নতুন শিক্ষাক্রম চালু হতে আর কয়েকদিন মাত্র বাকি। আসছে শিক্ষাবর্ষে ৬ষ্ঠ ও ৭ম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা এই শিক্ষাক্রমে পড়ালেখা শুরু করবেন। এই দুই শ্রেণির পাঠ্যপুস্তক জেলায়, জেলা থেকে উপজেলায় পাঠানো হয়েছে। উপজেলা থেকে পাঠ্যবই সংশ্লিষ্ট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যাবে। নতুন বছরের একদম শুরুতে শিক্ষার্থীদের হাতে পাঠ্য বই পৌঁছে যাবে।
গত কয়েক বছর থেকে বছরের শুরুতে শিক্ষার্থীদের হাতে বই পৌঁছে দেয়া শিক্ষাক্ষেত্রে এই সরকারের অন্যতম প্রশংসনীয় কাজ। আমাদের সময় বই কিনে পড়তে হতো। এরপরও সব বই হাতে পেতে কোনো কোনো সময় তিন-চার মাস লেগে যেতো। যাই হউক, উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত অন্যান্য শ্রেণিতেও পর্যায়ক্রমে নতুন শিক্ষাক্রম চালু হবে এবং ২০২৭ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে তা' সব শ্রেণিতে কার্যকর হবে। এর রূপরেখা ইতোমধ্যে আমরা জানতে পেরেছি। প্রত্যেকে এটিকে ইতিবাচক হিসেবে গ্রহণ করেছেন।
শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত আমরা যারা শিক্ষক ছিলাম বা আছি, তারাও এর মাধ্যমে শিক্ষায় একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবার সম্ভাবনা প্রত্যক্ষ করছি। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় এটি একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করবে। তদুপরি মনের ভেতর একটা আশংকা থেকে যায়। নতুন কারিকুলামটি পূর্বের অন্যান্য কারিকুলাম ও সিলেবাসের ন্যায় কতটুকু সফল হবে?
একটি বিষয় স্পষ্ট যে, নতুন কারিকুলামে আমরা সৃজনশীল পদ্ধতি থেকে বেরিয়ে যাচ্ছি। গত ১০ বছরে আমরা এই পদ্ধতি থেকে কি কি অর্জন করতে পেরেছি, আর কি কি অর্জন করতে পারিনি, না পেরে থাকলে কেনো পারিনি- এ সব নিয়ে কোনো পর্যবেক্ষণ আছে বলে মনে হয় না। এ নিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়, মাউশি, এনসিটিবি বা শিক্ষাবোর্ডের কোনো ব্যাখ্যা নেই।
সৃজনশীল পদ্ধতিতে আমাদের কোটি কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। এর নামে শত কোটি টাকা নিশ্চয় দুর্নীতিও হয়েছে। কিন্তু, এর সুফল আমরা কতটুকু পেয়েছি? শিক্ষায় যে কোনো পদ্ধতি বাস্তবায়নে কী কী পদ্ধতি অনুসরণ করা উচিত এবং এর প্রতিবন্ধকতা কি কি হতে পারে, প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হলে তা' কীভাবে অতিক্রম করা যাবে, তা নিয়ে গবেষণা প্রয়োজন।
আমাদের দেশে কথিত শিক্ষাবিদ ও শিক্ষা গবেষণা কর্মকর্তার অভাব নেই। জেলায় জেলায় শিক্ষা অফিসে গবেষণা কর্মকর্তা আছেন। এরা শিক্ষা নিয়ে কী গবেষণা করেন, কে জানে? এতো কিছুর পরও শিক্ষায় আমাদের দৈন্য দশা অন্যের চেয়ে বেশি। কারিকুলাম কিংবা সিলেবাস যেটিই হোক না কেনো, শিক্ষকেরা সেটি বাস্তবায়নের মুল চালিকা শক্তি। অথচ দুঃখজনক হলেও সত্য, বরাবর সিলেবাস ও কারিকুলাম প্রণয়ন থেকে শুরু করে প্রতিটি পর্যায়ে শিক্ষকরা অবহেলিত থেকে যান। এসব প্রণয়নে শিক্ষকদের অংশগ্রহণ তেমন দেখা যায় না। সিলেবাস ও কারিকুলাম প্রণয়নে মাঠ পর্যায়ের অভিজ্ঞ শিক্ষকদের কেউ ডাকে বলে মনে হয় না। তাঁদের মধ্যে অনেক প্রতিভাবান ও মেধাবী শিক্ষক আছেন। অনেক সিনিয়র শিক্ষক আছেন যারা কারিকুলাম বিশেষজ্ঞের চেয়েও অভিজ্ঞ।
আরেকটি বিষয় লক্ষ্যণীয়, নতুন কারিকুলামের আলোকে প্রস্তুত না করে তা বাস্তবায়নের মতো কঠিন কাজটি শিক্ষকদের ওপর ছেড়ে দেয়া হয়। তাঁদের পরিবার পরিজন নিয়ে খেয়ে পরে বেঁচে থাকার বিষয়টি কেউ চিন্তা করে না। সৈনিকদের যুদ্ধের কলা কৌশল না শিখিয়ে যুদ্ধের মাঠে নামিয়ে দেয়ার মতো অবস্থা। এর ওপর তাদের ঠিক মতো খাদ্য ও রসদ সরবরাহ করা না হলে ক্ষুধার্ত কিংবা খালি পেটে তারা কীভাবে যুদ্ধ জয় করবেন?
যারা এনসিটিবিতে কাজ করেন এবং যারা কারিকুলাম ও সিলেবাস বিশেষজ্ঞ থাকেন, তাদের অনেক সুযোগ সুবিধা দেয়া হয। অথচ মাঠ পর্যায়ে যারা সিলেবাস ও কারিকুলাম বাস্তবায়নে কাজ করেন, জাতির মহান কারিগর সে সব শিক্ষকদের নিয়ে কারো চিন্তা নেই। তাঁদের দৈনন্দিন ব্যক্তিগত কিংবা পারিবারিক জীবন নিয়ে কারো মাথা ব্যথা নেই। এক শ্রেণির লোক মনে করে, শিক্ষকরা গুরুজন। তাঁদের সম্মান অনেক। টাকা পয়সার লোভ তাঁদের থাকা উচিত নয়। আগেকার দিনে শিক্ষকেরা টাকা পয়সার পেছনে এতো ঘুর ঘুর করেননি। এই হলো তাদের কথা। আমাদের কথা হলো, যারা এসব কথা বলে তারা এখানে লোভের কী দেখতে পেলো? শিক্ষকরাও মানুষ। তাদেরও পেট, পিঠ আছে। স্ত্রী-সন্তান আছেন। ভাই-বোন এবং বাবা-মা আছেন। অসুখ-বিসুখ থাকতেই পারে।
আগেকার দিনে জমিদার ঘরের সন্তানেরা শিক্ষকতায় আসতেন। শখের বশে শিক্ষকতা করতেন। তাঁদের আর্থিক কোনো দৈন্যতা ছিলো না। আজকাল অবস্থাপন্ন পরিবারের লোকজন শিক্ষকতায় আসেন না। তারা নানাভাবে বিভিন্ন ক্যাডারে ঢুকে পড়েন। পড়াশুনার খরচ বেশি বলে তারাই ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হন। শিক্ষকতাকে আজকাল অনেকে নগণ্য পেশা মনে করেন। ইদানিং বেশিরভাগ মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত এমনকি নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তানেরা শিক্ষকতায় আসেন। তাঁদের অনেক মেধা ও প্রতিভা আছে বটে। কিন্তু, আর্থিক সুযোগ-সুবিধা ও সামাজিক মর্যাদা কম থাকার কারণে নিজেদের মেলে ধরতে পারেন না। নিজের সুপ্ত প্রতিভা বিকাশের খুব একটা সুযোগ পান না।
শিক্ষকদের যথাযথ সামাজিক ও আর্থিক মর্যাদা না দেবার কারণে সিলেবাস ও কারিকুলাম বাস্তবায়নে তারা তেমন একটা মনোযোগ দিতে পারেন না।
আমার দীর্ঘদিনের শিক্ষকতা জীবনে আরেকটি বিষয় লক্ষ্য করেছি। তা হলো, অনেক সময় সাধারণ শিক্ষকদের হাতে সময়মতো সিলেবাস ও কারিকুলাম পৌঁছে না। প্রায়ই দেখা যায়, সিলেবাস ও কারিকুলামের বই এনসিটিবি, শিক্ষাবোর্ড ও শিক্ষা অফিসের গোডাউনে পড়ে থাকে। এক সময় পুরাতন বইপুস্তক কিংবা কাগজের মতো কেজি দরে বিক্রি হয়ে যায়। বেশিরভাগ শিক্ষক ও শিক্ষার্থী নতুন কারিকুলামের বিষয়ে তেমন কিছু জানতে পারেন না। এই রকম করে করে এক সময় সিলেবাস ও কারিকুলাম পরিবর্তনের হাকডাক পড়ে যায়। এখন ইন্টারনেটের যুগ। এনসিটিবি বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ নতুন কারিকুলাম তাদের ওয়েবসাইটে দিয়েই দায়িত্ব শেষ করে ফেলবে। কেউ পড়লে পড়ুক আর না পডুক। তাদের কিছু যাবেও না, আসবেও না। এই হলো অবস্থা। প্রশিক্ষণের নামে শিক্ষকদের প্রকৃত অর্থে কতটুকু প্রশিক্ষিত করে তোলা সম্ভব হয়, সেটি কেউ খতিয়ে দেখে না। গত দশ বছরে সৃজনশীল পদ্ধতির উপর অনেক ট্রেনিং হয়েছে। কিন্তু, প্রকৃত অর্থে আমাদের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা কতটুকু সৃজনশীলতা জানতে বা শিখতে পেরেছেন?
সৃজনশীল প্রশ্নপত্র প্রণয়নে আমরা শিক্ষকরা অনেক বিতর্কের জন্ম দিয়েছি। পাঠ্যপুস্তক নিয়েও বিতর্ক কম হয়নি। উত্তরপত্র মুল্যায়নেও তেমন সফলতা নেই। সৃজনশীল পদ্ধতির শেষ সময়ে এসেও পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্নপত্রে বিতর্কিত উদ্দীপক জুড়ে দিয়ে সৃজনশীল পদ্ধতির ওপর আমাদের দৈন্যতার পরিচয় দিয়েছি। এতোগুলো বছরে আমরা তাহলে কী শেখলাম?
গত দু'তিন দিন আগে মাউশি অধিদপ্তর নতুন কারিকুলামের ওপর শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেবার জন্য উপজেলা পর্যায়ের নির্বাচিত মাস্টার ট্রেইনারদের তালিকা প্রকাশ করেছে। জানিনা, কোন কোন যোগ্যতার ভিত্তিতে তাঁদের নির্বাচিত করা হয়েছে? কোথাও কোথাও নাকি এক বিষয়ের শিক্ষককে অন্য বিষয়ের মাস্টার ট্রেইনার নির্বাচিত করা হয়েছে। কৃষি শিক্ষা বিষয়ের শিক্ষককে ডিজিটাল প্রযুক্তি বিষয়ের প্রশিক্ষক নির্বাচিত করা হযেছে। ধর্ম শিক্ষার শিক্ষককে বিজ্ঞানে দেয়া হয়েছে। গণিত কিংবা ইংরেজি পড়ান না এমন শিক্ষক গণিত ও ইংরেজির মাস্টার ট্রেইনার হয়েছেন। অনেক সিনিয়র শিক্ষকের পরিবর্তে মাত্র ছয় মাস বা এক বছর ধরে শিক্ষকতায় নিয়োজিত ব্যক্তিদের ট্রেইনার করা হয়েছে। শিক্ষা অফিসের লোকজনকে টাকা পয়সা খাইয়ে কেউ কেউ মাস্টার ট্রেইনার নির্বাচিত হয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এসব বলতে ও শুনতে খারাপ লাগে। আমাদের শিক্ষায় আজকাল হরহামেশা এসব অনিয়ম হচ্ছে। পাবলিক পরীক্ষায় প্রশ্ন প্রণয়ন, মডারেশন, উত্তরপত্র মুল্যায়ন ইত্যাদি কাজে এ জাতীয় নানা অনিয়ম হয়ে থাকে। এর ফলে আসল উদ্দেশ্য ব্যহত হয়।
নতুন কারিকুলামে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হতে আর মাত্র কয়দিন বাকি আছে। অথচ এখনো উপজেলা পর্যায়ের মাস্টার ট্রেইনারদের প্রশিক্ষণ হয় নাই। মাঠ পর্যায়ে সাধারণ শিক্ষকদের ট্রেনিং কোনদিন হবে একমাত্র আল্লাহ জানেন। অন্তত বছর, ছয় মাস আগে থেকে শিক্ষকদের প্রশিক্ষিত করে রাখা উচিত ছিলো। যুদ্ধের দামামা বেজে ওঠার আগেই সৈন্যদের প্রশিক্ষণ শেষ করে পর্যাপ্ত খাদ্য ও রসদ এবং আপদকালীন যাবতীয় প্রস্তুতিসহ যুদ্ধের মাঠে পাঠাতে হয়। তা না হলে সেই যুদ্ধে পরাজয় অবশ্যম্ভাবী। আমাদের শিক্ষা প্রশাসনের লোকজন এসব বিষয় আদৌ উপলব্ধি করেন না। যতো পারেন শিক্ষকদের ঠকানোর ধান্ধা তাদের মাথায়। নতুন কারিকুলাম শুরু হতে যাচ্ছে। অথচ আরো এক বছরে ট্রেনিংয়ের প্রথম ধাপ শেষ হবে কি-না, কে জানে? এদিকে ফেস টু ফেস প্রশিক্ষণের আগে শিক্ষকদের বিষয়ভিত্তিক অনলাইন প্রশিক্ষণের একটি কর্মসুচি মাউশি থেকে দেয়া হয়েছে। প্রশিক্ষণের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় অনলাইনে কতটুকু সফল হবে, সে বিষয়ে আমি সন্দিহান। করোনাকালীন সময়ে অনলাইন শিক্ষা চালু করে আমরা কতটঁকু সফল হয়েছি?
এই চিন্তা করলে অনলাইন প্রশিক্ষণের অসারতা সহজেই অনুমেয়। এছাড়া আমাদের কয়জন শিক্ষকের ল্যাপটপ কিংবা স্মার্ট ফোন আছে? ডাটা কেনার ব্যাপার রয়েছে। গ্রামে-গঞ্জে সব সময় নেটওয়ার্ক থাকে না। সত্যি কথা বলতে কি, শিক্ষকদের একটি অংশ আছেন যারা ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহারে উৎসাহী কিংবা পারদর্শী কোনটিই নহেন। সব মিলিয়ে অনলাইন প্রশিক্ষণে আমি অন্তত কোনো সুফল দেখতে পাই না।
শিক্ষক প্রশিক্ষণের মতো অতীব জরুরি বিষয়ে আমাদের অবহেলা বরাবর লক্ষ্যণীয়। যত্রতত্র টিচার্স ট্রেনিং কলেজ স্থাপন করে বুনিয়াদি শিক্ষক প্রশিক্ষণ বি.এড'র মান এখন তলানিতে নেমেছে। অনেক বেসরকারি টিটি কলেজ টাকার বিনিময়ে সার্টিফিকেট দেয় বলে শুনেছি। প্রত্যেক জেলা সদরে একটি করে সরকারি টিটি কলেজ বসালে কী হয়? এক সময় সারা দেশে ১ টি মাত্র সরকারি টিটি কলেজ ছিলো। কোনো বেসরকারি টিটি কলেজ ছিলো না। এখন সারা দেশে অলিতে গলিতে অসংখ্য বেসরকারি টিটি কলেজ। অনেকে সারা বছর নিজের চাকরি চালিয়ে বাড়িতে বসে কেবল নিয়মিত বেতন ও ফি দিয়ে নামমাত্র পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে বি.এড ডিগ্রি অর্জন করে ফেলেন। তারা শিক্ষক হবার মূল মন্ত্রটি কোনোদিন অর্জন করতে পারেন না। বেশিরভাগ শিক্ষক বেতন স্কেল পরিবর্তনের জন্য বি.এড করেন।
পাঠদানের কলা কৌশল আয়ত্ত করার জন্য নয়। এভাবে আমাদের দেশে বেশিরভাগ শিক্ষক প্রশিক্ষণ কার্যক্রম একটি হ-য-ব-র-ল অবস্থার মধ্যে শুরু হয়ে একই অবস্থায় চলতে থাকে। এতে দেশ ও জাতি উপকৃত হবার সুযোগ থাকে না। এ কারণে আমাদের শিক্ষার দৈন্য দশা লেগেই আছে। প্রত্যেক বার আমাদের নতুন শিক্ষাক্রম একটা পর্যায়ে গিয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে যায়।
লেখক : অধ্যক্ষ মুজম্মিল আলী, আবাসিক সম্পাদক (লন্ডন), দৈনিক শিক্ষাডটকম