শিক্ষকদের প্রতিজ্ঞা কী? - দৈনিকশিক্ষা

শিক্ষকদের প্রতিজ্ঞা কী?

মাছুম বিল্লাহ |

ফেসবুকে একজন শিক্ষক লিখেছেন, ‘শিক্ষকতা পেশা! বই পুস্তকে লেখা মহান পেশা! আমার দৃষ্টিতে ঘৃণিত পেশা। এ পেশায় আপনি যদি কারো ভাল চান তাহলে নির্ঘাত আপনি অধিকাংশের চোখে খারাপ হবেন। কেননা এ দেশের বর্তমান শিক্ষার্থীদের থেকে তাদের অভিভাবকরা খুবই ভয়ানক! তারা বেশিরভাগই চায় সার্টিফিকেট; লেখাপড়া না। ক্লাসে তো নিয়মিত সন্তানদের পাঠায়ই না, আর পড়া তো পড়েই না। আবার জবাবদিহিতার আওতায় আনলেও ঝামেলা! আর শাসন করা তো অপরাধ! ৯০ শতাংশের মতো শিক্ষার্থী কোনও বিষয়ের পড়া একদিনও দিতে পারে না। তাদেরকে জিজ্ঞাসা করা আর না করা সমান। সারা ক্লাস বয়ান দেবেন তাদের জিজ্ঞেস করলে এক শব্দও বলতে পারবে না। এমনকি ক্লাসে দুষ্টুমিতেও এরা আগানো। অনেক স্টুডেন্ট আছে ক্লাসের নাম করে এসে এখানে সেখানে আড্ডা দেয়, নেশা করে, অনৈতিক কাজ করে। আপনি শিক্ষক কিছু বলতে পারবেন না। এরাই যখন পরীক্ষা দেবে, দেখবেন নকল করবে, না হয় আপনাকে নকল বের করে দিতে হবে। বের করে দেবেন না খবর আছে!  খাতা টানবেন, দেখাদেখি বন্ধ করবেন, বাইরে বের হলে মার খাবেন। অর্থাৎ আপনি যা করবেন তাতেই দোষ। কারণ আপনার সুরক্ষার কোনও আইন নেই। এমনকি আপনার পেশায় পর্যাপ্ত বেতনও নেই। খামোখা টিচার হওয়ার স্বপ্ন দেখেন কেন? আর টিচার না হয়ে যদি চিটার হতে চান তাতে এ পেশা মন্দ নয়। আপনি হয়তোবা মনে মনে ভাবছেন, উপায় কি? আসলে শিক্ষকতা পেশা যোগ্য বা মেধাবীদের জন্য নয়। এটা টেনে টুনে পাস করা বা ঘুষ দিয়ে চাকরি নেয়াদের জন্য ভাল। এ পরিবেশে দ্রুতই তারা খাপ খাইয়ে নিতে পারবে। তাদের শেখানোর কোনও প্রচেষ্টা থাকবে না, রাগও আসবে না। আবার কারো রোষানলেও পড়বে না। নকলে সহায়তা করতেও অসুবিধা হবেনা। আসুন যোগ্যতা থাকলে শিক্ষকতা পেশাকে বয়কট করি। এটা আমার ৫ বছরের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি।’

ওই শিক্ষক যা বলেছেন বাংলাদেশের সব বিদ্যালয়ই এরকম নয়, তবে  অধিকাংশের প্রায় একই চিত্র। বিশেষ করে মফ:স্বলের বিদ্যালয় ও কলেজগুলোর। আজ বিশ্ব শিক্ষক দিবস পালিত হচেছ সারা বিশ্বে এবং বাংলাদেশে এই প্রথমবার রাষ্ট্রীয় তরফে পালিত হচেছ বলে মন্ত্রণালয় থেকে বলা হচ্ছে। প্রতিপাদ্য হচেছ,  ““The teachers we need for the education we want: The global imperative to reverse the teacher shortage”. অর্থাৎ ‘আমরা যে শিক্ষা গ্রহণ করতে চাই তার জন্য প্রয়োজন উপযুক্ত শিক্ষক:  শিক্ষকের স্বল্পতা কাটানো বৈশ্বিক দাবি।’  

এতে মানসম্পন্ন শিক্ষকের স্বল্পতা দূরীকরণের  কথাই  বলা হচেছ। ওপরে উল্লেখিত শিক্ষকের যে অভিজ্ঞতা, যে বাস্তবতার কথা তিনি তুলে ধরেছেন তার সাথে বর্তমান অবস্থার দূরত্ব কীভাবে কমানো যায় সেটি নিয়ে কিন্তু শুধু আলোচনা নয়, জাতীয় পর্যায়ে সেমিনার হওয়া প্রয়োজন। কিন্ত কে করবেন এসব? আমাদের শিক্ষক সংগঠনগুলোর কিন্তু অনেক কিছু করার আছে।

এর সাথে যদি আর একটি বিষয়ের অবতারণা করি করি তাহলে দেখা যায়,  ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশের শিক্ষাখাতে বরাদ্দ ছিলো  জিডিপির ১ দশমিক ৮৩ শতাংশ। আফগানিস্তানে ছিলো এটি ৪ দশমিক ৬ শতাংশ, ভুটানে ৫ দশমিক ৬৮ শতাংশ, নেপালে ৪ দশমিক ৩৯ শতাংশ, ভারতে ৫ দশমিক ৫৭, শ্রীলংকায় ৪ দশমিক ২, পাকিস্তানে ২ দশমিক ৫ এবং মালদ্বীপে ৪ দশমিক ১২ (সূত্র: সিপিডি-ক্যাম্পেইন: এডুকেশন বাজেট জুন ২০২২)। 

যদিও বাংলাদেশ এখন বিশ্বের ২৫তম বড় অর্থনীতির দেশ। জাতীয় মোট বাজেটের ২০ শতাংশ এবং জিডিপির ৬ শতাংশ শিক্ষাখাতে বরাদ্দ রাখার যে প্রেসক্রিপশন ইউনেস্কো বহু বছর আগেই দিয়েছে, বাংলাদেশ তার ধারে কাছেও যেতে পারছে না বা যাচেছ না। জাতীয় বাজেটের ১২ শতাংশের নীচে আর জিডিপির দুই শতাংশের সামান্য একটু উপরে না নীচেই থেকে যাচেছ আমাদের শিক্ষাবাজেট। ফলে শিক্ষাখাত কিন্তু বাস্তবে অবহেলিতই থেকে যাচেছ। যদিও বক্তৃতায় বা আলোচনায় এটি অনেক উপরের দিকে অবস্থানের কথা বলা হয়। শিক্ষমান্ত্রী মাঝে মাঝেই বলে থাকেন ‘বাই চান্স শিক্ষক নয়, আমদের মনে-প্রাণে শিক্ষক দরকার’।  

২০৩০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত আমদের একটা দারুণ সুযোগ রয়েছে। এর মধ্যেই আমাদের যোগ্য প্রজন্ম গড়ে তুলতে হবে। এ জন্য শিক্ষাই প্রধান হাতিয়ার। শিক্ষাই হবে মেগা প্রকল্প। তাই আমাদের শিক্ষকদের পেশাগত মর্যাদা ও অর্থিক অবস্থার উন্নয়ন ঘটাতে হবে। মনে-প্রাণে যারা শিক্ষক তাদের  মাধ্যমেই আমরা দক্ষ, যোগ্য ও মানবিক মানুষ গড়ে তুলতে চাই। এক্ষেত্রে সময়ের প্রয়োজনেই তাকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে এগিয়ে থাকতে হবে।- এ কথাও বলেছেন শিক্ষামন্ত্রী। তিনি আরো বলেছেন, উপনিবেশিক শিক্ষার আগের শিক্ষাব্যবস্থা ছিলো অনেক ঋদ্ধ। তখন গুরু-শিষ্যের শিক্ষা ছিলো। কিন্তু আমরা দীর্ঘ উপনিবেশিক শিক্ষায় আটকে ছিলাম। সেখানে থেকে বেরিয়ে এখন আমরা নতুন ও পরবর্তী প্রজন্মকে অনিশ্চিত অজানা ভবিষ্যতের জন্য সেট অব স্কিল শেখাচিছ। সফট স্কিলের পাশাপাশি দলগতভাবে কাজের দক্ষতা, পরমত সহিষ্ণুতা ও চিন্তা শক্তির মাধ্যমে সমাধানমুখী শিক্ষা ব্যবস্থায় নিয়ে আসছি। আমরা করে করে শেখার পদ্ধতি চালু করেছি। আশা করছি ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে পুরোপুরি নতুন একটা কারিকুলামে চলে যেতে পারব। 

 ‘স্মার্ট সিটিজেনরাই’ স্মার্ট বাংলাদেশের কেন্দ্রে থাকবে বলে মন্তব্য করে মন্ত্রী বলেন, স্মার্ট ইকোনমি, স্মার্ট সোসাইটি এবং স্মার্ট গভর্নমেন্ট আবর্তিত হবে এই স্মার্ট সিটিজেন দিয়েই। আর সেই স্মার্টই হবে দক্ষ, যোগ্য, সৃজনশীল, মানবিক, অসাম্প্রদায়িক, পরমতসহিষ্ণু ও মানবিক। 

ব্রুকিং রিপোর্ট (২০১৬) থেকে জানা যায়, পৃথিবীর ১০২টি দেশের মধ্যে ৭৬টি দেশের শিক্ষাক্রমে সুনির্দিষ্টভাবে দক্ষতাভিত্তিক যোগ্যতাকে নির্ধারণ করা হয়েছে এবং ৫১টি দেশের শিক্ষাক্রম সম্পূর্নরূপে রূপান্তরমূলক দক্ষতাভিত্তিক করা হয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার ভুটান, ভারত, নেপাল, শ্রীলংকার পাশাপাশি বাংলাদেশও সম্প্রতি প্রাক-প্রাথমিক থেকে উচচ মাধ্যমিক পর্যন্ত একই উদ্দেশ্য অর্জনের মাধ্যমে একটি রূপান্তরমূলক যোগ্যতা ও সৃজনশীলতাসম্পন্ন জাতি তৈরির লক্ষ্য নিয়ে একটি নিরবচিছন্ন জাতীয় শিক্ষাত্রুম রূপরেখা ২০২১ প্রণয়ন করেছে। এ লক্ষ্য অর্জনে অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিখন শেখানো প্রক্রিয়ার চর্চা এবং শিখনকালীন মূল্যায়ন করা হবে। 

শিক্ষা শুধু বিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষে আবদ্ধ থাকবে না; ছড়িয়ে যাবে শিক্ষার্থীর প্রতিটি কাজ ও অভিজ্ঞতার মাঝে। শিক্ষার্থীরা সাধারণ শিক্ষায় থেকেই জীবিকা সংশ্লিষ্ট দক্ষতা অর্জনের সুযোগ পাবেন। এ কথা ও উদ্দেশ্যাবলীল সাথে বাস্তব শিক্ষার অর্থাৎ নতুন কারিকুলামের বাস্তবায়ন চিত্রটি কি আমরা দেখার চেষ্টা করছি কেউ, না চমৎকার কথাগুলোই বলে যাচিছ কেবল? এসব আলোচানার দিনও আজ। 

শিক্ষকদের তৈরি করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব, প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব এবং সর্বোপরি শিক্ষকের নিজের দায়িত্ব। রাষ্ট্র কবে আমাকে প্রস্তত করবে তারপরে আমি ভালভাবে পড়াতে শুরু করব কিংবা রাষ্ট্র আমাকে তৈরি করেনি তাই আমি ভাল টিচিং দিচিছনা কিংবা দিবনা এই মনোভাবও কিন্তু আমাদের পরিহার করতে হবে। 

এ ধরনের মনোভাব কিন্তু আমাদের শিক্ষকদের মধ্যে আছে যে, রাষ্ট্র আমাদের কম বেতন দেয়। অতএব আমরা সার্ভিসও সেভাবে দেবো। এটি হলে কিন্তু আমাদের পেশাগত অবস্থান আরও নীচে নেমে যেতে পারে। কাজেই আমরা আমাদের পেশাগত উন্নয়নের প্রচেষ্টা চালিয়ে যাব। এটি আমাদের কাছ থেকে কেউ ছিনিয়ে নিতে পারবে না। 

আমাদের গ্রামীণ এলাকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর অবস্থা কিন্তু ফেসবুকে যে শিক্ষক লিখেছেন সেরকমই। তাই বলে কি আমরা শিক্ষকতা ছেড়ে দেবো? কাউকে না কাউকে এই গুরু দায়িত্ব পালন করতেই হবে। বর্তমানে চালু হওয়া দক্ষতাভিত্তিক কারিকুলামে সামেটিভ অ্যাসেসমেন্টের চেয়ে ফরমেটিভ অ্যাসেসমেন্ট অর্থাৎ শিক্ষার্থীদের শেণিকক্ষে মূল্যায়ন ও তাদের বিভিন্ন প্রজেক্ট ওয়ার্ক, প্রেজেনটেশন, দলগত কাজ ইত্যাদির মাধ্যমে তাদের প্রতিদিনই মুল্যায়ন করা হচেছ। এটি অনেক কঠিন কাজ এবং নতুন। এসব কারণে অনেক শিক্ষার্থী আর আগের মতো শ্রেণিকক্ষে আসে না। অভিভাবকরাও মনে করেন, তাদের ছেলেমেয়েদের দরকার পাস করা। তারা মনে করেন, বর্তমান পদ্ধতিতে বিদ্যালয়ে না গিয়েও শিক্ষার্থীরা পাস করে যাবেন। তাহলে এতো কষ্ট করার কি দরকার? শিক্ষকরা এর ভালমন্দ নিয়ে কথা বলতে পারেন, সেমিনার করতে পারেন, গবেষণা করতে পারেন এবং আপনার ও আপনাদের গবেলনালব্ধ ফল জাতির সম্মুখে প্রকাশ করতে পারেন। সেটি হবে শিক্ষকদের জন্য একটি যথার্থ কাজ। কিন্ত এ জাতীয় কাজের প্র্যাকটিস শিক্ষকদের মধ্যে দেখতে পাই না। তাহলে আমরা সমাজের লিডার কিংবা অভিভাবক হিসেবে নিজেদের কীভাবে দাবী করব? 

আজকের এই বিশ্ব শিক্ষক দিবসে নিজেদের উন্নয়ন, পেশাগত উন্নয়ন ও রাষ্ট্রের সাথে সম্পর্কের বিষয়টি নিয়ে অত্যন্ত পেশাদারিত্বের মনোভাব নিয়ে আলোচনা করতে হবে এবং সিদ্ধান্তে পৌঁছুতে হবে। পেশাদরিত্ব ও নেতৃত্ব যদি শিক্ষকরা নিজেরা না নেন তাহলে কেউ তাদেরকে এটি দিয়ে যাবে না। 


লেখক : মাছুম বিল্লাহ, প্রেসিডেন্ট, ইংলিশ টিচার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ 

 

‘২৬ লাখ টাকা’র প্রধান শিক্ষক নাজমার শাস্তি দাবি আনন্দময়ী স্কুল ছাত্রীদের - dainik shiksha ‘২৬ লাখ টাকা’র প্রধান শিক্ষক নাজমার শাস্তি দাবি আনন্দময়ী স্কুল ছাত্রীদের জানুয়ারিতেই শিক্ষার্থীদের হাতে বই তুলে দেয়া হবে: গণশিক্ষা উপদেষ্টা - dainik shiksha জানুয়ারিতেই শিক্ষার্থীদের হাতে বই তুলে দেয়া হবে: গণশিক্ষা উপদেষ্টা ইএফটিতে বেতন: ব্যাংক হিসাব নিয়ে এমপিও শিক্ষকদের অসন্তোষ - dainik shiksha ইএফটিতে বেতন: ব্যাংক হিসাব নিয়ে এমপিও শিক্ষকদের অসন্তোষ পবিপ্রবিতে গাঁজাসহ ৫ মাদকসেবী আটক - dainik shiksha পবিপ্রবিতে গাঁজাসহ ৫ মাদকসেবী আটক ভর্তিতে লটারি বাতিলের দাবিতে সড়ক আটকে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ - dainik shiksha ভর্তিতে লটারি বাতিলের দাবিতে সড়ক আটকে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ প্রাথমিকের ১০ম গ্রেডের দাবি সর্বজনীন - dainik shiksha প্রাথমিকের ১০ম গ্রেডের দাবি সর্বজনীন কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক - dainik shiksha কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক ৬ষ্ঠ ও ৮ম শ্রেণির বাদপড়া শিক্ষার্থীদের রেজিস্ট্রেশনের সুযোগ - dainik shiksha ৬ষ্ঠ ও ৮ম শ্রেণির বাদপড়া শিক্ষার্থীদের রেজিস্ট্রেশনের সুযোগ দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0032229423522949