দেশবরেণ্য শিক্ষাবিদ, বুদ্ধিজীবী, সামাজিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতত্বে গঠিত হয় অন্তর্বর্তী সরকার। দেশের এই ক্রান্তিকালে গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটি গঠিত হয়। এই কমিটির আহ্বায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন প্রথিতযশা এই শিক্ষাবিদ। শিক্ষকদের যখন লাঞ্ছিত, অপমানিত ও জোরপূর্বক পদত্যাগে বাধ্য করা হচ্ছে, ঠিক তখনই এর লাগাম টেনে ধরতে চান সমাজ রূপান্তরকারী এই শিক্ষক। এ ব্যাপারে তিনি কথা বলেছেন । সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সিনিয়র সহ-সম্পাদক সানজিদ সকাল।
প্রশ্ন: সরকার পতনের পর বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে একধরনের অস্থিরতা বিরাজ করছে। শিক্ষকরা লাঞ্ছনা-বঞ্চনার শিকার হচ্ছেন, এই বিষয়টা আপনি কীভাবে দেখছেন?
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: শিক্ষক লাঞ্ছনার ঘটনা আঘাত আনে পুরো শিক্ষাব্যবস্থার ওপর। এটা শুধু শিক্ষককে ব্যক্তিগতভাবে লাঞ্ছনা করা হয় না, পুরো জাতি লাঞ্ছিত হয়। শিক্ষক যদি লাঞ্ছিত হন, তাহলে শিক্ষাই লাঞ্ছিত হয়। শিক্ষক যদি অপমানিত হন ও পদত্যাগে বাধ্য করা হয়, সেটা হবে জাতির জন্য কলঙ্ক। যদি কোনো শিক্ষককে জুতার মালা গলায় পরানো হয়, তাহলে সেই শিক্ষক আর শিক্ষক থাকেন না। সেই আঘাতটা শুধু একজন শিক্ষকের ওপর আসে না, পুরো শিক্ষাব্যবস্থার ওপর আসে। শিক্ষকদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে।
ছাত্র ও শিক্ষকের সম্পর্কটাই বদলে ফেলতে হবে এবং মধুর হতে হবে। ছাত্র ও শিক্ষকের সম্পর্ক হতে হবে বন্ধুত্বপূর্ণ। এটা মানতেই হবে যে, ছাত্ররা সব সময়ই শিক্ষকদের আদর্শ হিসেবে মানবে। শিক্ষককে বীর হিসেবে অনুকরণ করতে হবে। সেই অনুকরণীয় মানুষটাকে যদি খাটো করে ফেলা হয়, তাদের যদি কোনো সম্মান না থাকে, তাহলে শিক্ষায় তার অধিকারই থাকে না। তখন তিনি আর শিক্ষক থাকেন না।
শিক্ষকদের ওপর আক্রমণ করাটা সংক্রামক ব্যাধির মতো। একবার এক শিক্ষকের ওপর আক্রমণ করলে সব জায়গাতেই এর প্রভাব পড়ে। সবাই পাওয়ার বা শক্তি প্রয়োগ করতে চায়। আমরা দীর্ঘকাল ঔপনিবেশিক শাসনের অধীন ছিলাম। আমাদের ক্ষমতার অভাব আছে। ক্ষমতা যখন যে যতটুকু পায়, সেই ক্ষমতাটার অপব্যবহার করে। ক্ষমতা পেলেই মানুষ ক্ষমতার অপব্যবহার করে। যারা ক্ষমতা থেকে একসময় বঞ্চিত হয়, তারাই ক্ষমতা পেলে সেটাকে অপব্যবহার করে।
এমনিতেই ক্ষমতা সব সময়ই অপব্যবহারমুখী। শিক্ষার্থীদের সৃষ্টিশীল কাজে নিয়োগ করা হয়নি। এখন শিক্ষার যে পদ্ধতি তাতে শিক্ষার্থীরা স্কুল শেষ করে কোচিং সেন্টারে চলে যায়। তারা গাইড বই ব্যবহার করছে। তারা ক্লাসরুমে বেশি সময় দিচ্ছে না। ফলে শিক্ষার্থীদের মধ্য সৃজনশীলতা সৃষ্টি হচ্ছে না। শিক্ষাকে বাণিজ্যিকীকরণের হাত থেকে মুক্ত করতে হবে। শিক্ষা এখন কেনাবেচার পণ্যতে পরিণত হয়েছে।
প্রশ্ন: বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার কোনো পরিবর্তন আনা দরকার কি না। অন্যদিকে ছাত্র ও শিক্ষকের সম্পর্কে যে ঘাটতি তৈরি হয়েছে, যা আগের দিনে এমন সম্পর্ক ছিল না। এ ব্যাপারে আপনার অভিমত কী?
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: জাতি গঠনে ছাত্র ও শিক্ষকের মধ্যে সুনিবিড় সম্পর্ক থাকা উচিত। বাংলাদেশের বিপুল জনসংখ্যাকে সম্পদে পরিণত করতে হলে অবশ্যই শিক্ষকের মর্যাদা দিতে হবে। এমনিতেই আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থা দুর্দশাগ্রস্ত। আমাদের দেশের সন্তানরা প্রাথমিক পর্যায়ে এসেই ঝরে পড়ে। আমাদের দেশের শিক্ষার বড় দুর্বলতা হলো তিন ধারার শিক্ষাব্যবস্থা। বর্তমান বিশ্বে তিন ধারার শিক্ষাব্যবস্থা কোনো দেশে আছে বলে মনে হয় না। একটা শ্রেণির ওপর নির্ভর করে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা তিন ধারায় ভাগ করে রেখেছে। এই তিন শিক্ষা ধারা একদিন অবলুপ্ত হবে।
বর্তমানে এই তিন ধারা ছাড়াও আরও শ্রেণিবিন্যাস হচ্ছে। এর মূল কারণ হলো শ্রেণি বিভাজন। মাতৃভাষার মাধ্যমে যে শিক্ষা তা আমরা জাতিকে দিতে পারছি না। মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষা দেওয়াকেই প্রধান ধারা করার কথা ছিল। বাঙালি জাতি বিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে, যাদের মাতৃভাষা বাংলা। বাংলা ভাষাকে কেন শিক্ষার মাধ্যম করা গেল না, সেটা আমাদের জাতির একটা বড় দুর্বলতা। শিক্ষার ক্ষেত্রে এই জায়গাটায় আমাদের ভাবতে হবে। লক্ষ করা যাচ্ছে, বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে জবরদখল চলছে। রাজনৈতিক পরিচয় বহন করে এমন অনৈতিক কাজগুলো করা হচ্ছে। দেশে সরকার পতন হলে কি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমনভাবে দখল করতে হবে? এমনকি বিদ্যালয়ও এর থেকে রক্ষা পাচ্ছে না। শিক্ষকদের অপমান করা হচ্ছে, লাঞ্ছিত করা হচ্ছে।
এমনকি নারী শিক্ষিকাদের লাঞ্ছিত করে তার কক্ষ থেকে বের করে দিচ্ছে তারই শিক্ষার্থীরা। এমন তো কখনো হওয়ার কথা নয়।
শিক্ষকদের পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়েছে। শিক্ষদের বিরুদ্ধে তালিকা করা হচ্ছে। এসব কাণ্ড করা হচ্ছে একবারেই নিজস্ব স্বার্থের কারণে। এটা কোনো আদর্শ হতে পারে না। শিক্ষক লাঞ্ছনা, শিক্ষকদের ওপর নির্যাতন এবং জোরপূর্বক পদত্যাগে বাধ্য করা খুবই খারাপ কাজ। এ ধরনের ঘটনা কিন্তু ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে ঘটছে না। এমনকি কওমি মাদ্রাসাগুলোতেও ঘটছে না। এই ঘটনাগুলো ঘটছে মূলধারার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। মূলধারার শিক্ষাতেই তারা আঘাত করছে। মূলধারার শিক্ষাটা নানান রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।
প্রশ্ন: বর্তমান শিক্ষা কারিকুলাম কি আগের কারিকুলামে ফিরিয়ে আনা হবে? বর্তমান শিক্ষা কারিকুলামে নতুন প্রজন্ম প্রকৃত শিক্ষা পাচ্ছে কি? বর্তমান শিক্ষা কারিকুলামে কোনো পরিবর্তন দরকার আছে বলে কি আপনি মনে করেন?
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: সবকিছুই পরিবর্তন হয়। তারও একটা নিয়মনীতি আছে। শিক্ষা কারিকুলাম আগের কারিকুলামে গেলে ভালো হবে, নাকি মন্দ হবে সেটা কোনো বিষয় নয়। হঠাৎ করে শিক্ষা কারিকুলাম পরিবর্তন করা হলো একধরনের স্বৈরাচারী মনোভাব। শিক্ষা কারিকুলাম নিয়ে বিশদ আলোচনা করা ও প্রস্তুতির দরকার ছিল। শিক্ষা কারিকুলাম বারবার পরিবর্তন করা হচ্ছে, এটা ঠিক নয়।
একবার সৃজনশীল, আবার নতুন কারিকুলাম। পরীক্ষার বিষয় কখনো বাড়ানো হয়, আবার কমানো হয়। এসব বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হলে শিক্ষা বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিতে হবে। যারা দলনিরপেক্ষ, সেসব শিক্ষকের সঙ্গে আলোচনা করে পরামর্শ নিতে হবে। শিক্ষকদের সঙ্গে পরামর্শ না করেই শিক্ষাসংক্রান্ত সিদ্ধান্তগুলো নেওয়া হচ্ছে। শিক্ষকরা প্রস্তুত নন, অভিভাবকরাও প্রস্তুত নন। অভিযোগ উঠেছে যে, ছাত্ররা এখন পড়তে চায় না। কী এমন করা হলো যে ছাত্ররা পড়তে মনোযোগী হচ্ছে না। এটা জাতির জন্য অশনিসংকেত।
খবরের কাগজ: শিক্ষার্থীরা কেন পড়াশোনায় মনোযোগী হচ্ছে না। এবারের এইচএসসি পরীক্ষায় শিক্ষার্থীদের অটোপাস দেওয়া হচ্ছে, এতে কি শিক্ষার্থীরা মেধাহীন হয়ে পড়বে না? এই বিষয়টাকে আপনি কীভাবে দেখছেন?
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: এইচএসসি পরীক্ষায় অটোপাস দেওয়াটা মোটেও ভালো হয়নি। এর আগেও একবার অটোপাস দেওয়া হয়েছিল। আইয়ুব খানের আমলে তিন বছরের বিএ কোর্স চালু করা হয়েছিল। ওই সময়েও ছাত্ররা বিএ কোর্সের মেয়াদ দুই বছর করার জন্য আন্দোলন করেছিল। তখন যারা বিএ কোর্সে দুই বছর অতিক্রম করেছিল তাদের অটোপাস দিয়ে দেওয়া হয়েছিল। ওই দুর্বলতাটা এখনো আমাদের দেশে রয়ে গেছে। শিক্ষাক্ষেত্রে একধরনের শূন্যতা বিরাজ করছে।
এবারের এইচএসসি পরীক্ষায় যেভাবে অটোপাস দেওয়া হলো, তাতেও একধরনের শূন্যতা তৈরি হবে। ছাত্ররা নিজেদের গড়ে তুলতে পারবে না। এসব ছাত্র দিন দিন হীনম্মন্যতায় ভুগবে। তাদের মনের ভেতরে সব সময় একধরনের ব্যাধি কাজ করবে যে, আমরা পরীক্ষা না দিয়েই পাস করেছি। অন্যরাও এদের দেখে বলবে যে, পরীক্ষা না দিয়েই এরা এসেছে। এটা ব্যক্তি মানুষের যেমন সারা জীবনের দুঃখ, তেমনি জাতির জীবনেও এক ধরনের দুঃখ।
প্রশ্ন: খবরের কাগজের সঙ্গে থাকার জন্য আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ।
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: আপনাকেও ধন্যবাদ।
সূত্র: খবরের কাগজ