শিক্ষা সংস্কার ও নতুন শিক্ষাক্রম - দৈনিকশিক্ষা

শিক্ষা সংস্কার ও নতুন শিক্ষাক্রম

সানাউল্লাহ আনসারী |

অন্তবর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর রাষ্ট্র মেরামতের জন্য বিভিন্ন মতামত ও উদ্যোগের কথা আসছে। কিন্তু রাষ্ট্র মেরামত হবে কীভাবে? রাষ্ট্র ব্যবস্থা মেরামত করার আগে আমাদের সমাজকে মেরামত করতে হবে। সমাজ মেরামত হলে রাষ্ট্র মেরামতের কাজ সহজ হবে। শুধুমাত্র কিছু আইন কিংবা অধ্যাদেশ দিয়ে নতুন বাংলাদেশের মেরামত করে কাংখিত বাংলাদেশ পাওয়া যাবে না। সমাজ সংস্কার করতে হলে সমাজের মানুষগুলোকে সংস্কার করতে হবে। অর্থাৎ আমরা যে নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখছি তা গড়তে হলে যারা আগামী দিনের বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দেবে যাদের নেতৃত্বে বাংলাদেশ পরিচালিত হবে সেই তরুণ প্রজন্মের ভিত্তিটা আগে মজবুত করতে হবে। এজন্যই শিক্ষাব্যবস্থার আমুল পরিবর্তন জরুরি। প্রধান উপদেষ্টাসহ শিক্ষা উপদেষ্টা এই বিষয়ে ইঙ্গিতও দিয়েছেন। ইতোমধ্যে পূর্বের কারিকুলামে ফিরে যাবার সিদ্ধান্ত নিচ্ছে সরকার। কিন্তু পূর্বের কারিকুলামে ফিরে যাওয়ার জরুরি কি না তা শিক্ষা গবেষকরা গবেষণা করবেন। এ ব্যাপারে আমার কিছু নিজস্ব মতামত তুলে ধরছি-

১. নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে ২০১৭ খ্রিষ্টাব্দ থেকে  কাজ শুরু হয়ছিলো। ২০২১ খ্রিষ্টাব্দে বাস্তবায়ন শুরু হওয়ার কথা থাকলেও করোনার কারণে তা ২০২২ খ্র্রিষ্টাব্দে পাইলট প্রকল্পের মাধ্যমে শুরু হয়। ৬ষ্ঠ ও ৭ম  শ্রেণির কার্যক্রম শুরু হয় ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দে এবং এ বছর ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দে ৯ম শ্রেণি পর্যন্ত চালু হয়। সবকিছু ঠিক থাকলে আগামী বছর ১০ম শ্রেণিতে চালু হতো। কিন্তু গতবছর এবং এবছর নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে যথেষ্ট আপত্তি উঠে বিভিন্ন জায়গা থেকে বিশেষ করে অভিভাবকদের পক্ষ থেকে তোলা অভিযোগ আপত্তিগুলো লক্ষণীয়। নতুন কারিকুলামের আপত্তি ও অভিযোগগুলো আমলে নেয়া দরকার। 

২. উপদেষ্টা শিক্ষা কারিকুলাম পরিবর্তন ইঙ্গিত দিয়েছেন। তাই বর্তমান নতুন কারিকুলাম যে থাকছে না এটা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। ২০০৭-২০০৮ খ্রিষ্টাব্দের আগে সনাতনী পদ্ধতি ছিলো। এটা সংস্কার করে সৃজনশীল পদ্ধতি প্রবর্তন করা হলো। যদিও এটা নিয়ে সমালোচনা ছিলো। সৃজনশীল পদ্ধতি বুঝতে না বুঝতেই তা পরিবর্তন করে নতুন কারিকুলামের আগমন ঘটলো। নতুন কারিকুলামের উপযোগিতা বুঝাতে গিয়ে আগের সৃজনশীল পদ্ধতির দুর্বলতাগুলো হাইলাইট করা হয়েছে। একইভাবে সৃজনশীল পদ্ধতি চালু করার সময় সনাতনী পদ্ধতির দুর্বলতাগুলো হাইলাইট করা হয়েছিলো। অর্থাৎ সনাতনী বলি, সৃজনশীল বলি আর নতুন কারিকুলামের কথায় বলি সবগুলোতেই দুর্বল দিকগুলো তুলে ধরা হয়েছে পক্ষপাতিত্ব ভাবে। নতুন যে সংস্করণ হবে তাতেও একটা পক্ষের সমালোচনা থাকবে। তাই এ ব্যাপারে আমার পরামর্শ হলো সনাতন পদ্ধতি হোক সৃজনশীল পদ্ধতি  হোক আর নতুন শিক্ষাক্রম হোক কোনোটাই ত্রুটিমুক্ত নয়। আবার সবকিছুই যে খারাপ তাও নয়। সমালোচনার পাশাপাশি কিছু ভালো দিকও আছে। তাই একেবারে আগের কারিকুলামে ফিরে না গিয়ে এবং নতুন কারিকুলামের সবকিছুই ছুড়ে না ফেলে বর্তমান কারিকুলামে বিদ্যমান ইতিবাচক দিকগুলো রেখে প্রয়োজনীয় সংস্কার করা যেতে পারে। যেমন অভিভাবকদের সবচেয়ে বড় অভিযোগ হচ্ছে মুল্যায়ন পদ্ধতি নিয়ে। একজন শিক্ষকের জায়গা থেকে আমার নিজেরও মুল্যায়ন পদ্ধতি নিয়ে যথেষ্ট আপত্তি আছে। তাই মুল্যায়ন পদ্ধতির পরিবর্তন আবশ্যক। একই সঙ্গে এটাও বলা ভালো, ধারাবাহিক মুল্যায়ন পদ্ধতির দরকারও আছে। এতে শিক্ষার্থীদের ক্লাসে উপস্থিতি বেড়েছে। 

৩. নতুন টেক্সট বই নিয়ে অনেকের ভিন্ন ভিন্ন মতামত আছে। বিশেষ করে শরিফার গল্প নিয়ে খুব বেশি আলোচনা সমালোচনা হয়েছে। স্বাস্থ্য সুরক্ষা, শারীরিক শিক্ষা, জীবন জীবিকা, শিল্প সংস্কৃতি ইত্যাদি বিষয়গুলো নিয়ে যথেষ্ট আলোচোনা ছিলো। তাই যে সকল বিষয় নিয়ে সমালোচনা আছে তা বাদ দিয়ে কিংবা পরিবর্তন করে বিষয়ের পুনর্বিন্যাস করা যেতে পারে। শ্রেণিভিত্তিক কারিকুলাম বিন্যাসের ক্ষেত্রে এবং  টেক্সট বই প্রনয়নের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক স্টান্ডার্ড মান বজায় রাখা জরুরি। বলতে খারাপ লাগলেও সত্য যে আমাদের পাঠ্য বইয়ের লেভেল পাশের দেশ ভারত কিংবা পাকিস্তানের পাঠ্যবইয়ের লেভেলের তুলনায় অনেক নিচে। ও-লেভেল কিংবা এ-লেভেল তো কল্পনাই করা যায় না। তাই এ ব্যাপারে স্টান্ডার্ড থাকাটা খুবই জরুরি। 

৪. শুধু ১০ম শ্রেণির পাঠ্য বই থেকে এসএসসি পরীক্ষা এটা নিঃসন্দেহে নতুন কারিকুলামের ভালো দিক। যদিও এটা বাস্তবায়ন হয়নি। তারপরও এটা রাখলে ভালো হয়। ৫ ঘণ্টা পরীক্ষা একেবারে খামখেয়ালি। যেখানে  বিশ্ববিদ্যালয়ে ৪ ঘণ্টা পরীক্ষা হয় সেখানে মাধ্যমিক পর্যায়ে ৫ ঘণ্টা পরীক্ষা খুবই হাস্যকরে পরিণত হয়েছে। গত অর্ধবার্ষিক মুল্যায়নে এ রকম হাস্যকর অভিজ্ঞতা হয়েছে। তাই ৫ ঘণ্টার পরীক্ষা কোনোভাবে গ্রহণযোগ্য নয়।

৫. মাধ্যমিক পর্যায়ে বিভাগ বিভাজন না থাকাটাও আমি ভালো মনে করি। অনেক দেশেই এই পর্যায়ে বিভাজন নেই। ৯ম শ্রেণির একজন শিক্ষার্থী সাধারণ না বিজ্ঞান না বানিজ্য বিভাগ নেবে তা বুঝতে পারে না। অভিভাবকদের অভিপ্রায়ে তাকে বিভাগ পছন্দ করতে হয়। তবে কিছু বিষয় উন্মুক্ত রাখা যেতে পারে যেমন অতিরিক্ত কিংবা নৈর্বচনিক বিষয় হিসেবে অ্যাডভান্স লেবেলের  গনিত, বিজ্ঞান, আইসিটি ও কৃষি ইত্যাদি।

৬. নতুন কারিকুলাম বাস্তবায়নের জন্য যে শিক্ষক প্রশিক্ষণের আয়োজন করা হয়েছে তা প্রশংসনীয়। এটা অব্যাহত থাকতে হবে। শিক্ষাবছরে শুরুতে কিংবা শেষে শিক্ষকদের রিফ্রেশমেন্টের জন্য খুবই কার্যকর। সব শিক্ষককে বাধ্যতামুলকভাবে প্রশিক্ষণের আওতায় থাকতে হবে। সরকারিভাবে সবাইকে সম্ভব না হলে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে আয়োজন করা যেতে পারে। 

৭. আগের সৃজনশীল পদ্ধতি এবং সনাতন পদ্ধতির কিছু ভালো দিক আছে তা সমন্বয় করে শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কার করা দরকার। তারপরও সমালোচনা থাকবে। পক্ষে বিপক্ষে কথা আসবে। সংস্কারের ধারা উন্মুক্ত রেখে সবকিছু সময়ের সঙ্গে আপডেট করার ব্যবস্থা থাকতে হবে। 

টেকসই সমাজ বিনির্মানে শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কার সবচেয়ে বেশি জরুরি। তাই রাষ্ট্র ও সমাজ মেরামত কাজের প্রায়োরিটি ঠিক করে শিক্ষার সব স্তরে যুগোপযোগী সংস্কার দরকার।

লেখক: শিক্ষক, তা’মীরুল মিল্লাত কামিল মাদরাসা

 

সরকার পরিচালনায় ভুলত্রুটি থাকলে ধরিয়ে দিন, সম্পাদকদের ড. ইউনূস - dainik shiksha সরকার পরিচালনায় ভুলত্রুটি থাকলে ধরিয়ে দিন, সম্পাদকদের ড. ইউনূস এইচএসসি ফল তৈরি: পরীক্ষার্থীদের প্রয়োজনীয় তথ্য চেয়েছে বোর্ড - dainik shiksha এইচএসসি ফল তৈরি: পরীক্ষার্থীদের প্রয়োজনীয় তথ্য চেয়েছে বোর্ড শিক্ষকদের পদত্যাগে বাধ্য ও হেনস্তা নয়: শিক্ষা উপদেষ্টা - dainik shiksha শিক্ষকদের পদত্যাগে বাধ্য ও হেনস্তা নয়: শিক্ষা উপদেষ্টা স্কুল-কলেজ শিক্ষকদের আগস্ট মাসের এমপিওর চেক ছাড় - dainik shiksha স্কুল-কলেজ শিক্ষকদের আগস্ট মাসের এমপিওর চেক ছাড় এনটিআরসিএর চেয়ারম্যান পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের ডিজি হলেন - dainik shiksha এনটিআরসিএর চেয়ারম্যান পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের ডিজি হলেন ছাত্রী হয়রানির অভিযোগ, উত্তরা ইউনিভার্সিটি উত্তপ্ত - dainik shiksha ছাত্রী হয়রানির অভিযোগ, উত্তরা ইউনিভার্সিটি উত্তপ্ত ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের হাত ভাঙলেন বরখাস্ত প্রধান শিক্ষক - dainik shiksha ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের হাত ভাঙলেন বরখাস্ত প্রধান শিক্ষক সাংবাদিক নিপীড়নের আইনগুলো এখনই বাদ দেয়ার প্রস্তাব - dainik shiksha সাংবাদিক নিপীড়নের আইনগুলো এখনই বাদ দেয়ার প্রস্তাব মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তার চলতি দায়িত্ব দিতে আবেদন আহ্বান - dainik shiksha মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তার চলতি দায়িত্ব দিতে আবেদন আহ্বান শিরীন শারমিনের পদত্যাগে স্পিকার পদে কি শূন্যতা তৈরি হলো - dainik shiksha শিরীন শারমিনের পদত্যাগে স্পিকার পদে কি শূন্যতা তৈরি হলো দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0067939758300781