স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার জন্য যে স্মার্ট সিটিজেন প্রয়োজন তার জন্য চাই স্মার্ট শিক্ষক, স্মার্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, স্মার্ট শিক্ষা ব্যবস্থা। ডায়নামিক ওয়েবসাইট ও সফটওয়্যার স্মার্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অপরিহার্য উপসঙ্গ। এর সঙ্গেই জড়িত স্মার্ট শিক্ষক, স্মার্ট শিক্ষার্থী ও স্মার্ট শিক্ষা ব্যবস্থা। দুঃখজনক হলেও সত্য, আমরা ডিজিটাল সময় পার করে স্মার্ট যুগে পদার্পণ করতে যাচ্ছি। অথচ এখনো সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ডাইনামিক ওয়েবসাইট তৈরি ও আপডেট নিশ্চিত করতে পারিনি। এজন্য সেই ২০১৫ খ্রিষ্টাব্দের ২ মে থেকে শুরু করে একাধিকবার পরিপত্র ও তাগাদাপত্র দিয়েছে আমাদের শিক্ষা বিভাগ। বিভিন্ন কারণে সে অনুসারে সকল কার্য সম্পাদন করতে পারেনি বা করেনি সারা দেশের অনেক স্কুল, কলেজ এবং মাদরাসা। সে ব্যর্থতার বা অনিহার কারণ কতোটা খতিয়ে দেখা হয়েছে, কতটা সমাধানের চেষ্টা করা হয়েছে তা আমার জানা নেই।
মাঠ পর্যায়ের বাস্তবতা হচ্ছে, যখনই ডায়নামিক ওয়েবসাইট তৈরির আদেশ দেয়া হয়েছে তখনই অনেক ভূঁইফোড় ও নাম সর্বস্ব সফটওয়্যার/আইটি প্রতিষ্ঠান স্বল্প মূল্যে ওয়েবসাইট তৈরি ও পরিচালনা করবে বলে চটকদার বিজ্ঞাপন দিচ্ছে, মোবাইল ফোনে এসএমএস দিচ্ছে, লোকজন ধরাধরি করছে, প্রতিষ্ঠানে এসে ধরনা দিচ্ছে। কোনো কৌশলে চুক্তিবদ্ধ হয়ে যেনতেন কাজ করে বা না করে টাকা হাতিয়ে নেয়ার চেষ্টা করছে। অপরদিকে, নামিদামি সফটওয়্যার/আইটি প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের এককালীন ও মাসিক চার্জ অস্বাভাবিক বৃদ্ধি করছে। তাদের সফটওয়ারে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সকল ডাটা আপলোড করা হলে প্রতি বছর চার্জ বাড়ানোর কৌশল করছে। ফলে অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই নিজস্ব ডাইনামিক ওয়েবসাইট তৈরি করতে ও পরিচালনা করতে ব্যর্থ হচ্ছে। আমি নিজেও এমন ভোগান্তির শিকার! বিশেষ করে অসচ্ছল ও কম সচ্ছল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো প্রকৃত ডায়নামিক ওয়েবসাইট প্রস্তুত করার এককালীন ব্যয় এবং পরিচালনা করার মাসিক ব্যয় নির্বাহ করতে ব্যর্থ হচ্ছে। সারা দেশে এমন অনেক স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা আছে যেখানে শিক্ষার্থীরা মাসিক বেতনই ঠিকমত দেন না এবং শিক্ষকরা তাদের প্রতিষ্ঠান অংশ থেকে তেমন কিছুই পান না! তদুপুরি মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনা কমিটির সভাপতি ও সদস্য হবার ক্ষেত্রে যেহেতু শিক্ষাগত যোগ্যতার কোনো বাধ্যবাধকতা নেই, সেহেতু কমিটিতে এমন সদস্য থাকা অস্বাভাবিক নয় যারা ওয়েবসাইটের পেছনে অর্থ ব্যয় করার গুরুত্বই বুঝতে পারেন না।
তা ছাড়া ওয়েবসাইট নিয়মিত হালনাগাদ করা ও সমস্যা হলে সমাধান করার মতো দক্ষ জনবল অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানে নেই। আউটসোর্সিং করতে গেলে যে বাড়তি টাকার প্রয়োজন সেটিও অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নেই। দুঃখজনক হলেও সত্য, অধিকাংশ আইসিটি টিচার ও কম্পিউটার অপারেটর প্রাক্টিক্যাল/ডিজিটাল কাজে অত্যন্ত দুর্বল। যে কোর্স করে-পড়ে তারা সনদ পাচ্ছেন, নিয়োগ পাচ্ছেন সেখানে কোনো দুর্বলতা আছে কিনা তা খতিয়ে দেখা আবশ্যক।
সাধারণ শিক্ষকদের কথা আর কী বলবো! শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে কোনো শিক্ষক ও কর্মচারীকে প্রশিক্ষণ দিয়ে তৈরি করতে চাইলে এটিকে বাড়তি কাজ বলে তারা অনীহা দেখান। আইসিটি টিচার এটিকে পাঠদান বহির্ভূত কাজ বলে যুক্তি দেখান। অথচ প্রতিষ্ঠানের বৃহত্তর স্বার্থে সব শিক্ষককেই শিক্ষা কার্যক্রমের পাশাপাশি সহ-শিক্ষা কার্যক্রম ও অন্যান্য কার্যক্রম সম্পাদন করতে হয়, বিভিন্ন দায়িত্ব-কর্তব্য পালন করতে হয়। এক্ষেত্রে সরকারিভাবে আদেশ দিয়ে আইসিটি টিচার ও কম্পিউটার অপারেটরকে তাদের নির্ধারিত কাজের পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইট নিয়মিত হালনাগাদ করা ও সাধারণ সমস্যা সমাধান করার দায়িত্ব দেয়া উচিত।
অপরদিকে, অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রধানই জানেন না কোন প্রতিষ্ঠানের বা কর্তৃপক্ষের লাইসেন্স দেখে এবং সফটওয়্যার কোম্পানির (?) বৈধতা নিশ্চিত হতে হবে। লাইসেন্স দেখতে চাইলে কোনো কোনো সফটওয়্যার প্রতিষ্ঠানের লোকজন বলেন, লাইসেন্স লাগে না, লাইসেন্স কেউ চায় না। আবার কোনো কোনো সফটওয়্যার প্রতিষ্ঠানের লোকজন চেয়ারম্যান বা কাউন্সিলরের কাছ থেকে নেয়া একটা ট্রেড লাইসেন্সের কপি দেখান! বৈধভাবে ব্যবসা করার জন্য সফটওয়্যার/ আইটি প্রতিষ্ঠানকে কোনো অথরিটির লাইসেন্সধারী হতে হবে এই মর্মে কোনো সার্কুলার জারি করা হয়েছে কিনা আমার জানা নেই। অথচ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রতারণার হাত থেকে রক্ষার জন্য এ বিষয়টি সবার পরিষ্কার জানা থাকা উচিত। অবশ্য শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে বৈধ সফটওয়্যার/আইটি প্রতিষ্ঠানগুলোর কোনো তালিকা প্রদান করা হলে তারাও আবার সিন্ডিকেট তৈরি করে অতিরিক্ত চার্জ ধার্য করার কৌশল নিতে পারে। যদি তাই হয় তো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অক্ষমতা আরো বেড়ে যাবে।
আলোচিত বিভিন্ন বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে শুধু শহরের কতিপয় অতি সচ্ছল ও শিক্ষিত অভিভাবকদের সন্তান যে সব দামি প্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া করেন সে সব প্রতিষ্ঠানের দিকে তাকিয়ে সবকিছু চিন্তা করলে হবে না; প্রত্যন্ত গ্রাম এলাকায় অবস্থিত অসচ্ছল ও অশিক্ষিত বা স্বল্পশিক্ষিত পরিবারের সন্তানরা যে সব স্কুল, কলেজ, মাদরাসায় লেখাপড়া করেন সেগুলোর দিকেও তাকাতে হবে। শিক্ষা ক্ষেত্রে সমানতালে এগিয়ে নিতে হবে সবাইকে। এমতাবস্থায় শিক্ষা মন্ত্রণালয় বা এর অধীনস্থ কোনো প্রতিষ্ঠান যদি একটি ডায়নামিক ওয়েবসাইট প্রস্তুত করে প্রয়োজনীয় ম্যানু, সাব ম্যানু ও সফটওয়্যার যুক্ত করে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সেটির ব্যবহার বাধ্যতামূলক করে দেয় তাহলে এই সমস্যার সহজ সমাধান হবে বলে আমি মনে করি। সে ওয়েবসাইট ও সফটওয়্যার প্রস্তুত, কাস্টমাইজ এবং রক্ষণাবেক্ষণ করার জন্য প্রয়োজনে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে নামমাত্র বার্ষিক ফি নেয়া যেতে পারে। তাতেও প্রতিষ্ঠানগুলো বর্তমান বিড়ম্বনা, অতিরিক্ত ব্যয় ও আর্থিক ক্ষতির ঝুঁকি থেকে মুক্তি পাবে। তদুপরি দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনীয় তথ্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ও এর অধীন প্রতিষ্ঠানগুলোর চাহিদা মতো ফরমেট অনুসারে একটি প্লাটফর্মে পাওয়া যাবে। কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সেই ওয়েবসাইট ও সফটওয়্যার ব্যবহার না করার এবং নিয়মিত আপডেট না করার কোনো অজুহাত দেখাতে পারবে না। ডায়নামিক ওয়েবসাইটের পাশাপাশি প্রদত্ত এডুকেশন ম্যানেজমেন্ট ও অ্যাকাউন্টিং সফটওয়্যার ব্যবহার বাধ্যতামূলক করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সব দিকের ট্রান্সপারেন্সি প্রায় নিশ্চিত করা সম্ভব। তবে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যদি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্ধারিত ওয়েবসাইট ও সফটওয়্যারের ব্যবহার শতভাগ নিশ্চিত করে এর পাশাপাশি নিজস্ব অর্থায়নে অন্য কোনো ওয়েবসাইট/ সফটওয়্যার প্রস্তুত ও পরিচালনা করতে চায় তাহলে সে সুযোগ দিতে হবে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় যেহেতু বর্তমানে প্রায় সব শ্রেণির ভর্তি কার্যক্রম অনলাইনে চালাতে সক্ষম, সেহেতু সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ব্যবহার উপযোগী একটি ডায়নামিক ওয়েবসাইট ও প্রয়োজনীয় সফটওয়্যার প্রস্তুত এবং রক্ষণাবেক্ষণ করতে অবশ্যই সক্ষম হবে বলে আমি মনে করি। এ ক্ষেত্রে প্রয়োজনে তারা বুয়েট বা অন্য কোনো বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগিতা নিতে পারে।
ঢাকা শিক্ষা বোর্ড বেশ কয়েক বছর আগেই প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের ইআইআইএন নম্বর যুক্ত আইডি দিয়ে একটি কমন ওয়েবসাইট প্রস্তুত করে দিয়েছে, যা সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো সম্পূর্ণ বিনামূল্যে ব্যবহার করতে পারে। কিন্তু সেটিতে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তাদের তথ্য আপলোড করেনি। এমনকি অনেকে জানেনও না যে, তাদের প্রতিষ্ঠানের জন্য সম্পূর্ণ ফ্রি ব্যবহার উপযোগী একটি স্ট্যাটিক ওয়েবসাইট তৈরি করা আছে। যতোই সাধারণ হোক সেটিতে সবাইকে সক্রিয় করা হলে এতোদিনে প্রতিষ্ঠানের লোকজন এ বিষয়ে শিক্ষিত হয়ে উঠতো, তথ্য প্রদানে অভ্যস্ত হয়ে উঠতো। বাস্তবে সেটির ব্যবহার বাধ্যতামূলক না করায়, সেটিতে প্রতিষ্ঠানের তথ্যাদি আপলোড করার জন্য তেমন তাগাদা না দেয়ায়, সেটিকে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন করে কাঙ্ক্ষিত মানে উন্নীত না করায় এবং অপরদিকে অর্থ ব্যয় করে পৃথক ডায়নামিক ওয়েবসাইট তৈরি করার জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে বারবার আদেশ ও পুনরাদেশ দেয়ায় কোনোটিই সঠিকভাবে হয়নি বলে ধারণা করা যাচ্ছে।
শিক্ষার্থীদের ভর্তি, রেজিস্ট্রেশন, ট্রান্সফার, ফরম পূরণ, পরীক্ষা গ্রহণ, উত্তরপত্র মূল্যায়ন, ফলাফল প্রদান, সনদ প্রদান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের স্বীকৃতি প্রদান, স্বীকৃতি নবায়ন, স্বীকৃতি বাতিলকরণ, কমিটি গঠন, কমিটির অনুমোদন প্রদান, কমিটি বাতিলকরণ, শিক্ষক-কর্মচারীদের শাস্তি নিশ্চিতকরণ বা অব্যাহতি প্রদান ইত্যাদি বিভিন্ন কাজ যেহেতু শিক্ষা বোর্ডের নিয়ন্ত্রণে অর্থাৎ শিক্ষা বোর্ড যেহেতু শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সংক্রান্ত সর্বাধিক তথ্যের ব্যবহারকারী সেহেতু শিক্ষা বোর্ডকেই প্রয়োজনীয় ডায়নামিক ওয়েবসাইট ও সফটওয়্যার তৈরি এবং আপডেট ও রক্ষণাবেক্ষণ করার দায়িত্ব দেয়া যেতে পারে। এজন্য সামান্য ব্যয় তারা প্রতিষ্ঠানের স্বীকৃতি প্রদান ও নবায়ন ফি’র সঙ্গে নিয়ে নিতে পারে। মনে রাখতে হবে, দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অবস্থা ও অবস্থান যেহেতু একই রকম নয় সেহেতু মাঠ পর্যায়ের বাস্তবতা বিবেচনা করে কেন্দ্রীয়ভাবে সমন্বিত সকলের জন্য অনুকূল কোনো উদ্যোগ ব্যতীত সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ডায়নামিক ওয়েবসাইট ও সফটওয়্যারের ব্যবহার সমভাবে নিশ্চিত করে স্মার্ট শিক্ষাব্যবস্থা সচল রাখা প্রায় অসম্ভব।
অধ্যক্ষ, মো. রহমত উল্লাহ, কিশলয় বালিকা বিদ্যালয় ও কলেজ, ঢাকা