ডেঙ্গুরোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতাল থেকে শনিবার বাসায় ফিরেছেন বাসাবোর বাসিন্দা ইশরাত জাহান (২৯)। তার দুই ছেলে মতিঝিল আইডিয়াল স্কুলের শিক্ষার্থী। স্কুলে গিয়ে ছেলেরা কতটা নিরাপদ থাকবেন তা নিয়ে উদ্বিগ্ন ইশরাত বলেন, পত্র-পত্রিকায়, খবরেতো দেখছি, এ বছর নাকি ডেঙ্গুর ব্যাপকতা আগের চেয়ে আরো বাড়বে। আমি সুস্থ হয়ে বাসায় এসেছি ঠিকই; কিন্তু কতক্ষণ সুস্থ থাকতে পারব জানি না। রবিবার থেকে বাচ্চাদের স্কুলও খুলেছে। বাচ্চারা স্কুলে যাবে। খেলাধুলা করবে। সেখানে তারা কতটা নিরাপদ থাকবে তা নিয়ে দুঃশ্চিন্তায় আছি। বাসায় আমরা যতই সচেতন থাকি স্কুলে বা গাড়িতে কি বাচ্চারা নিরাপদ? আমরা নিরাপদ?
ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের উদ্যোগ নিয়ে ইশরাতের মতো অনেক অভিভাবকই উদ্বিগ্ন। এর যথেষ্ট কারণও রয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। সরকারি তথ্য অনুযায়ী, এ বছর ডেঙ্গু আক্রান্তদের মধ্যে অধিকাংশই শিশু-কিশোর। স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে বলা হচ্ছে, সবাই ডেঙ্গুর ঝুঁকিতে রয়েছে। আর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জরিপ অনুযায়ী ঢাকার দুই সিটির ৫৫টি ওয়ার্ড ডেঙ্গুর উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে। এসব ওয়ার্ডসহ দুই সিটিতে রয়েছে সহ¯্রাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। দীর্ঘদিন বন্ধ থাকা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং থেমে থেমে বৃষ্টি এডিসের বংশ বাড়াতে সহায়ক বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এডিস মশার বংশবিস্তারের জন্য উর্বর স্থান। কারণ বেশির ভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের টয়লেট-বাথরুম নিয়মিত পরিষ্কার করা হয় না। প্রতিষ্ঠানগুলোর ভবনের আঙ্গিনা ও আশপাশে পানি জমে থাকে। শ্রেণিকক্ষে মশা মারার ওষুধ স্প্রে করা হয় না। আর কক্ষগুলো কিছুটা অন্ধকারাচ্ছন্ন। যেখানে মশা লুকিয়ে থাকতে পারে। গতকাল সোমবার রাজধানীর একাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গিয়ে এর সত্যতাও পাওয়া যায়। সেগুনবাগিচা হাইস্কুলে গিয়ে দেখা যায়, মাঠে বড় জায়গাজুড়ে আগের দিনের বৃষ্টি পানি জমে আছে। ঘাস পরিষ্কার করা হয়নি অনেকদিন। পড়ে আছে পলিথিনের ব্যাগ, খালি পানির বোতল প্রভৃতি। এসবের মধ্যেই শিক্ষার্থীরা মাঠে খেলাধুলা করছে। স্কুল কর্র্তৃপক্ষের এদিকে কোনো নজরই নেই। এখানে একই ক্যাম্পাসের ভেতর আরো দুটি স্কুল রয়েছে।
প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ইমিরেটাস অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ বলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কর্মস্থল থেকেই মানুষ বেশি আক্রান্ত হচ্ছে। এডিস মশা যে সময়টায় কামড় দেয়, সেই সময় অনেকেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কর্মস্থলে অবস্থান করেন। সুতরাং সেসব স্থান পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার ওপর বেশি গুরুত্ব দিতে হবে।
এ বিষয়ে কর্তৃপক্ষ বলছে, বিষয়গুলো নিয়ে তারা সচেতন। ছুটি শেষ হওয়ার আগেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রয়োজনীয় ৫ দফা নির্দেশনা পাঠিয়েছে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি)। নির্দেশনার মধ্যে আছে- খেলার মাঠ ও ভবনগুলো নিয়মিত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা; মাঠ বা ভবনে জমে থাকা পানি দ্রুত সরিয়ে ফেলা; প্রতিষ্ঠানগুলোর সৌন্দর্যবর্ধনের জন্য যেসব ফুলের টব রাখা হয়েছে, সেগুলো নিয়মিত পরিষ্কার রাখা; এডিস মশার প্রজনন স্থলে যাতে পানি জমতে না পারে, তা নিশ্চিত করা এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ও শিক্ষকরা ডেঙ্গু প্রতিরোধের উপায় নিয়ে প্রতিদিন শিক্ষার্থীদের জানাবেন।
এ প্রসঙ্গে মাউশি মহাপরিচালক অধ্যাপক নেহাল আহমেদ বলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও কর্মকর্তা-কর্মচারীরা যাতে ডেঙ্গুর কবলে না পড়ে, সেজন্য ঈদের ছুটির আগেই সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নিয়মিত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখাসহ ৫ দফা নির্দেশনা পাঠানো হয়েছে। বিষয়টি মনিটরিং করা হচ্ছে। আমাদের প্রতিনিধিরা বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে হঠাৎ করেই পরিদর্শনে যাচ্ছেন। ডেঙ্গু বিষয়ে শিক্ষার্থীদের সচেতন করতে প্রতিদিন ক্লাস শুরুর ৫ থেকে ১০ মিনিট এ বিষয়ে আলোচনা করা হয়। আমরা শিক্ষার্থীদের ‘ওয়ার্ক ফোর্স’ হিসেবে গড়ে তুলছি। শিক্ষার্থীদের বলা হচ্ছে, তাদের বাসার চারপাশ পর্যবেক্ষণ করে পরের দিন ক্লাসে এসে তা জানাতে। নিজের চারপাশ পরিষ্কার রাখতে। আমাদের যা যা করণীয় তা আমরা করছি। তবে কেউ কি নিশ্চয়তা দিতে পারে?
রোগতত্ত্ব রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সাবেক বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার আগেই অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানের শ্রেণিকক্ষ ও প্রাঙ্গণ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করার নির্দেশনা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ দিয়েছে। সেই নির্দেশনাগুলো কতটা বাস্তবায়ন হচ্ছে তা মনিটরিং করা প্রয়োজন।
কীটতত্ত্ববিদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ডা. কবিরুল বাশার জানান, এতদিন আমরা জানতাম এডিস মশা শুধু দিনের বেলায়, বিশেষ করে সকালে এবং বিকালে কামড়ায়। কিন্তু আমাদের গবেষণায় সেটি ভুল প্রমাণিত হয়েছে। আমাদের ল্যাবরেটরি এবং মাঠ পর্যায়ের গবেষণায় দেখেছি, এডিস মশা রাতেও কামড়ায়। শহরে উজ্জ্বল আলোর ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় এডিস মশার আচরণে পরিবর্তন হয়েছে। অতিরিক্ত আলোর কারণে একে তো মশা দিন-রাতের পার্থক্য বুঝতে পারছে না, তার ওপর এখন তারা রাতের পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গেও খাপ খাইয়ে নিয়েছে। সুতরাং আমাদের সব সময়ই সচেতন থাকতে হবে।