চলতি সপ্তাহের শুরুতে শনিবার ও রোববার একটি দৈনিক পত্রিকায় শিক্ষাবিষয়ক তিনটি সংবাদ আলাদাভাবে দৃষ্টি আকর্ষণযোগ্য। প্রথম সংবাদটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো শীর্ষস্থানীয় উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের। সেখানকার শারীরিক শিক্ষাকেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক শিক্ষার্থীদের ‘উৎসাহ’ দিচ্ছেন, তারা যেন খেলাধুলার বদলে প্রথম থেকেই বিসিএসের প্রস্তুতি নিতে থাকে। দ্বিতীয় সংবাদটি ভোলা জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদককে নিয়ে। এই নেতাপ্রবর জেলার বিভিন্ন ইউনিটের পদ রীতিমতো ‘নিলামে বিক্রি’ করে থাকে। ওদিকে তৃতীয় সংবাদে দেখা যাচ্ছে, চলমান এসএসসি পরীক্ষায় সারাদেশে ৩৮ হাজার শিক্ষার্থী পরীক্ষায় বসতে পারেনি। কারণ দারিদ্র্য ও বাল্যবিয়ে। মঙ্গলবার (৩০ মে) সমকাল পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।
নিবন্ধে আরও জানা যায় শিক্ষাব্যবস্থার এই বিচিত্র দশা কেন? কারণ দীক্ষাগুণ। শিক্ষার সঙ্গে দীক্ষার কথাটাও আসে। ‘শিক্ষাদীক্ষা’ প্রায় একই সঙ্গে চলাফেরা করে। এই যোগাযোগটা কিন্তু অকারণে ঘটেনি। শিক্ষা ও দীক্ষা একই সঙ্গে থাকে, তা যতই আমরা না দেখার চেষ্টা করি না কেন। আসলে দীক্ষাই শিক্ষাকে পরিচালনা করে থাকে ভেতর থেকে এবং অনেকটা অদৃশ্য পন্থায়। শিক্ষার পক্ষে ওই পরিচালনা না মেনে উপায় নেই।
আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় অনেক গলদ, ফাঁক-ফাঁকি রয়েছে। তা নিয়ে কথাবার্তা হয়। হওয়া খুবই প্রয়োজন। কিন্তু যে ‘অন্তর্যামী’ অনালোচিত থেকে যায় সে হলো দীক্ষাগুরু, নাম যার পুঁজিবাদ। ওই গুরুকে বিদায় না করতে পারলে ত্রুটিগুলো শোধরানো অসম্ভব। শোধরানো যে অসম্ভব– সেটা তো বোঝাই যাচ্ছে। সংস্কারের উদ্যোগ তো কম নেওয়া হয়নি; হামেশাই নেওয়া হচ্ছে। একের পর এক কমিটি, কমিশন আসছে-যাচ্ছে; সুচিন্তিত নানা ধরনের সুপারিশ পাওয়া যাচ্ছে, আরও পাওয়া যাবে; থামবে না। কিন্তু যতই যা করা হোক, শিক্ষাব্যবস্থাটা মোটেই সবল হচ্ছে না, উল্টো ক্রমাগত দুর্বল হচ্ছে। এর কারণ, দীক্ষাগুরুর তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে। অব্যাহত রয়েছে বললে সবটা বলা হবে না; তৎপরতা বৃদ্ধি পাচ্ছে, প্রবল হচ্ছে। আর ওই প্রবলতাই হচ্ছে মূল কারণ, যে জন্য শিক্ষাব্যবস্থাটা বিপদগ্রস্ত হতে হতে এখন প্রায় ধ্বংসের প্রান্তে এসে পৌঁছেছে।
পুঁজিবাদের নিয়ম এই যে, অন্য সবকিছুকে হটিয়ে দিয়ে সে মুনাফা খুঁজবে এবং যত মুনাফা পাবে ততই মুনাফালোভী হয়ে উঠবে। মুনাফার উন্নতিকেই প্রচার করতে থাকবে দেশের ও দশের উন্নতি বলে। যদিও উন্নতিটা দেশের নয়; ব্যক্তির। দশের নয়; একের।
আমাদের দেশে শিক্ষার স্বীকৃত উদ্দেশ্যটা কী? এ প্রশ্নের জবাবে নানা কথা বলা যায় এবং বলা হয়। কিন্তু মূল উদ্দেশ্য যে মুনাফা– গুরুগম্ভীর আলোচনাতে সেই সত্য কথাটা বেরিয়ে আসে না; যদিও লোককথায় সেটা বহুকাল ধরে স্বীকৃত। লোককথায় পরিষ্কার বলা আছে– লেখাপড়ার উদ্দেশ্য হচ্ছে গাড়িঘোড়ায় চড়া। আমি লেখাপড়া শিখব। কারণ, না শিখলে আমার গাড়িঘোড়ায় চড়া হবে না। গাড়িতে নিজে চড়ে অন্যদের চাকার তলায় চেপে মারব– এই কথাটা অবশ্য বলা হয় না। তবে সেটা না বললেও চলে। কে না জানে, কান টানলে মাথাও আসবে! একজনই যদি শুধু ওঠে, তবে ৯ জন অবশ্যই নামবে। নিজের উন্নতির এই আগ্রহটাই শিক্ষার পেছনের আসল কথা, তা যে আচ্ছাদনেই তাকে উপস্থিত করা হোক না কেন।
দীক্ষাগুরুই প্রধান শিক্ষক। এই শিক্ষকের প্রধান শিক্ষা হচ্ছে ধনী হও, বড় হও। এটা সে ঘরে শেখায়, বাইরে শেখায়। শিক্ষার বেলাতেও ওই শিক্ষার কোনো ব্যতিক্রম ঘটে না বা ব্যতিক্রম ঘটা সম্ভবও নয়। তাই তো দেখা যায়, শিক্ষা নয়, শিক্ষার ছাপই প্রধান হয়ে দাঁড়ায়। ছাপটা হচ্ছে পরীক্ষার রেজাল্ট। পরীক্ষায় কে কেমন রেজাল্ট করল, কতটা উজ্জ্বল হলো, স্বর্ণের মতো নাকি তারকার– সেটাই হয়ে পড়ে জ্ঞান নিরূপণের মানদণ্ড। শিক্ষা পেছনে পড়ে থাকে, ছোটাছুটি চলে পরীক্ষাগৃহে। চলতে থাকে মুখস্থ করা, নকল করা, ফাঁস হয়ে যাওয়া প্রশ্ন ক্রয় করার মতো কাজ। অভিভাবকরা লজ্জা পায় না ফাঁস হয়ে যাওয়া প্রশ্নপত্র কিনতে। সবকিছুর পেছনে প্রণোদনা ওই একটিই, পরীক্ষায় ভালো করা। ক্লাসরুমে যে শিক্ষা নেই; শিক্ষা যে চলে গেছে কোচিং সেন্টার, গাইড বুক, প্রাইভেট টিউশন ইত্যাদিনির্ভর জায়গাতে, তার কারণও ওই একটাই– পরীক্ষায় ভালো ফল করার অস্থির আকাঙ্ক্ষা।
চিকিৎসা এবং শিক্ষার মতো অতি জরুরি প্রয়োজনগুলো মেটানোর দায়িত্ব নেওয়ার কথা রাষ্ট্রের। আমাদের দেশে স্কুলে বিনা বেতনে শিক্ষা, বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক, মেয়েদের জন্য উপবৃত্তি ইত্যাদির ব্যবস্থা করা হয়েছে বটে; পরীক্ষা পাসের জন্য ক্লাসরুমের শিক্ষার ওপর নির্ভর করার ইতিহাস বিলুপ্তির পথে। ভরসা এখন প্রাইভেট ব্যবস্থা। কিনতে হয়, নইলে পাওয়া যায় না। ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র বিদায় নিয়েছে; এসেছে পুঁজিবাদী রাষ্ট্র। এই রাষ্ট্রকে দেশের সব মানুষ মিলে যুদ্ধ করে প্রতিষ্ঠা করেছে। কিন্তু এই রাষ্ট্র পুঁজিবাদী, যার অর্থ এটি দশজনের নয়, একজনের। এটি ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রেরই ‘উন্নত’ সংস্করণ মাত্র। এটি আরও বেশি পুঁজিবাদী, বেশি নিপীড়নকারী।
পুঁজিবাদী দীক্ষাগুরুর অমোঘ নির্দেশে পরিচালিত এই রাষ্ট্র তাই আরও উন্নতির বিজ্ঞাপন প্রচার করে। চোখ তার উপরমুখো, তাই সে দেখতে পায় না– উন্নতির জাঁতাকলে পড়ে সৃষ্টিশীলতা কাবু হয়েছে এবং দশজনের মধ্যে ৯ জনই শিকার হচ্ছে নিষ্ঠুর বঞ্চনার। পুঁজিবাদের এই জঙ্গলে সে-ই টিকবে যার টাকা আছে; এবং এখানে টাকা শ্রমজীবীর হাতে থাকবে না। থাকবে পরশ্রমজীবীদের হাতে। শিক্ষা, সংস্কৃতি, ভোগবিলাস– সবকিছুই পরশ্রমজীবীদের করতলগত। শ্রমজীবী শ্রম করবে; করতেই থাকবে। উন্নতি যা ঘটবে সেটা তাদেরই শ্রমে, কিন্তু তারা ফল পাবে না। পাবে কেবল দুর্ভোগ। উন্নতির পথ লুণ্ঠন ও দুর্নীতিতে আকীর্ণ।
আমাদের এই পুঁজিবাদী রাষ্ট্রে পরীক্ষার ব্যাপারে শাসকশ্রেণির ভীষণ উৎসাহ। কারণ জ্ঞানের প্রকৃত চর্চা তারা চায় না। ব্রিটিশ শাসকরা চায়নি, পাকিস্তানি শাসকরা চায়নি, বাঙালি শাসকরাও চায় না। জ্ঞানকে তারা খুবই ভয় করে। তাদের আশঙ্কা, জ্ঞানের চর্চা হলে লোকে তাদের চিনে ফেলবে; মানবে না এবং বিদ্যমান ব্যবস্থাটাকে ভেঙে ফেলতে চাইবে। তাই বিদ্যা-বুদ্ধির ততটুকু চর্চাই যথেষ্ট মনে করে, যতটুকু চর্চা ব্যবস্থাটাকে চালু রাখা এবং ব্যবস্থার সুবিধাভোগী শাসকদের সেবা করার জন্য অত্যাবশ্যক; তার বাইরে নয়। তারা চায়, লোকে শিক্ষা ভুলে পরীক্ষা নিয়ে মত্ত থাকুক এবং পরীক্ষায় কী করে ভালো ফল করা যায় তা নিয়ে ভাবতে ভাবতে বিদ্যা-বুদ্ধি অর্জনের কথা ভুলে যাক।
দুর্দশা বৃদ্ধি শুধু যে পরীক্ষার মাধ্যমে ঘটানো হচ্ছে, তা নয়; পাঠ্যসূচিকেও দুর্বল করে ফেলা হয়েছে। ধর্মীয় শিক্ষা শিক্ষার্থীর ঘরেই হওয়ার কথা; তাকে নিয়ে আসা হয়েছে বিদ্যালয়ে। অথচ এই রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ই ঘটেছিল ধর্মনিরপেক্ষতা প্রতিষ্ঠার আশা নিয়ে। বাংলাদেশ রাষ্ট্রে ধর্মশিক্ষা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে, যেটা এমনকি পাকিস্তান আমলেও ছিল না। ওদিকে কমিয়ে দেওয়া হয়েছে ইতিহাসের পাঠ। বাংলাদেশের অভ্যুদয় যে হঠাৎ হয়নি; তাকে আসতে হয়েছে কঠিন সংগ্রামের দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে এবং এর বাইরেও যে এ দেশের মানুষের সুদীর্ঘ এক ইতিহাস রয়েছে; তার সঙ্গে পরিচয় না থাকলে কোনো ব্যক্তিকেই যে শিক্ষিত বলা চলে না– এই সামান্য জ্ঞানটি মনে হয় শিক্ষা পরিকল্পনাকারী জ্ঞানী ব্যক্তিদের নেই। এ ধরনের হস্তীমূর্খের আর যেখানেই স্থান হোক; শিক্ষা ব্যবস্থাপনায় স্থান হওয়ার কথা নয়। কিন্তু তারাই তো শিক্ষার হর্তাকর্তা। সবই গুরুর ইচ্ছায়। গুরু এমনটাই চায়।
লেখক : সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়