পাহাড়সম অনিয়ম আর দুর্নীতিতে ডুবে আছে দেশের শিক্ষা খাত। দেশি-বিদেশি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও সংবাদমাধ্যম দুর্নীতির তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরলে নীতিনির্ধারকরা আমলে নিতে চান না বরং প্রশ্ন তোলেন এবং সমালোচনা করেন। এবার খোদ জাতীয় সংসদে বিরোধীদলের ও স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যরা শিক্ষা খাতে দুর্নীতির কঠোর সমালোচনা করেছেন। স্বতন্ত্র সদস্যরা ক্ষমতাসীন দলেরই লোক এবং বিরোধী দল বলতেও সরকারি সঠিক বিরোধী না। আমাদের মনে আছে, বছর তিনেক আগে টিআইবি দেশের শিক্ষা খাত নিয়ে একটি গবেষণা করে। এতে উঠে এসেছিলো দেশের মাধ্যমিক শিক্ষায় এমপিওভুক্তি, নিয়োগ, বদলি ও পাঠদানের ক্ষেত্রে দুর্নীতির চিত্র। অনুমতিসহ বিভিন্ন কাজে ৫ হাজার থেকে শুরু করে ১৫ লাখ টাকা পর্যন্ত নিয়মবহির্ভূত ঘুষ দিতে হয়। ঘুষ নিয়ে থাকেন সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা কমিটি ও স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা।
জাতীয় সংসদে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের মঞ্জুরি দাবির বিরুদ্ধে ছাঁটাই প্রস্তাবের আলোচনায় অংশগ্রহণ করে শিক্ষাখাতে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ তুলেছেন সংসদে বিরোধীদল জাতীয় পার্টি ও স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যরা। তারা বলেন, শিক্ষায় বরাদ্দ সবসময় জিডিপির লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় পিছিয়ে থাকে। শিক্ষাব্যবস্থায় বিভিন্ন দুর্নীতি ও বৈষম্য লেগেই আছে। শিক্ষার দুর্নীতি ভাষায় প্রকাশ করা যায়না। টাকা ছাড়া কিছুই হয় না। এমপিওভুক্তির জন্য টেবিলে টেবিলে টাকা দিতে হয়। জাতীয় পার্টির হাফিজ উদ্দিন আহম্মেদ আলোচনায় অংশ নিয়ে বলেন, শিক্ষাব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন হয়েছে। ভবন হয়েছে কিন্তু শিক্ষার মানে পরিবর্তন হয়নি। আমার নির্বাচনী এলাকায় একটি সরকারি বিদ্যালয়ে ৪৩টি শ্রেণিকক্ষ রয়েছে। পাঠদান হয়নি পাঁচটিতে। পাঁচটি রুম ব্যবহার হয়। না হয় আর পাঁচটিসহ ১০ হলো বা ২০টি হলো। কিন্তু রুম ৪৩টি। এই যে অপচয়। আমার পাকাবাড়ি, পাকা পায়খানা কিন্তু খাবার নেই। এটা হচ্ছে আজকের শিক্ষার অবস্থা। তিনি আরো বলেন, এমপিওভুক্ত হয় না। আবেদন গ্রহণও বন্ধ। এক বছর আগে যাদের এমপিওভুক্তির চিঠি দেয়া হয়েছে, তাদের পিয়ন-চাপরাশির দু’একজনের বেতন হয়েছে, অন্যদের বেতন হয় না। হয়তো টাকা নেই। এমপিওভুক্তির জন্য বিভিন্ন টেবিলে যেতে হয়। ধাপে ধাপে টেবিল মানে ধাপে ধাপে দুর্নীতি। একটি স্কুল প্রতিষ্ঠার ২০ থেকে ২৫ বছর পর বেতন হচ্ছে। গ্রামের স্কুল মাদরাসায় চার তলা ভবন করা হয়েছে। যারা এই পরিকল্পনা করেন, তারা বাংলাদেশে বাস করেন না। তারা গ্রাম দেখেননি।
কুড়িগ্রাম-২ আসনের হামিদুল হক খন্দকার বলেন, শিক্ষায় বরাদ্দ সবসময় জিডিপির লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় পিছিয়ে থাকে। শিক্ষাব্যবস্থায় বিভিন্ন দুর্নীতি ও বৈষম্য লেগেই আছে। এখানে প্রাতিষ্ঠানিক, শিক্ষাক্রম ও আঞ্চলিক বৈষম্য রয়েছে। মাঠপর্যায়ের শিক্ষা কর্মকর্তারা একই কর্মস্থলে পাঁচ-সাত বছর থেকে বিভিন্ন ধরনের অনিয়ম ও দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত থাকেন। বরিশাল-৪ আসনের সংসদ সদস্য পংকজ নাথ বলেন, এনটিআরসিএর মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগ প্রশংসনীয়। তবে কুড়িগ্রামের চিলমারীর কেউ যদি বরিশালের মেহেন্দীগঞ্জে নিয়োগ পান, তাহলে তিনি যোগদান করেন না। পার্বত্য এলাকায় তো আরো সমস্যা। এ কারণে শিক্ষক নিয়োগের পরেও শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে।
নাটোর-১ আসনের সংসদ সদস্য আবুল কালাম বলেন, রেলের খালাসি পদে ২ হাজার ১০০ জন ছেলে-মেয়ের চাকরি হয়েছে, যাদের সবাই মাস্টার্স পাস। এটা খুবই কষ্টের বিষয়। আমি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দ বাড়ানোর পক্ষে। কিন্তু আগামী অর্থবছরে কমপক্ষে পাঁচ লাখ অনার্স-মাস্টার্স পাস ছেলে-মেয়ের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে কোনো শিক্ষিত বেকার না থাকে। তিনি বলেন, সর্বক্ষেত্রেই দুর্নীতি। শিক্ষায় ব্যাপক দুর্নীতি। এটা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। টাকা ছাড়া কোনো শিক্ষক অবসর ভাতা পাচ্ছেন না। আমার শ্যালক শিক্ষক ছিলেন, মারা গেছেন। আমি নিজে তিন বছর তদবির করলেও অবসর ভাতা পাননি। টাকা ছাড়া কিছুই হয় না। এটা সর্বগ্রাসী দুর্নীতি। এই দুর্নীতির কারণে গোটা জাতি গ্রাস হয়ে যাচ্ছে। শিক্ষিত বেকার যুবকরা আত্মহত্যা করছেন। ঝিনাইদহ-২ আসনের সংসদ সদস্য নাসের শাহরিয়ার জাহেদী প্রশাসনিক ব্যয় কমিয়ে শিক্ষা গবেষণায় ব্যয় বাড়ানোর জন্য প্রস্তাব করেন। সংসদ সদস্যদের বক্তব্যের জবাবে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, দূরবর্তী জায়গায় অনেকে যোগদান করেন না, এটা ঠিক। তারপরও বিগত ছয় মাসে ৯৯ হাজার শিক্ষককে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। উচ্চ আদালতের আদেশের প্রেক্ষিতে এনটিআরসিএর মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগ করা হয়। এটি একটি সমস্যা, আমরা ইতিমধ্যে চিহ্নিত করেছি। এই যে একটা বাধা আছে, আমরা আইন সংশোধনের মাধ্যমে তা নিরসনের চেষ্টা করছি।’ সংসদ সদস্যদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের গভর্নিং বডির সভাপতি প্রসঙ্গে মন্ত্রী বলেন, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত যেসব কলেজ হয়েছে, সেখানে এমপিদের গভর্নিং বডির সভাপতি হওয়ার ক্ষেত্রে উচ্চ আদালত থেকে একটি রায় এসেছিলো। যার কারণে সংসদ সদস্যদের সভাপতি করা হচ্ছে না। আমরা ওই আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করার জন্য ইতোমধ্যেই ব্যবস্থা নিয়েছি। আমরা অ্যাটর্নি জেনারেলের সঙ্গে কথা বলেছি। আইনমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করে এটা আদালত থেকে নিষ্পত্তি করা হবে। আমরা এ বিষয়ে লিভ আবেদন করছি।’ শিক্ষামন্ত্রী আরো বলেন, ‘এবারের বাজেট শিক্ষায় বরাদ্দ ৯৭ হাজার কোটি টাকা। শিক্ষার তিনটি মন্ত্রণালয় ছাড়াও আরো ১৯টি মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে শিক্ষার জন্য ব্যয় হয় সেগুলোর অর্থ এই হিসাবে আসেনি। আমরা মনে করি শিক্ষার জন্য যেটা বরাদ্দ, সেটা যথাযথ।
বছরের শুরুতে শিক্ষার্থীদের হাতে প্রতি বছর বিনামূল্যে বই তুলে দেয় সরকার। এ বইয়ের ছাপাকাজেও অনিয়মের আশ্রয় নিয়ে থাকনে সংশ্লিষ্টরা। নিম্নমানের কাগজে বই ছাপিয়ে কোটি কোটি টাকা হাতানোর অভিযোগ রয়েছে ছাপাখানাগুলোর বিরুদ্ধে। আর এর সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ আছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড কর্মকর্তাদের। এখানে নাকি মন্ত্রণালয়ের চাপ থাকে। তারমানে অনেকেই এর সঙ্গে জড়িত। কে কাকে ধরবেন আর ব্যবস্থা নিবেন! আফ্রিকার দেশ সিয়েরা লিয়নের মতো গরিব দেশের বই বছরের পর বছরও যদি শিক্ষার্থীরা ব্যবহার করে তবু বইয়ের কিছু হবে না এতো চমৎকার কাগজ, টেকসই বাধাই। আর আমাদের বই নিম্নমানের নিউজপ্রিন্টে ছাপা, ধরার সঙ্গে সঙ্গে ছিঁড়ে যায়, বহু কষ্টে ও সাবধানে ব্যবহার করতে হয় বই। একবার ছিঁড়ে গেলে দ্বিতীয়বার পাওয়ার আর সুযোগ নেই। তাই, অনেক শিক্ষার্থী বই হারিয়ে বা ছিঁড়ে যাওয়ার পর বই ছাড়াই বিদ্যালয়ে আসেন। কারিগরি শিক্ষাবোর্ডের দিকে তাকালে দেখা যায়, ৫ হাজারের বেশি সার্টিফিকেট ও মার্কশিট বাণিজ্যের অভিযোগে উক্ত বোর্ডের সিস্টেম অ্যানলিস্ট এ টি এম শামসুজ্জামানকে গ্রেফতার করা হয়েছে। শুধু কারিগরি শিক্ষা বোর্ড নয়, সারা দেশের বিভিন্ন শিক্ষা বোর্ড ও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জাল সার্টিফিকেট নিয়ে চাকরি করছেন অনেকে। ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের প্রতিবেদনে দেখা যায় ৬৭৮ জন শিক্ষকের সনদ জাল।
দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবস্থা কেমন? এখানকার দুর্নীতি লাগামহীন। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যসহ কর্তা ব্যক্তিরা খেয়াল-খুশি মতো বিশ্ববিদ্যালয় চালাচ্ছেন। বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির তদন্ত চলছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অন্তত ৩৩টিতে নেই কোনো উপাচার্য। আর যিনি আর্থিক বিষয় দেখভাল করেন তিনি হচ্ছেন ট্রেজারার, এই পদ খালি আছে অন্তত ৩১টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে। শিক্ষক নিয়োগ বোর্ডের আগে টাকার বিনিময়ে প্রশ্ন ফাঁস, নিয়োগের আগে চেক ও সিন্ডিকেটের দিনে অর্থগ্রহণ, বিজ্ঞপ্তি ছাড়াই নিয়োগসহ নানা ধরনের দুর্নীতিতে ডুবে আছে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। তারপরেও আমরা দেখতে পাচ্ছি জেলায় জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করার তোড়জোড়। এতো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য কি? যেসব বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয় আছে সেগুলোতে যথেষ্ট পরিমাণ জমি ও ইনফ্রাস্টাকচার আছে, সেগুলোতে আরো বহু বিভাগ, ইনস্টিটিউট খোলা যায়, হল নির্মাণ করা যায়, তা বাদ দিয়ে ফসলি জমি নষ্ট করে কেনো জেলায় জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় করার পরিকল্পনা? বিষয়টি আমাদের বুঝে আসেনা। বিশ্ববিদ্যালয়ের যে ধারণা, তাতো এরকম ছোট ছোট স্কুল কলেজের মতো বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে অর্জন করা যায় না। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার ভিত মজবুত করার বিষয়ে আমরা উদাসীনতা প্রদর্শন করছি আর উচ্চ শিক্ষার পরিসর বাড়াতে ব্যস্ত! শিকড় মজুবত না হলে ওপরে পানি ঢাললে খুব একটা লাভ হওয়ার কথা নয়। একটি জাতির সামগ্রিক অগ্রগতির প্রশ্নে যথাযথ শিক্ষার বিস্তার ঘটানোর পাশাপশি শিক্ষার মান উন্নয়নের বিষয়টি অত্যন্ত জরুরি। শিক্ষাক্ষেত্রে বিস্তৃত বিশৃঙ্খলা ও দুর্নীতি দূর করা প্রয়োজন। কিন্তু আমরা এসব সমাধানের জন্য সঠিক পথে এগোচ্ছি কী?
লেখক: ক্যাডেট কলেজের সাবেক শিক্ষক