কাট পেস্ট করে পিএইচডির থিসিস লিখে ডিগ্রি অর্জন করা, অন্যের লেখা কপি করে নিজের নামে চালিয়ে দেওয়ার বিষয় এখন বেশ আলোচিত। অন্য পত্রিকায় ছাপা হওয়া বিশেষ করে ‘দৈনিক শিক্ষাডটকম-এ’ ছাপা হওয়া আমার কিছু কিছু লেখা অন্যকিছু নামধারী পত্রিকায় ছাপা হচ্ছে কোনো ধরনের রেফারেন্স বা সূত্র উল্লেখ ছাড়াই। মাঝে মাঝে আমার লেখা হুবহু তুলে দিয়ে আমার ছবির স্থলে চৌর্যবৃত্তির আশ্রয় নেওয়া শিক্ষক নিজের ছবি বসিয়ে দিয়ে শিক্ষা বিশেষজ্ঞ টাইটেল ঠিক রেখে ছাপানো হয়েছে শিক্ষা বাতায়নে। কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করে বিষয়টি তাদের নজরে আনলাম, তারা খুব একটা গুরুত্ব দিলেন না। বুঝলাম তাদেরও খুব একটা কিছু করার নেই বা ওই কাজটাকে তারাও আদৌ অনৈতিক মনে করেন কিনা। কারন একজন লেখক লিখে পাঠিয়েছেন সেটি অন্য কেউ কোথাও লিখেছেন কিনা, বা সেটাও কপি করে লেখা কীনা, সেটি দেখার মতো অবস্থায় সবাই, সব সময় থাকেন না। এটাও অনেকটা যুক্তিসঙ্গত। বিষয়টি লেখকের সঙ্গেই বেশি সংশ্লিষ্ট। অন্য একটি পত্রিকায় দেখলাম আমার লেখা হুবহু অন্য আর এক ব্যক্তির নামে ছাপা হয়েছে। হয়তো তিন-চারদিনের ব্যবধানে অর্থাৎ আমার লেখা ছাপা হওয়ার দিন তিনেকের মধ্যে এই ঘটনা ঘটেছে। পত্রিকায় ফোন করার পর উক্ত লেখকের নম্বর দিলেন। কোনওরকম লেখকের সঙ্গে যোগাযোগ করলাম কিন্তু বিষয়টি তিনি অস্বীকার করলেন, উদাহরণ দিলে দাবি করলেন’ ‘ওটা আমি নিজেই লিখেছি’ এবং তাড়াতাড়ী ফোন সংযোগটা কেটে দিলেন। এ ছাড়াও বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন ধরনের লেখা কোন ধরনের রেফারেন্স ছাড়াই দেদার ছাপানো হচ্ছে। একজন দায়িত্বপ্রাপ্ত এডিটরকে বিষয়টি জানালে তিনি বলেছিলেন, এই যুগে খুব একটা কিছুই করার নেই। কোন পপুলার বিষয় লেখা হলে এ রকমটা হবেই।
কোনো একটা বিষয়ে প্রকৃত ও নিরন্তর গবেষণা করে একজন গবেষককে কোনো একটি বিষয়ের গভীর প্রবেশ করতে হয়। সেটার প্রকৃত অবস্থা যাচাই-বাছাই করার পর নতুন কিছু আবিষ্কার করা এবং সেই আবিষ্কারের বিষয়টি হাতে-কলমে সংশ্লিষ্টদের মাঝে প্রমানসহ উপস্থাপন করা, প্রদর্শন করা, ছড়িয়ে দেওয়া এবং দর্শকের মুখ থেকেই শোনা ও সার্টিফিকেট পাওয়া যে, বিষয়টিতে নতুনত্ব আছে, বিষয়টি ব্যবহার যোগ্য এবং প্রকৃতঅর্থেই এটা শিক্ষায় কিংবা যে বিষয়ে গবেষণাটি করা হয়েছে সেখানে সুফল বয়ে আনবে। তখন, সুপারভাইজররসহ একদল প্রকৃত গবেষক সার্টিফাই করবেন যে, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি গবেষণা করার যোগ্যতা রাখেন এবং তার গবেষণা শিক্ষার কল্যাণে/তার নিজ বিষয়ের কল্যাণে, মনবতার কল্যাণে কাজে আসবে। এভাবে সার্টিফাইড হলে একজন গবেষক হওয়ার বা পিএইচডি অর্জন করার সার্থকতা থাকে এবং যিনি ডিগ্রিটা নিয়েছেন তারও তৃপ্তি আসে। এখন যেটা হয়েছে, যে বিষয়ে গবেষণা করা হচ্ছে সেই বিষয়টি নিয়ে মাঠে যাওয়ার ধারেকাছেও ঘটনা ঘটে না বা হলেও সেটি দায়সারা গোছের। একবার যেতে হবে তাই যাওয়া, একবার বলতে হবে তাই বলা, কোশ্চেনেয়ার পূরণ করাতে হবে তাই করানো। আর বাকী সব অন্য লেখকদের পূর্বে যারা ডিগ্রি অর্জন করেছেন তাদের বিষয় হুবহু তুলে দিয়ে এখন অনেকেই অর্জন করছেন পিএইচডি। সেদিন একজন লিখেছেন এখন বাংলাদেশে এত পিএইচডি, দেশে ডলারের যে সংকট চলছে তাতে এসব পিএইচডি রপ্তানী করে সংকট মেটানোর চেষ্টা করা যেতে পারে!। এর কারণ একটাই-লেখা নকল করে পিএইচডি ডিগ্রি নেয়া। ডিগ্রি নিতে হবে তাই লেখা চুরি করো। যেনো, কে কার খবর রাখে। এমনকি সুপারভাইজারও এগুলো খেয়াল করবেন না যে, লেখা চুরি করা হয়েছে। নামী-দামী লোকজনের ক্ষেত্রেও এটা ঘটে চলেছে অহরহ। এই চৌর্যবৃত্তি ঠেকানোর জন্য আবিস্কৃত হয়েছে একটি বিশেষ সফটওয়্যার কিন্তু তাতেও প্রতিরোধ করা যাচ্ছে না এ দুষ্কর্ম।
জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় আমাদের এক শিক্ষক ( যিনি বেশ ক’বছর আগে ইন্তিকাল করেছেন) একদিন বড় ধরনের একটি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সবাইকে জানালেন যে, বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় তাকে ডক্টরেট ডিগি দিয়েছে। আমরা তো তখন প্রথম বা দ্বিতীয়বর্ষের শিক্ষার্থী। পিএইচডি তখনও জিপিএ-৫ এর মতো এত সস্তা হয়নি। আমরা তো ভাবলাম বিশাল ব্যাপার। তখন যেহেতু, সোশ্যাল মিডিয়া বা গুগল ছিল না ফলে কোনো তথ্য হঠাৎ করে দেখা বা জানার বা যাচাইয়ের সুযোগ ছিল না। ব্যক্তিগতভাবে উপস্থিত হয়ে কিংবা ফোন নম্বর সংগ্রহ করে (মোবাইল ফোনও ছিল না) ফোন করে সংশ্লিষ্ট বিভাগ থেকে কোনো খবর জানা অত সহজ ছিল না। তখন বিশ্বভারতী মানে অনেকটা বিলাতের মতোই দূরত্ব মনে হতো। তাছাড়া একজন অধ্যাপক এটা দাবি করেছেন সেটার মধ্যে কোনো ফারাক থাকতে পারে না অন্তত প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীদের কাছে। কিন্তু বিরোধী পক্ষ তো সব সময়ই ছিল, এখনও আছে। তখন হয়তো এতটা আতঙ্কজনক সাদা দল, লাল দল নীল ছিল না, বরং যতটুকু সম্ভব তারা সহাবস্থানই করতেন। তারপরেও তারা খুঁটে খুঁটে বের করেছেন যে, তার পিএইচডিটা ‘ভূয়া’। বিশ্বভারতীতে লোক পাঠিয়ে বিষয়টি প্রমাণিত হয়েছে। পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম অনুযায়ী এবং তখন নিয়ম অ্যাপ্লাই করে (যা এখন সম্ভব নয়) ওই অধ্যাপককে চাকরিচ্যুত করা হলো। পরে স্যারের সঙ্গে একদিন ব্যাংকে দেখা হয়েছিল। খুব তাড়াহুড়ো করে গাড়ীতে উঠে চলে গেলেন। এখন এসবের ঝামেলা নেই। বাসায় বসে বসে লেখা চুরি করা যায়, ইচ্ছেমতো কাটপেস্ট করা যায় আর বড় বড় ডিগ্রি অর্জন করা যায়। কোনোদিন সাংবাদিকতা না করেও হঠাৎ সম্পাদক ও প্রধান সম্পাদক হওয়া যায়। প্রযুক্তি আমাদের জীবনকে অনেক সহজ করে দিয়েছে, এ ধরনের চুর করারও অপার সুযোগ দিয়েছে তাই যারা চালাক তারা সেই সুযোগ তো নেবেনই! পত্রিকার লেখার ক্ষেত্রে এখন তাই হয়েছে, অনেকেই সেটা করছেন। কোথায় নৈতিকতা আর কোথায় সৃষ্টি করার তৃপ্তি! সব যেন উবে গেছে!
বেসরকারি শিক্ষকদের বদলী নিয়ে দু’একজন লেখক সুন্দর সুন্দর ফ্যাক্টস, ফিগার, যুক্তি, সম্ভাব্য সাজেশন, রিকমেন্ডেশন শিক্ষা সংক্রান্ত দেশের একমাত্র প্রিন্ট পত্রিকা দৈনিক আমাদের বার্তা ও ডিজিটাল পত্রিকা দৈনিক শিক্ষাডটকম-এ লিখেছেন। এটা ভাল লক্ষণ যে, এখনও কিছু কিছু শিক্ষক পড়েন, বিষয়টি নিয়ে ভাবেন এবং নিজস্ব মতামত ও সাজেশন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে তুলে ধরার চেষ্টা করেন। সেই একই লেখা বা লেখার একটি বড় অংশ অন্য একজন শিক্ষক হুবহু তুলে ধরেছেন। এভাবে শিক্ষক-লেখক হওয়ার অপচেষ্টা করছেন! এটা নিজের বিবেকের কাছে কেমন মনে হয়? এসব আমাদের পরিহার করতে হবে। অবাধ তথ্য প্রবাহের যুগে, প্রযুক্তির এই যুগে অনেকেই কথিত ‘অনলাইন পত্রিকা’ বা ফেসবকু গ্রুপ ও ইউটিউব খুলেছেন। সেখানে দেখা যায় লেখা চুরির হিড়িক। মানসম্মত লেখকদের সম্মানি দিয়ে যে সব পত্রিকা মানসম্মত লেখা ছাপান, সেই একই লেখকের লেখা যখন অন্যান্য পত্রিকায় কোনো ধরনের রেফারেন্স ছাড়া পুনরায় ছাপা হয় সেটা এক ধরনের মারাত্মক অনৈতিকতা। বিশেষ করে শিক্ষা নিয়ে যারা কাজ করেন তাদের ক্ষেত্রে বিষয়টি বেশ গুরুত্বপূর্ণ। আর একটি বিষয় হচ্ছে ‘মতামত’ বা ‘ওপিনিয়ন’ যা কোনো লেখকের ব্যক্তিগত মতামত, ব্যক্তিগত ধারণা, চিন্তা, ব্যাখ্যা, কোন কিছুর পক্ষে বা বিপক্ষে যুক্তি স্থাপন, সমর্থন ইত্যাদি। এসব ক্ষেত্রে অবধারিতভাবে লেখক থেকে লেখকের ভিন্নতা থাকতেই হবে। এটা কোনোভাবেই চুরি করা যায় না।
কিছু কিছু হঠাৎ লেখক, সিজনাল লেখক অন্যের লেখা চুরি করে চালিয়ে দিচ্ছেন এটি একেবারেই নৈতিকতা বিরোধী। অন্যের ক্ষেত্রে বিষয়টি ঘটলে এতটা বড় করে না দেখলেও শিক্ষকদের ক্ষেত্রে এটি একেবারেই মানানসই নয়। লেখক হতে হলে সাধনার দরকার, প্রাকটিস দরকার, সময় দেয়া প্রয়োজন, পড়াশুনা করা প্রয়োজন। সেই সঙ্গে অনেক কিছু স্যাক্রিফাইস করার মানসিকতাও দরকার হয়। এসব না করে হঠাৎ অন্যের রেডি লেখা কপি করা, নিজের নামে চালিয়ে দেয়া এখন খুব সহজ কাজ হয়েছে। কিন্তু সেভাবে তো লেখক হওয়া যায় না। এটি সাক্ষাৎ চৌর্যবৃত্তি। এই বৃত্তির সঙ্গে অন্তঃত শিক্ষকতা পেশা মানায় না। এসব যে বা যারা করেন তিনি বা তারা নিজের শিক্ষার্থী এবং সন্তানের সামনে কোন মেরুদণ্ড নিয়ে দাঁড়াবেন?