ২৫ বছরের শিক্ষকতা ও প্রিন্সিপাল হিসেবে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক কারিকুলামে পরিচালিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কাজের অভিজ্ঞতা থেকে উপলব্ধি করেছি, কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান; সেটি স্কুল, কলেজ, মাদরাসা বা বিশ্ববিদ্যালয়, যেটিই হোক না কেনো, সেখানে সারি সারি ডেস্কে ভরা শ্রেণিকক্ষের জীবাণুমুক্ত পরিবেশ, পাওয়ার পয়েন্ট বা স্মার্ট বোর্ডে পাঠদান করা, শিক্ষকদের সময়মতো ক্লাসে যাওয়া-আসা বা ঠিকঠাকমতো পরীক্ষা হওয়া ইত্যাদি সবকিছুর চিত্র ফুটে উঠলেও সেটি ভালো শিক্ষার জন্য যথেষ্ট নাও হতে পারে, বরং সেখানে শিক্ষার একটি অসম্পূর্ণ চিত্রও থাকতে পারে। একটি সত্যিকারের সমৃদ্ধ শেখার পরিবেশের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে একটি শক্তিশালী শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পর্ক। এ সম্পর্কগুলো শিক্ষক, প্রশিক্ষক ও মেন্টরদের যেমন সম্মানিত ও সমৃদ্ধশালী করে, তেমনি একজন ছাত্র বা ছাত্রীর সামগ্রিক বিকাশকে অনুপ্রাণিত করে। শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সম্পর্ক শিক্ষার্থীদের ওপর এমন একটি প্রভাব ফেলে, যা তাদের সারাজীবনের জন্য অনুরণিত হতে পারে। এ সম্পর্কের গভীরে শিক্ষকের যে পেশাগত মৌলিক চর্চা রয়েছে আজকের প্রবন্ধে সেটিই আলোচনা করছি।
পাঠ্যপুস্তকের বাইরে বিশ্বাস এবং সংযোগ গড়ে তোলা শিক্ষকের কাজ। একজন ভালো শিক্ষক শুধু জ্ঞান বিতরণকারী নন; তিনি একজন পথপ্রদর্শক বা গাইড, একজন পরামর্শদাতা এবং উৎসাহের উৎস। তিনি বিশ্বাস এবং সম্মানের ওপর নির্মিত একটি শ্রেণিকক্ষের এমন একটি সুন্দর পরিবেশ গড়ে তোলেন, যেখানে শিক্ষার্থীরা ঝুঁকি নিতে, প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করতে এবং স্বাধীনভাবে নিজেদের প্রকাশ করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। এই মানসিক নিরাপত্তার জাল শিক্ষার্থীদের বুদ্ধিবৃত্তিক এবং আবেগগতভাবে তাদের সম্পূর্ণ সম্ভাবনা অন্বেষণ করতে সাহায্য করে।
শিক্ষকরা হলেন কৌতূহল উদ্দীপনা ও অনুপ্রেরণার শক্তি। যে শিক্ষকরা তাদের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সত্যিকারের সংযোগ তৈরি করেন, তাদের শেখার জন্য একটি আবেগ জাগিয়ে তোলার অসাধারণ ক্ষমতা রয়েছে। তাদের উৎসাহ এবং নিবেদিত পরিষেবা শিক্ষার্থীদের জানা ও বুঝার বিষয়গুলোর গভীরে অনুসন্ধান করতে এবং আজীবন অন্বেষণের আনন্দ আবিষ্কার করতে অনুপ্রাণিত করে৷ এই অন্তর্নিহিত অনুপ্রেরণা একজন শিক্ষার্থীর স্বাধীনভাবে শেখার এবং স্ব-নির্দেশিত শিক্ষার্থী হয়ে ওঠার আকাঙ্ক্ষাকে জাগিয়ে তোলে। এটি যেকোনো ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের সাফল্যের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি দক্ষতা। শিক্ষক শ্রেণিকক্ষে হাস্যরসের কাজ, ভয়েস মডুলেশন, অঙ্গভঙ্গি, মুখের অভিব্যক্তি এবং বাস্তব জীবনের অনেক উদাহরণ উপস্থাপন করে শিক্ষাথীদের মধ্যে উদ্দীপনা জাগিয়ে তোলেন। কৌতুহল উদ্দীপনা ও অনুপ্রেরণা হলো একটি মূল নির্ধারক, যা দীর্ঘমেয়াদে শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীদের সম্পর্ককে টিকিয়ে রাখে।
শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মসম্মান এবং আত্মবিশ্বাস তৈরি করেন শিক্ষক। একজন শিক্ষক তার সহোযোগিতায় সকল উপাদান ব্যবহার করে প্রতিটি শিক্ষার্থীর অনন্য শক্তি এবং প্রতিভাকে প্রতিফলিত করেন। শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সুসম্পর্ক শিক্ষার্থীদের জন্য স্বতন্ত্র মনোযোগ আনতে সাহায্য করে, তাদের কৃতিত্ব উদযাপন করে এবং গঠনমূলক প্রতিক্রিয়া প্রদান করে। একজন শিক্ষক তার শিক্ষার্থীদের আত্মমর্যাদা এবং আত্মবিশ্বাস গড়ে তুলতে সক্ষম করেন। এই ইতিবাচক শক্তিবৃদ্ধি স্থিতিস্থাপকতাকে উৎসাহিত করে, যা শিক্ষার্থীদের চ্যালেঞ্জ নেভিগেট করতে এবং নতুন পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাওয়াতে সাহায্য করে।
শিক্ষক তার শিক্ষকতার দীর্ঘস্থায়ী ছাপ রেখে যান প্রতিটি শিক্ষার্থীর অন্তরে। একজন শিক্ষক তার শিক্ষার্থীদের মধ্যে নিজের জীবনের প্রতিচ্ছবি অঙ্কন করে একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনের রূপ দিতে পারেন। একজন নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষকের প্রভাব শ্রেণিকক্ষের দেয়াল ছাড়িয়ে বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত। যে শিক্ষকরা তাদের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে প্রকৃত সংযোগ গড়ে তোলেন তারা একটি স্থায়ী ছাপ রেখে যান। তারা রোল মডেল হয়ে ওঠেন, অধ্যবসায়, সহানুভূতি এবং জীবনব্যাপী শিক্ষার গুরুত্বের মতো মূল্যবান জীবনের পাঠগুলোকে উদ্বুদ্ধ করেন। এই স্মৃতিগুলো প্রায়ই শিক্ষার্থীদের দ্বারা লালিত হয়ে থাকে, বিশেষ করে যখন তারা তাদের নিজস্ব জীবনযাত্রা পরিচালিত করতে শেখেন।
সম্পর্ক উন্নয়নে বিনিয়োগ করে শিক্ষক শিক্ষার্থীদের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ নির্মাণ করেন। একটি স্বাস্থ্যকর এবং অনুপ্রেরণাদায়ক শিক্ষার পরিবেশ তৈরি করার জন্য এই মিথোজীবী বা সিম্বিওটিক সম্পর্কের গুরুত্বকে অনুধাবন করা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। যে স্কুলগুলো শক্তিশালী শিক্ষক-শিক্ষার্থী বন্ধন গড়ে তোলাকে অগ্রাধিকার দেয়, তারা কেবল শিক্ষায় বিনিয়োগ করে না, বরং ভালো মানুষ বানানোর সামগ্রিক প্রক্রিয়ায় বিনিয়োগ করে। কর্মজীবনে এ সকল ব্যক্তিরাই আমাদের সম্প্রদায়ের ভবিষ্যৎ গঠন করে শ্রেণিকক্ষের মধ্যে শেখা পাঠ এবং ব্যক্তিগত সংযোগগুলোকে সারা জীবন বহন করে।
শিক্ষাঙ্গনে নিরাপদ পরিবেশ তৈরি করতে পারেন শিক্ষক। বুলিং, র্যাগিং ও নিয়মিত মানসিক নির্যাতন শিক্ষাঙ্গনে নিরাপদ পরিবেশ তৈরির অন্তরায়। বিদ্যালয়ে মাদক সেবন চর্চা, জুয়া খেলা, মোবাইল আসক্তিতে উত্তেজনা, রাজনৈতিক ক্ষমতার দাপট, হোস্টেলে সিট দখলের দাঙ্গা-মারামারিসহ নানাবিধ বিশৃঙ্খলার কারণে শিক্ষার্থীরা মারাত্মকভাবে নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন। এমতাবস্থায়, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর সুসম্পর্ক শ্রেণিকক্ষে নিরাপত্তার একটি স্তর তৈরি করে। এক্ষেত্রে নিরাপদ শিক্ষাঙ্গন প্রতিষ্ঠায় শিক্ষকের ভূমিকা উল্লেখ্যোগ্য। শিক্ষকের একটি নিরাপদ শ্রেণিকক্ষে, শিক্ষার্থীরা তাদের মতামত প্রকাশ করতে পারেন এবং বিচারের ভয় ছাড়াই সম্ভাব্য বা বাস্তব জীবনের হুমকি নিয়ে আলোচনা করতে পারেন। সুতরাং, এটি একজন শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর সুসম্পর্ক স্থাপনের একটি দুর্দান্ত সুবিধা।
শিক্ষার্থীদের কর্মক্ষমতা ও আচরণিক শালীনতা বজায় রাখতে শিক্ষকের পদক্ষেপ গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষার্থীর কর্মক্ষমতা এবং শ্রেণিকক্ষের সংস্কৃতি সম্পৃক্ততা তৈরিতে শিক্ষকের অবদান অনস্বীকার্য। একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে, শ্রেণিকক্ষে ইতিবাচক সক্ষমতা তৈরি, কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি এবং আচরণের শালীনতা প্রতিষ্ঠা, শিক্ষার্থীদের জন্য একটি সর্বোত্তম শিখন পদ্ধতি আবিষ্কার করতে শেখায়। মহান শিক্ষকরা একটি সুখকর শিক্ষার পরিবেশ তৈরি করেন, যেখানে শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীরা নিজেদের মধ্যে একত্বের অনুভূতি বিকাশ করে। ফলে শিক্ষার্থীরা সেখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণভাবে আনন্দ-উল্লাস করে শিখনফলের প্রকৃত স্বাদ গ্রহণ করেন। শিক্ষক-শিক্ষার্থীর গভীর সুসম্পর্ক তৈরি করতে একজন শিক্ষককে অনেক ক্লেশকর পথ অতিক্রম করতে হয়। যার ফলে, শিক্ষার্থীদের আচরণের সমস্যাগুলো (মনস্তাত্ত্বিক উদ্বেগ, মানসিক এবং আচরণ-সম্পর্কিত সমস্যাগুলো) মোকাবিলা করতেও তাদেরকে হিমসিম খেতে হয়। শিক্ষার্থীদের বিষাক্ত স্ট্রেস, ঝুঁকিপূর্ণ আচরণ, ক্লিনিক্যাল সমস্যাসহ অন্যান্য অস্বাভাবিক আচরণগুলোর প্রাথমিক শনাক্তকরণে শিক্ষকদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হয়।
মোদ্দা কথায়, শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সম্পর্ক গঠনে শিক্ষককে বিভিন্ন দক্ষতায় পাঠদান করতে হয়। যার ফলে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সম্পর্ক উন্নত হয় এবং শিক্ষার্থীদের মধ্যে একটি নিরাপদ স্বস্তিবোধের সৃষ্টি হয়। এক্ষেত্রে শিক্ষকদেরকে নিম্নোক্ত কয়েকটি বিষয় খেয়াল রাখতে হয়। যেমন; ক. শিক্ষাদানকালে শিক্ষককে তার নিজস্ব পদ্ধতির সঙ্গে উদ্ভাবনী চেতনা জাগ্রত করা; খ. নতুন শিখন কৌশল (পেডাগোজি) অবলম্বনে শিক্ষাদান, যেমন ফ্লিপড লার্নিং, উপস্থাপনা এবং ইন্টারেক্টিভ ভিডিয়ো, প্রজেক্ট ভিত্তিক শিক্ষা; গ. শিক্ষার্থীদের সঙ্গে একটি সুসম্পর্ক তৈরিতে শিক্ষককে ফোকাস করা; ঘ. শিক্ষকের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে শিক্ষার্থীদেরকে লক্ষ্যবস্তুতে পৌঁছে দেয়া; ঙ. ইন্টারেক্টিভ শিখন পদ্ধতি ব্যবহারের ওপর জোর দেয়া ; চ। শিক্ষার্থীর পছন্দ-অপছন্দকে সম্মান করা; ছ. সর্বদা শিক্ষার্থীর কার্যকর শিখনফল নিশ্চিত করা; জ। শিক্ষার্থীদের উপলব্ধিগুলো বিবেচনা করা; এবং ঝ. শিক্ষার্থীদের পাঠ স্মরণীয় করে তুলতে আনন্দপূর্ণ অনলাইন/ডিজিটাল শিখন পদ্ধতি ব্যবহার করা।
আমার সর্বশেষ ভাবনায় আমি মনে করি, একজন ভালো শিক্ষকের প্রভাব ছাত্রজীবন থেকে কখনোই মুছে ফেলা যায় না। মনে রাখতে হবে, শিক্ষকরা শিক্ষার কেন্দ্রবিন্দু, তারা অনুপ্রেরণার স্থপতি, আত্মবিশ্বাসের লালনকারী এবং স্বপ্নের নির্মাতা। তাদের ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে দৃঢ় সম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য তাদের নিবেদন শুধুমাত্র একাডেমিক সাফল্যই নয়, বরং তাদের জীবনের মূল কাঠামো শক্তি বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। শিক্ষক-শিক্ষার্থীর গভীর সম্পর্ক সুশিক্ষা নিশ্চিতের প্রধান সোপান। যে শিক্ষক তার জীবনের সর্বস্বটুকু দিয়ে চেষ্টা করেন তার শিক্ষার্থীদেরকে আদর্শ স্মার্ট মানুষ বানাতে, সে শিক্ষার্থী যে হয়ে ওঠেন জাতির ভবিষ্যৎ পরিচালনার কাণ্ডারি, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তাই আসুন, প্রতিটি শিক্ষাঙ্গনে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সম্পর্ক উন্নয়নে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করি এবং একটি শিক্ষিত ও আদর্শ জাতি গঠনে আন্তরিক হই।
লেখক: প্রেসিডেন্ট, বাংলাদেশ স্মার্ট এডুকেশন নেটওয়ার্ক