একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত এবং দীর্ঘদিন যাবত পলাতক আব্দুল মজিদকে আটক করেছে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) সদস্যরা।
বুধবার (১ ফেব্রুয়ারি) দিবাগত রাতে র্যাব-৩ এর একটি দল মাদারীপুর সদর এলাকা হতে তাকে আটক করে।
গ্রেফতার আব্দুল মজিদ (৮০) নেত্রকোনা জেলার পূর্বধলা থানাধীন পূর্ব মৌদামের বাসিন্দা। ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দে গঠিত কেন্দ্রীয় কমিটি কর্তৃক ঘোষিত তালিকায় মজিদ পূর্বধলা থানা জামায়াত ইসলামীর সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন।
বৃহস্পতিবার (২ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজার র্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে র্যাব-৩ এর অধিনায়ক লে. কর্নেল আরিফ মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, তার বিরুদ্ধে ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে হত্যা, গণহত্যা, অপহরণ, নির্যাতন, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ ও ধর্ষণসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের সাতটি অভিযোগ আনা হয়।
১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দে গঠিত জামায়াত ইসলামীর কেন্দ্রীয় কমিটির পূর্বধলা থানা সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন তিনি। ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে মহান মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে মুক্তিবাহিনীর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারী এবং পাকিস্তানি হানাদারদের দোসর হিসেবে গঠিত ঘৃণ্য রাজাকার বাহিনীর অত্যাচারে বাংলাদেশের আপামর জনতার ওপর চলে অমানবিক ও পৈশাচিক নির্যাতন। গ্রেফতার মজিদ আল-বদর বাহিনীর পূর্বধলা রামপুর থানা কমিটির প্রধান ছিলেন।
পূর্বধলা রামপুর মৌদাম গ্রামে মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল খালেকসহ তার আপন দুই ভাই এবং পাঁচজন চাচাতো ভাই মিলে একই বাড়িতে সাত মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। তারা যুদ্ধে অংশগ্রহণের পাশাপাশি এলাকার বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে সহযোগিতা করেন। এজন্য আল-বদর কমিটির প্রধান আব্দুল মজিদের শত্রুতে পরিণত হয় তারা।
১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে ২১ আগস্ট দুপুরে আব্দুল মজিদ তার দলবল নিয়ে বাড়হা গ্রামের আব্দুল খালেকের বাড়িতে আক্রমন করেন। সেসময় বাড়িতে অবস্থানরত আব্দুল খালেকসহ মুক্তিবাহিনীর সবাইকে এক এক করে আসামি ও তার সহযোগিরা নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করেন।
হত্যার পর বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল খালেকের লাশটি পার্শ্ববর্তী কংস নদীতে ফেলে দেওয়া হয় এবং অপরাপর মুক্তিযোদ্ধাদের মরদেহ কোকখালী নদীতে বস্তাবন্দি করে ফেলে দেয়। এই হত্যাকাণ্ডের পাশাপাশি তারা আব্দুল খালেকের বাড়িতে লুটপাট চালায় এবং অগ্নিসংযোগ করে। এ ঘটনায় মৃত আব্দুল খালেকের ভাই আব্দুল কাদের বাড়ি থেকে পালিয়ে কোনও রকমে প্রাণ বাঁচায়।
২০১৪ খ্রিষ্টাব্দে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে আব্দুল মজিদসহ ৪ জনকে আসামি করে মামলা দায়ের করেন ভাই আব্দুল কাদের।
পরবর্তী সময়ে মামলার গভীর তদন্তে আরও তিনজনের জড়িত থাকার প্রমাণ এবং আসামিদের বিরুদ্ধে আনীত সাতটি অভিযোগই প্রসিকিউশনের মাধ্যমে প্রমাণিত হলে ২০১৯ খ্রিষ্টাব্দে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক সাত আসামির বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডের রায় দেওয়া হয়।
এটি মুক্তিযুদ্ধকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধ তথা যুদ্ধাপরাধের মামলায় ৩৬তম রায়। বিচার চলাকালে এই মামলার দুজন আসামি (আহম্মদ আলী ও আব্দুর রহমান) মারা যায় এবং রায় হওয়ার পর পলাতক অবস্থায় মারা যায় আরও দুই আসামি (রদ্দিন মিয়া ও আব্দুস সালাম বেগ)। ওই মামলার আরও দুজন আসামি (আব্দুল খালেক তালুকদার ও কবির খাঁ) বর্তমানে পলাতক রয়েছে। গত রাতে র্যাব-৩ এর একটি দল মাদারীপুর সদর এলাকা থেকে আব্দুল মজিদকে গ্রেফতার করে।
আব্দুল মজিদ সম্পর্কে র্যাব-৩ অধিনায়ক বলেন, মজিদ ১৯৬৮ সাল থেকে জামায়াত ইসলামের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন। ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দে ঘোষিত কমিটিতে তিনি পূর্বধলা থানা জামায়াত ইসলামের সাংগঠনিক সম্পাদক হন। ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন রাজাকার বাহিনীর পূর্বধলা আল-বদর থানা কমিটির প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তার যোগসাজশে পাকিস্তান হানাদার বাহিনী দলবল নিয়ে থানার বিভিন্ন গ্রামে অসংখ্য বাড়িতে হামলা চালিয়ে হত্যা, গণহত্যা, অপহরণ, নির্যাতন, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ ও ধর্ষণসহ মানবতাবিরোধী কার্যক্রম চালায়।
১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে ২১ আগস্ট আব্দুল খালেকের বাড়িতেও হামলা চালিয়ে নৃশংসভাবে গুলি করে আব্দুল খালেক ও তার সহযোগী ৯ জন বীর মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করে।
এছাড়াও মুক্তিযুদ্ধ শেষ না হওয়া পর্যন্ত অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। মুক্তিযোদ্ধাদের শারীরিকভাবে অত্যাচার করার জন্য পাকিস্তানি হানাদারদের সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে মজিদ পূর্ব মৌদাম গ্রামে একটি মুক্তি কয়েদখানা গড়ে তোলে। সেখানে মুক্তিযোদ্ধাদের আটকে রেখে অমানবিক নির্যাতন করে নৃংশসভাবে হত্যা করা হতো।
২০১৫ খ্রিষ্টাব্দে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে চলমান মামলার শুনানিতে হাজিরা না দেওয়ায় আব্দুল মজিদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির পর এলাকা ছেড়ে ঢাকায় চলে আসেন এবং ফকিরাপুল এলাকায় কিছুদিন আত্মগোপন করেন। এরপর তার আত্মীয়ের সহযোগিতায় মাদারীপুরে গিয়ে আত্মগোপন করে একটি কামিল মাদরাসায় শিক্ষকতার মাধ্যমে পলাতক জীবন শুরু করেন। ২০১৫ সাল থেকে মামলার বিচারিক প্রক্রিয়া চলাকালীন তিনি কখনই আদালতে হাজিরা দেননি।
আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক গ্রেফতার এড়াতে তিনি নিয়মিত বাসা পরিবর্তন করতেন। এসময় পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে তিনি অন্যের রেজিস্ট্রেশনকৃত সিমকার্ড দিয়ে মোবাইল ফোন ব্যবহার করতেন। তিনি এবং তার ছেলে-মেয়েরা আর্থিকভাবে স্বচ্ছল হওয়ায় প্রয়োজনীয় চাহিদা পূরণের জন্য তারা নিয়মিত তাকে অর্থ পাঠাতেন।
আত্মগোপনে থাকাকালে তিনি সাধারণত জনসমাগম স্থান, বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠান ছাড়াও তার ব্যক্তিগত পরিচয় প্রকাশ পায় এমন স্থান এড়িয়ে চলতেন। তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন।