ছাত্রলীগ আর বিতর্ক একাকার। কেউ কাউকে ছাড়ছে না। সম্প্রতি বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের হামলা, নির্যাতন ও মারধরের ঘটনা দেশজুড়ে আলোচিত-সমালোচিত হয়েছে। গত এক মাসেই এমন অন্তত ১০টি ঘটনা ঘটেছে।
বিশেষ করে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, ইডেন মহিলা কলেজ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী নির্যাতনের ঘটনায় ছাত্রলীগের কর্মকান্ড নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বারবার শাস্তি দিয়েও লাগাম টানা যাচ্ছে না সংগঠনটির বেপরোয়া নেতাকর্মীদের।
কেন এসব ঘটনা ঘটছে সে সম্পর্কে খোঁজ নিতে গিয়ে উঠে এসেছে বিভিন্ন কারণ। এর মধ্যে অন্যতম হলো আধিপত্য ও নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করার অপচেষ্টা। দ্বিতীয় কারণ হলো সাংগঠনিক জেলা কমিটি নতুন নেতৃত্ব যেন বিলুপ্ত না করে। বিলুপ্ত করলে অচল হয়ে যাবে ওই এলাকা। তাছাড়া সামনে নির্বাচন, ক্ষমতা বা আধিপত্য রয়েছে এমনটা জানান দিতে ব্যর্থ হলে কদর পাবেন না দায়িত্বশীল নেতারা। এ ছাড়াও গত কমিটির কমিটি-বাণিজ্য অন্যতম। রয়েছে অনুপ্রবেশকারীদের এক ধরনের ইন্ধনও।
সাংগঠনিক ইউনিটগুলোতে নিয়মিত সম্মেলন না করার কারণেও এক ধরনের বিরূপ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। দীর্ঘদিন একই নেতৃত্ব থাকায় বেপরোয়া হয়ে ওঠে একটি পক্ষ। অন্যদিকে নিয়মিত সম্মেলন হয় না বলে নেতৃত্ব না পাওয়ায় হতাশ হয়ে বিদ্যমান কমিটিকে ব্যর্থ প্রমাণ করতে অপকর্ম জড়ায় বিপক্ষ।
ছাত্রলীগের গত কমিটির গুরুত্বপূর্ণ এক নেতা বলেন, ‘ঢাকায় কয়েকটি ইউনিটে সম্মেলন হয় না দীর্ঘদিন। ঢাকায়ও শুরু হবে নানা অপকর্ম।’ তিনি জানান, ঢাকা কলেজে কমিটি নেই প্রায় এক দশক। সেখানেও নেতৃত্বে আসতে না পারা পক্ষটি যেকোনো সময়ে ফুঁসে উঠতে পারে। অন্য কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও একই কারণে নেতিবাচক ঘটনা ঘটার সুযোগ আছে।
ছাত্রলীগের কেন্দ্র থেকে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণ ও সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে শাস্তির ব্যবস্থা করে অপকর্ম বন্ধ করার উদ্যোগ গ্রহণ নিলেও দমানো যাচ্ছে না অপকর্ম। বরং নতুন করে অন্য কোনো সাংগঠনিক ইউনিট বিতর্কের জন্ম দিচ্ছে।
জানতে চাইলে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভাপতি সাদ্দাম হোসাইন বলেন, ‘তারুণ্যের অবক্ষয়, সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড না থাকা ও র্যাগিংয়ের কালচার গড়ে ওঠা এসবই কারণ। তাছাড়া ছাত্র সংসদ নির্বাচন না হওয়া ও এসব ঘটনার কারণ বলা যায়।’ তিনি বলেন, ‘ছাত্রলীগ শুদ্ধি অভিযান শুরু করেছে। শিগগিরই অপকর্ম থেমে যাবে। র্যাগিংবিরোধী ক্যাম্পেইন শুরু করব আগামী সপ্তাহ থেকে।’
ছাত্রলীগের ২৯তম সম্মেলনে সভাপতি রেজোয়ানুল হক শোভন ও সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানী নির্বাচিত হন। চাঁদাবাজিসহ নানা বিতর্কে জড়ালে নির্দিষ্ট মেয়াদের আগেই তাদের অব্যাহতি দিয়ে আল নাহিয়ান খান জয়কে সভাপতি ও লেখক ভট্টাচার্যকে সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেওয়া হয়। তারাও বিতর্কমুক্ত থাকতে পারেননি। তাদের সময়ে চাঁদাবাজি, কমিটি-বাণিজ্য ও অনুপ্রবেশকারীর প্রবেশদ্বার হওয়ার অভিযোগ ওঠে ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে। প্রায় প্রতিদিনই খবরের শিরোনাম হতে থাকে ঐতিহ্যবাহী ছাত্রসংগঠনটি। সরকারের উন্নয়ন কর্মকান্ড ইতিবাচক প্রচার ম্লান হয়ে যায় ছাত্রলীগের অপকর্মে। একপর্যায়ে আওয়ামী লীগের টনক নড়ে। এ অবস্থায় উপায়ান্তর না দেখে দ্রুত জয়-লেখককে বিদায় করতে তৎপর হয়ে ওঠে আওয়ামী লীগের হাইকমান্ড। গত ৬ ডিসেম্বর ৩০তম সম্মেলন করে নতুন নেতৃত্বকে সংগঠনের দায়িত্ব দেওয়া হয়। সভাপতি করা হয় সাদ্দাম হোসাইনকে। আর সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেওয়া হয় শেখ ওয়ালি আসিফ ইনানকে।
সমালোচনামুক্ত ও নির্ভার থাকতে সম্মেলন করে নতুন নেতৃত্বের হাতে দায়িত্ব তুলে দিলেও তাতে কাজ হয়নি। নির্ভারও থাকতে পারেনি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ।
চলতি ফেব্রুয়ারি মাসেই ঢাকা ও ঢাকার বাইরের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী নির্যাতন, চাঁদাবাজি ও ছিনতাইয়ের অভিযোগের মতো খবরের শিরোনাম হয়েছে ছাত্রলীগ। সংবাদমাধ্যমের প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়েছে নতুন নেতৃত্বকে। কেন্দ্রীয় সভাপতি সাদ্দাম হোসাইন ও সাধারণ সম্পাদক ইনান সাধ্যমতো চেষ্টা করলেও সামাল দিতে পারছেন না। ছাত্রলীগের কর্মকান্ডে আওয়ামী লীগের শীর্ষপর্যায়ের নেতারা বিরক্ত।
১১ ফেব্রুয়ারি ইসলামী বিশ^বিদ্যালয়ে ছাত্রীকে নির্যাতনের পর বিবস্ত্র করে ভিডিও ধারণ তা ভাইরাল করে দেওয়ার হুমকির অভিযোগ ওঠে। এ ঘটনায় দুই ছাত্রলীগ নেত্রীকে অভিযুক্ত করে বিশ্ববিদ্যালয়ে দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
২২ ফেব্রুয়ারি দলীয় কর্মসূচিতে না যাওয়ায় রাজশাহী কলেজের মুসলিম ছাত্রাবাসে ৩০ ছাত্রকে পিটুনি দেয় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। বাদ যাননি দুজন শিক্ষানবিশ সংবাদকর্মীও। ছাত্রলীগের কর্মসূচিতে যোগ না দেওয়ায় সন্ধ্যার পর থেকে ছাত্রাবাসের কক্ষে কক্ষে গিয়ে মারধর করা হয় বলে অভিযোগ করেছেন শিক্ষার্থীরা। খবর পেয়ে ছাত্রদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য রাতে ছাত্রাবাসে উপস্থিত হন কলেজের অধ্যক্ষ ও আরেকজন সহযোগী অধ্যাপক। ছাত্রলীগের কর্মীরা তাদের সামনেই শিক্ষার্থীদের ‘দেখে নেওয়ার’ হুমকি দেন।
২০ ফেব্রুয়ারি রাতে সিলেটে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয়ে র্যাগিংয়ের নামে যৌন নিপীড়নের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায়ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে।
২১ ফেব্রুয়ারি ইডেন কলেজে স্টাম্প দিয়ে পিটিয়ে শিক্ষার্থীর হাতের আঙুল ভাঙেন এক ছাত্রলীগ নেত্রী। ৭-৮ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের ছাত্রাবাসে চার ছাত্রকে আটকে রেখে নির্যাতন করেন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা।
এ ছাড়া রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে (রাবি) কৃষ্ণ রায় নামে এক ছাত্রকে হলকক্ষে আটকে রেখে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করার অভিযোগ উঠেছে হল শাখা ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে। নির্যাতনের পাশাপাশি অভিযুক্তরা শিবির অ্যাখ্যা দিয়ে মেরে ফেলার হুমকিও দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন ভুক্তভোগী সেই শিক্ষার্থী। গত রবিবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী হলে এ ঘটনা ঘটে। কৃষ্ণ রায়কে নির্যাতনে অভিযুক্তদের শোকজ করেছে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ। শনিবার রাতে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি গোলাম কিবরিয়া ও সাধারণ সম্পাদক ফয়সাল আহমেদ রুনু স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।
মূল ক্যাম্পাসে ফেরার দাবিতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার অভিযোগ উঠেছে ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে। তবে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের নেতারা দাবি করেছেন, চারুকলার শিক্ষার্থীদের নিজেদের মতবিরোধের ফলে হামলার ঘটনা ঘটেছে, এর সঙ্গে তাদের সংগঠনের সংশ্লিষ্টতা নেই।
রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এক দম্পতিকে মারধর ও হেনস্তা করে স্বর্ণালংকার ছিনতাইয়ের মামলায় ছাত্রলীগের দুই নেতাকে সাময়িক বহিষ্কার করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। তাদের কেন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্থায়ী বহিষ্কার করা হবে না জবাব চেয়ে তাদের শিগগিরই চিঠি দেওয়া হবে। চিঠি পাওয়ার পরবর্তী সাত কার্যদিবসের মধ্যে ওই দুই নেতাকে এর জবাব দিতে হবে।
গত সোমবার সন্ধ্যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ দপ্তর থেকে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে ছাত্রলীগের দুই নেতাকে বহিষ্কারের কথা জানানো হয়। ওই দুই নেতা হলেন কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সদ্য সাবেক সদস্য রাহুল রায় ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কবি জসীমউদ্দীন হল শাখা ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক তানজির আরাফাত ওরফে তুষার। রাহুল আইন বিভাগের ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষ আর তানজির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী।
গত ১৫ জানুয়ারি রাতে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এক দম্পতিকে মারধর ও হেনস্তা করে স্বর্ণালংকার ছিনতাইয়ের অভিযোগে করা মামলায় দুদিন পর গ্রেপ্তার হয়েছিলেন ছাত্রলীগের নেতা তানজির আরাফাত। তবে এক দিনের মধ্যেই ছাড়া পেয়ে আবার ছাত্রলীগের রাজনীতিতে সক্রিয় হয়েছেন। একই মামলার আরেক আসামি ছিলেন ছাত্রলীগের নেতা রাহুল রায়।
তানজির ও রাহুলের বিরুদ্ধেই ছাত্রলীগ এখনো কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। রাহুল ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি সাদ্দাম হোসাইন আর তানজির বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক তানভীর হাসানের অনুসারী। তাদের মধ্যে রাহুলকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ও আশপাশের এলাকার ‘ছিনতাইকারী গ্যাংয়ের প্রধান’ বলে আখ্যায়িত করেছেন খোদ তানভীর হাসান।
কাভার্ড ভ্যান আটকে টাকা ছিনতাই ও চালককে মারধরের অভিযোগে করা মামলায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) বিজয় একাত্তর হল শাখা ছাত্রলীগের দুই কর্মীসহ তিন ছাত্রকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, শনিবার রাত ৩টার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসসংলগ্ন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) মসজিদের সামনে ছিনতাইয়ের ওই ঘটনা ঘটে। টহলরত পুলিশ ওই তিন ছাত্রকে হাতেনাতে আটক করে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের ভাসমান দোকানি ও সাধারণ শিক্ষার্থীদের ভাষ্যমতে, গ্রেপ্তার নাভিদ ওরফে অননের নেতৃত্বে কয়েক মাস ধরে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার এলাকায় একটি ছিনতাইকারী চক্র সক্রিয় রয়েছে।
গত ২১ ফেব্রুয়ারি বন্দরনগরী চট্টগ্রামে শহীদ মিনারে ফুল দেওয়াকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগের হামলায় ছাত্র ইউনিয়নের অন্তত পাঁচ নেতাকর্মী আহত হয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়টিতে ছাত্রলীগের কয়েকটি গ্রুপ ও উপগ্রুপ রয়েছে। তাদের মধ্যে সংঘর্ষ ঘটছে প্রায়ই। সিলেটে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুুক্তি বিশ^বিদ্যালয়ের সংগঠনের দুটি পক্ষের মধ্যে মারামারির ঘটনা ঘটেছে সম্প্রতি।
ছাত্রলীগ দেখভালের দায়িত্ব থাকা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, ‘এসব অঘটনের সুনির্দিষ্ট কোনো কারণের কথা বলা যাবে না। যেখানেই যে ঘটনা ঘটবে গঠনতন্ত্র অনুযায়ী ছাত্রলীগের শীর্ষ নেতৃত্ব ব্যবস্থা নেবেন এবং নিচ্ছেন। শিগগিরই এসব অনাকাক্সিক্ষত ঘটনার অবসান ঘটবে।’