শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভাষা শিক্ষার গুরুত্ব - দৈনিকশিক্ষা

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভাষা শিক্ষার গুরুত্ব

আবুল কালাম আজাদ, দৈনিক শিক্ষাডটকম |

বাংলাদেশ আমাদের প্রিয় জন্মভূমি। এদেশে বহু জাতি, বহু ভাষা ও বহু সংস্কৃতির মানুষ মিলেমিশে হাজার হাজার বছর ধরে সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে বসবাস করে আসছে। এ ভূখণ্ডে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীর সিংহভাগ বাঙালি। তবে বাঙালি ছাড়াও এখানে রয়েছে প্রায় অর্ধশত ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষ। আমরা তাদের আদিবাসী বলি। শত শত বছর ধরে একই ভূখণ্ডে সবাই একত্রে বসবাস করলেও ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর রয়েছে নিজস্ব ভাষা-সাহিত্য ও সংস্কৃতি। যা তারা হৃদয়ে লালন করে। অপরদিকে, সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি জনগোষ্ঠীর মধ্যেও রয়েছে জীবন-জীবিকা, ধর্ম-বর্ণের নানা ভিন্নতা। স্থান ও কালিক ব্যবধান, হাবভাব, উচ্চারণের তারতম্যের কারণে একই দেশে একই ভাষার নানা রূপভেদ লক্ষ্য করা যায়। বাংলাদেশের মানুষের রাষ্ট্রভাষা বাংলা।

ভাবের বাহন ভাষা। মনের নানা অনুভূতি ও চিন্তাগুলোকে অন্যের কাছে প্রকাশের তাগিদেই ভাষার উদ্ভব। ভাষা পারস্পারিক মতবিনিময়ের অন্যতম মাধ্যম। মাতৃভূমির মতো মাতৃভাষাও মানুষের কাছে খুবই প্রিয়। বাংলা আমাদের মাতৃভাষা। একই রাষ্ট্রে যেমন শত শত ভাষা থাকতে পারে, তেমনি একাধিক রাষ্ট্রভাষাও থাকতে পারে। আমরা ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দের ২১ ফেব্রুয়ারি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ভাষা আন্দোলন করেছিলাম। রফিক, শফিক, সালাম, জব্বার, বরকত আমাদের ভাষাশহীদ। তারা বুকের তাজা রক্ত রাজপথে ঢেলে দিয়ে আমাদের বাংলা ভাষায় কথা বলার অধিকার দিয়েছেন। আমরা তাদের সম্মান করবো। 

বাংলা ভাষা একটি প্রাচীনতম ও ঐশ্বর্য মণ্ডিত ভাষা। বহু বাধা-বিঘ্ন পেরিয়ে ক্রমশ এই ভাষা বিকশিত হয়েছে। একটি দেশ ও জাতির উন্নতিতে সামগ্রিক উন্নয়নের স্বার্থে মাতৃভাষার গুরুত্ব অপরিসীম। কোনো জাতির সামাজিক, অর্থনৈতিক বা ঐতিহাসিক পটভূমি তার নিজ মাতৃভাষার মাধ্যমেই প্রতিফলিত হয়। কোনো জাতির সাংস্কৃতিক ধারণাকেও আমরাও তার মাতৃভাষার মাধ্যমে অনুধাবন করতে পারি। একটি শিশুও তার মাতৃভাষাতেই প্রথম কথা বলতে শেখে। আবার, মনের ভাব সহজেই প্রকাশ করা যায় মাতৃভাষায় কথা বলে। আমাদের নতুন প্রজন্মেরও নিজ মাতৃভাষা সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান থাকা আবশ্যিক। মাতৃভাষা সম্পর্কে জ্ঞান থাকলেই নিজ ঐতিহ্য, সংস্কৃতি সম্পর্কে সঠিক মূল্যায়ন করা সম্ভব হয়ে ওঠে।

মাতৃভাষা শিশুদের জন্য অন্যান্য ভাষা বাছাই এবং শিখতে সহজ করে। আমাদের শিশুরা আগে বাংলা শেখে বলেই তারা অন্যান্য আরো কয়েকটি ভাষায় দক্ষতা অর্জন করতে পারে। মাতৃভাষা একটি শিশুর ব্যক্তিগত, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক পরিচয় বিকাশ করে। মাতৃভাষা ব্যবহার শিশুকে তাদের সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনা এবং শিক্ষার দক্ষতা বিকাশে সহায়তা করে। গবেষণায় দেখা গেছে-মাতৃভাষায় শেখা শিশুরা পাঠ্যক্রম আরো ভালো বোঝার উপায় হিসেবে গ্রহণ করে। শিশু যখন দ্বিতীয় ভাষায় স্থানান্তরিত হয় তখন মাতৃভাষায় শেখানো দক্ষতাগুলো পুনরায় শেখানোর প্রয়োজন পড়ে না।
মানুষের মুখে কেমন করে ভাষা এলো তা এক অপার রহস্য। ভাষা একদিনে; এক বছরে; অথবা  এক যুগে তৈরি হয়নি। শত শত বছর ধরে মানুষের ক্রমাগত চেষ্টা ও সাধনায় এক একটি ভাষার জন্ম। সমগ্র বিশ্বে আটশো কোটি মানুষের মধ্যে ভাষার সংখ্যা প্রায় সাড়ে তিন হাজারের ওপরে। যেমন: ইংরেজি, হিন্দি, উর্দু, জাপানি, ফরাসি, আরবি, ফারসি ইত্যাদি কয়েকটি জনপ্রিয় ভাষা। তবে কোনো ভাষাই স্থির নয়। ভাষার ধর্ম কেবলি বদলায়। ক্রমিক বদলের ধারাবাহিকতায় ‘ইন্দো-ইউরোপীয়’ মূল ভাষাগোষ্ঠী থেকে বদলাতে বদলাতে এক সময় প্রান্তিক পর্যায়ে বাংলা ভাষার জন্ম হয়েছে। ‘হাজার বছর আগে প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষা রূপান্তরিত হয়ে বঙ্গীয় অঞ্চলে জন্ম নিয়েছিলো এক মধুর-কোমল-বিদ্রোহী প্রাকৃত। তার নাম বাংলা। ওই ভাষাকে কখনো বলা হয়েছে ‘প্রাকৃত’, কখনো বলা হয়েছে ‘গৌড়ীয় ভাষা’ কখনো বলা হয়েছে ‘বাঙ্গলা’ বা ‘বাঙ্গালা’। এখন বলি বাংলা।’ বাঙালির মুখে যেদিন বাংলা ভাষার জন্ম হয়েছিলো, সেদিন কেউ তা লিখে রাখেননি। কারণ, ভাষার ইতিহাস আর লিপির ইতিহাস একই নদীর দু’টি ভিন্ন ধারা। মানুষের হৃদয় থেকে মানুষের মুখে এসে ধ্বনিত আদি বাংলা ভাষা মিশে গেছে এই ভূ-ভাগের আকাশে-বাতাসে। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রাচীন নিদর্শন চর্যাপদ। 

ভাষা মানুষের সংযোগের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। যদিও সমস্ত প্রজাতির যোগাযোগের তাদের উপায় রয়েছে, তবে মানুষই একমাত্র যারা জ্ঞানীয় ভাষা যোগাযোগে দক্ষতা অর্জন করেছে। ভাষা অন্যদের সঙ্গে আমাদের ধারণা, চিন্তাভাবনা এবং অনুভূতি শেয়ার করতে দেয়। এটি সমাজ গঠনের ক্ষমতা রাখে, ভাষা আমাদের অনুভূতি এবং চিন্তাভাবনা প্রকাশ করতে সাহায্য করে। এটি আমাদের প্রজাতির জন্য অনন্য। কারণ, এটি বিভিন্ন সংস্কৃতি এবং সমাজের মধ্যে অনন্য ধারণা এবং রীতিনীতি প্রকাশ করার একটি উপায়।

একুশের চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে বুকের রক্ত দিয়ে বাঙালি রক্ষা করেছে মাতৃভাষা বাংলা। পেয়েছে নিজেদের বাঙালি হিসেবে পরিচয় দেয়ার অধিকার। বাঙালি অর্জন করেছে লাল সবুজে আচ্ছাদিত পতাকা, দেশের সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনতা।  বাংলাদেশের সমৃদ্ধির সঙ্গেই মাতৃভাষা বাংলার সমৃদ্ধির প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকুক সকলের অন্তরে। সংগীত, কবিতা, শিক্ষা, সংস্কৃতি ও সাহিত্যের ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করার লক্ষ্যে সর্বস্তরে বাংলার প্রচলনে আমাদেরকে আরো যত্নশীল হতে হবে। এভাবেই ভাষার জন্য রক্ত দানকারী শহীদদের প্রতি আমাদের ঋণ শোধবোধ কিছুটা হলেও পূর্ণ হবে। শিল্পীর কণ্ঠে আর তো শুনতে হবে না ‘ওরা আমার মুখের ভাষা কাইরা নিতে চায়।’

লেখক: এমফিল গবেষক, বাংলা বিভাগ, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় 

মিনিস্ট্রি অডিটরদের গরুর দড়িতে বাঁধবেন শিক্ষকরা! - dainik shiksha মিনিস্ট্রি অডিটরদের গরুর দড়িতে বাঁধবেন শিক্ষকরা! অ্যাডহক কমিটি সংক্রান্ত শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নতুন নির্দেশনা - dainik shiksha অ্যাডহক কমিটি সংক্রান্ত শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নতুন নির্দেশনা কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে সোহরাওয়ার্দী কলেজ যেনো ধ্বং*সস্তূপ - dainik shiksha সোহরাওয়ার্দী কলেজ যেনো ধ্বং*সস্তূপ জোরপূর্বক পদত্যাগে করানো সেই শিক্ষকের জানাজায় মানুষের ঢল - dainik shiksha জোরপূর্বক পদত্যাগে করানো সেই শিক্ষকের জানাজায় মানুষের ঢল শিক্ষাব্যবস্থার ত্রুটি সারানোর এখনই সময় - dainik shiksha শিক্ষাব্যবস্থার ত্রুটি সারানোর এখনই সময় কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক - dainik shiksha কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0034520626068115