শিক্ষাব্যবস্থায় প্রাথমিক শিক্ষা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্তর। শিক্ষার্থীর আগামীর পথচলার ভিত তৈরি হয় এ স্তরে। প্রাথমিক স্তরে কোনো শিক্ষার্থী সঠিকভাবে মূল যোগ্যতাসমূহ অর্জন করতে সক্ষম হলে, পরবর্তী শিক্ষা জীবনে তার জ্ঞান ও মূল্যবোধের সোপানগুলোও সফলতার সঙ্গে অতিক্রম করার সম্ভাবনা তৈরি হয়। যেহেতু শিক্ষাকে জাতির মেরুদণ্ড হিসেবে অভিহিত করা হয়, সে অর্থে মূলত জাতির ভবিষ্যতের ভিত্তিপ্রস্থর স্থাপন করা হয় প্রাথমিক শিক্ষায়। আর জাতির সেই ভিত্তি গড়ার প্রথম ও গুরুত্বপূর্ণ কারিগর হলেন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা।
জাতিসংঘ ঘোষিত ‘টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা’ বা এসডিজি এর অভীষ্ঠ-৪ এ ‘মানসম্মত শিক্ষা’র কথা বলা হয়েছে। মানসম্মত শিক্ষা অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো মানসম্মত শিক্ষক। আর মানসম্মত শিক্ষক গঠনে মানসম্মত প্রশিক্ষণ প্রয়োজন, কিন্তু তারও আগে প্রয়োজন মানসম্মত শিক্ষক শিক্ষা। একজন মানসম্মত শিক্ষক হওয়ার জন্য বিষয়জ্ঞান ও শিখন-শেখানো পদ্ধতি জানার পাশাপাশি শিক্ষার রাষ্ট্রীয় নীতি, ঐতিহাসিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপট, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, মনোজাগতিক ও দার্শনিক প্রেক্ষাপট সম্পর্কেও জানা প্রয়োজন। এটি একটি সামগ্রিক প্রক্রিয়া। স্বল্পমেয়াদী কোনো প্রশিক্ষণের মাধ্যমে এসব বিষয় সম্পর্কে সামগ্রিক ধারণা ও দক্ষতা অর্জন করা সম্ভব হয় না। এজন্য প্রয়োজন হয় শিক্ষক শিক্ষার।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বাংলাদেশে বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘শিক্ষা ও গবেষণা ইন্সটিটিউট’ থেকে শিক্ষায় ৪ বছরের স্নাতক ডিগ্রি ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি দেয়া হয়। সরকারি শিক্ষক প্রশিক্ষণ কলেজগুলোতেও ৪ বছরের স্নাতক ডিগ্রি দেয়া হয়। এর পাশাপাশি মাধ্যমিকের শিক্ষকদের জন্য টিটিসিগুলোতে ১বছরের বিএড কার্যক্রম রয়েছে। উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও শিক্ষক শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত হয়। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কর্মরত শিক্ষকদের জন্য সরকারি প্রাথমিক শিক্ষক প্রশিক্ষণ ইন্সটিটিউট থেকে পূর্বে ১৮ মাসের ডিপ্লোমা ইন প্রাইমারি এডুকেশন, ডিপিএড ডিগ্রি প্রদান করা হতো। বর্তমানে মৌলিক প্রশিক্ষণ নামে একটি কোর্স চালু রয়েছে।
আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশসহ উন্নত দেশগুলোতে শিক্ষক নিয়োগের পূর্বশর্ত হিসেবে শিক্ষক শিক্ষার ডিগ্রি অর্জনের বিষয়টি রয়েছে। অর্থাৎ কারো শিক্ষক শিক্ষার ওপর ডিগ্রি না থাকলে তিনি শিক্ষক হিসেবে আবেদনই করতে পারবেন না। বাংলাদেশে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষায় অবশ্য এরকম কোনো শর্ত নেই। শিক্ষা বিষয়ে কোনরকম ডিগ্রি অর্জন ব্যতীত এ দুই স্তরে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেয়ে থাকেন। এ দুই স্তরেই মাধ্যমিকে শিক্ষকদেরকে ১ বছরের বিএড ডিগ্রি এবং প্রাথমিকের শিক্ষকদেরকে সরকারি পিটিআইসমূহে মৌলিক প্রশিক্ষণ নিতে হয়। এখানে মাধ্যমিকের সঙ্গে প্রাথমিকের পার্থক্য রয়েছে। যেখানে মাধ্যমিকে শিক্ষকরা একটি শিক্ষা বিষয়ক ডিগ্রি অর্জন করেন, প্রাথমিকের শিক্ষকরা সেখানে ১০ মাসের একটি মৌলিক প্রশিক্ষণ পেয়ে থাকেন।
মাধ্যমিকে ‘এমপিও নীতিমালা-২০২১’ অনুযায়ী নতুন নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষককে নিয়োগ পাবার ৫ বছরের মধ্যে বিএড ডিগ্রি অর্জনের বাধ্যবাধকতার বিষয়টি উল্লেখ আছে। অন্যদিকে প্রাথমিকের শিক্ষকদের জন্য প্রণীত ২০১৯ খ্রিষ্টাব্দের নিয়োগবিধিতে ৪ বছরের মধ্যে শিক্ষক শিক্ষা বিষয়ে ডিগ্রি অর্জনের বিষয়টি বাধ্যতামূলক করা হয়েছে (পরবর্তীতে শিক্ষক শিক্ষার পরিবর্তে মৌলিক প্রশিক্ষণের বিষয়টি যুক্ত করা হয়েছে।) এবং এটিকে চাকরি স্থায়ীকরণের শর্ত হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে এতে দেখা যায় অনেক শিক্ষক বেশ কয়েক বছর ধরে শিক্ষক শিক্ষা বিষয়ক পর্যাপ্ত কোনো জ্ঞান ছাড়াই শ্রেণিকক্ষে পাঠদান করে যাচ্ছেন। এক্ষেত্রে তিনি স্থানীয় পর্যায়ে বিভিন্ন সময়ে বিচ্ছিন্নভাবে পাওয়া বিষয়ভিত্তিক কিছু স্বল্পমেয়াদী প্রশিক্ষণ ও তার নিজের শিক্ষাজীবনের অভিজ্ঞতাকে সম্বল করে শ্রেণি কার্যক্রম পরিচালনা করছেন। শিক্ষায় যে রাষ্ট্রীয়, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, মনস্তাত্ত্বিক, আবেগিক ও মূল্যবোধের তাত্ত্বিক দিক রয়েছে, এবং শিখন শেখানো প্রক্রিয়ায় তার সমন্বিত প্রয়োগের প্রয়োজন, তা সম্পর্কে তার জানাশোনার ঘাটতি রয়ে যাচ্ছে বেশ কিছু বছর।
শিক্ষক শিক্ষা অর্জন ছাড়া চাহিদাভিত্তিক স্বল্পমেয়াদী প্রশিক্ষণ হলো মূলত ফাউন্ডেশন ছাড়া ঐ দুর্বল ভবনের মতো, যাকে বহুতল ভবন বানানো অসম্ভব। জোড়াতালি দিয়ে এ ভবন টিকিয়ে রাখতে হয়। এর ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হয় কোমলমতি শিক্ষার্থী, শিক্ষাব্যবস্থা এবং সামগ্রিকভাবে জাতি। তাই শিক্ষক নিয়োগে আবেদনের পূর্বশর্ত হিসেবে মাধ্যমিকের জন্য বিএড (ব্যাচেলর অব এডুকেশন) ডিগ্রি এবং প্রাথমিকের জন্য বিপিএড (ব্যাচেলর অব প্রাইমারি এডুকেশন) ডিগ্রি অর্জন করা বাধ্যতামূলক করা যেতে পারে।
শিক্ষকতায় আবেদনের পূর্বশর্ত হিসেবে শিক্ষায় ডিগ্রি বাধ্যতামূলক করলে, যারা শিক্ষকতা করতে আগ্রহী তারাই এ পেশায় আসবেন। শিক্ষাবিষয়ে পর্যাপ্ত জ্ঞান নিয়ে তারা বিদ্যালয়ে প্রথম দিন থেকেই শ্রেণিতে পাঠদান করতে পারবেন। বর্তমান বাস্তবতায় তুলনামূলক স্বল্প বেতনের কারণে এখন অনেকেই কোথাও ভালো চাকরি না পেয়ে শিক্ষকতা করতে আসেন। ফলে শিক্ষকতা পেশাকে কেউ কেউ স্রেফ চাকরি হিসেবে দেখেন, শুধু আয়সৃজনী কাজ হিসেবে গণ্য করেন। সত্যিকারের শিক্ষক হতে, এ পেশাকে ভালোবাসতে কারো কারো অনেক সময় লেগে যায়। তাই মানসম্মত শিক্ষা অর্জনের লক্ষে মানসম্মত শিক্ষক পাওয়ার জন্য শিক্ষকতায় আগ্রহী মানুষেরও প্রয়োজন। যা কিছুটা হলেও নিশ্চিত করতে পারে প্রি-সার্ভিস শিক্ষক শিক্ষা সংক্রান্ত ডিগ্রি।
এছাড়াও প্রি-সার্ভিস শিক্ষক শিক্ষা ডিগ্রির আরো একটি সুবিধা আছে। নিয়োগের পূর্বেই শিক্ষক শিক্ষা ডিগ্রি থাকলে শিক্ষক শিক্ষার জন্য শিক্ষককে দীর্ঘমেয়াদে বিদ্যালয়ের বাইরে থাকতে হবে না। শিক্ষার্থীও ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। শিক্ষকদের ইন-সার্ভিস প্রশিক্ষণ প্রদান করতে সরকারের যে অর্থ ব্যয় করতে হয়, সে অর্থেরও সাশ্রয় হবে, বা সে অর্থ অন্য সিপিডি (ধারাবাহিক পেশাগত উন্নয়ন) প্রশিক্ষণে ব্যয় করতে পারবে।
আবেদনের পূর্বশর্ত হিসেবে শিক্ষায় ডিগ্রি অর্জনের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে সরকারের অবকাঠামো খাত সহ অন্যান্য বিষয়েও খুব বেশি পরিবর্তনের প্রয়োজন হবে না। মাধ্যমিকের জন্য টিটিসিগুলো পুরোপুরি সক্ষম। প্রাথমিকের জন্য শুধু আদেশবলে পিটিআইগুলোকে ‘প্রাইমারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ’ বা ‘কলেজ অব প্রাইমারি এডুকেশন’ এ রূপান্তর করতে হবে। প্রাথমিকের জন্য শিক্ষক শিক্ষার ডিগ্রির নাম ‘বিপিএড’ করতে হবে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় তার সনদ দিতে পারে। অবকাঠামো খাতেও খুব বেশি পরিবর্তন করতে হবে না। সরকারের আর্থিক খরচও খুব বেশি করতে হবে না এক্ষেত্রে। প্রয়োজন শুধু যুগের চাহিদা পূরণে, এসডিজি লক্ষ্য বাস্তবায়নে, উন্নত জাতি বিনির্মাণে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ।
তবে, যতদিন শিক্ষক পদে আবেদনের পূর্বশর্ত হিসেবে শিক্ষক শিক্ষা ডিগ্রি বাধ্যতামুলক না করা হবে, ততদিন মাধ্যমিকের বিএডের মত প্রাথমিকেও কমপক্ষে ১ বছর মেয়াদী শিক্ষক শিক্ষা বিষয়ক ডিগ্রি থাকা আবশ্যক। বর্তমানে চলমান মৌলিক প্রশিক্ষণ কোর্স যুগের প্রয়োজনে সংশোধন করে আরো উন্নত করা প্রয়োজন। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম শিক্ষা কমিশন ‘ড. কুদরত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট-১৯৭৪’ এবং সর্বশেষ ‘জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০’, এ উভয় রিপোর্টেই প্রাথমিকের শিক্ষকদের জন্য শিক্ষা বিষয়ক ডিগ্রির মেয়াদ ১ বছরের চেয়ে বাড়ানোর জন্য সুপারিশ করা হয়েছে। কোনো রিপোর্টেই কমানোর কথা বলা হয়নি। প্রাথমিকের মতো গুরুত্বপূর্ণ স্তরের শিক্ষকদের পরিপূর্ণ ভাবে প্রস্তুত করেই শ্রেণিকক্ষে পাঠানো প্রয়োজন।
প্রাথমিকের শিক্ষকদের বর্তমান ইন-সার্ভিস প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে আরো একটি সমস্যা রয়েছে। এ কোর্স করার পরে তাদের বেতন স্কেলে উচ্চতর গ্রেড দেয়া তো দূরের কথা, কোনো ইনক্রিমেন্টও দেয়া হয় না। অথচ মাধ্যমিকে বিএড ডিগ্রি অর্জনের পর শিক্ষকদের বেতন স্কেল ১১তম গ্রেড থেকে ১০ম গ্রেডে উন্নীত হয়। প্রাথমিকে এরকম কোনো ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। শিক্ষক শিক্ষার কোনো ডিগ্রিই এক্ষেত্রে সে সুবিধা দিতে পারে। আর্থিক কোনো সুবিধার বিষয় থাকলে সে ডিগ্রি অর্জনে শিক্ষকদের মাঝে আগ্রহ তৈরি হবে। তাই শিক্ষা বিষয়ে ডিগ্রি অর্জনের পর তাদের বেতন স্কেল পরিবর্তন করে উচ্চতর স্কেল দেয়া যেতে পারে। একদেশে দুই স্তরের শিক্ষায় দুই ধরনের নীতি অনভিপ্রেত। একই নীতি এক্ষেত্রে বাস্তবায়ন করা জরুরি। তবে অদূর ভবিষ্যতে শিক্ষক নিয়োগের পূর্বশর্ত হিসেবে শিক্ষক শিক্ষার ডিগ্রি অর্জন নির্ধারণ করা খুব বেশি প্রয়োজন।
প্রি-সার্ভিসের পাশাপাশি ভবিষ্যতে শিক্ষকদের জন্য আলাদা পে কমিশন গঠনের বিষয়টিও সক্রিয় বিবেচনায় থাকতে পারে। শিক্ষকদের পর্যাপ্ত আর্থিক নিরাপত্তা দিলে তা মানসম্মত শিক্ষা অর্জনে প্রভাবক হিসেবে কাজ করবে।
শিক্ষকদের পাশাপাশি শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে যারা কাজ করবেন, যারা শিক্ষকদের পাঠদান কার্যক্রম মাঠপর্যায়ে নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করবেন, প্রয়োজনীয় একাডেমিক ফিডব্যাক দিবেন, তাদের নিয়োগের ক্ষেত্রেও শিক্ষা বিষয়ক ডিগ্রি অর্জন পূর্বশর্ত হিসেবে নির্ধারণ করা প্রয়োজন।
সবশেষে প্রত্যাশা, জাতিসংঘের ঘোষিত সহস্রাব্দের লক্ষ্যমাত্রা ‘সবার জন্য শিক্ষা’ অর্জনে বাংলাদেশ যেভাবে অভূতপূর্ব সফলতা দেখিয়েছে, ঠিক তেমনিভাবে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা ‘মানসম্মত শিক্ষা’ অর্জনেও বাংলাদেশ সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে সারাবিশ্বে মানসম্মত শিক্ষায় নেতৃত্ব দেবে।
লেখক: ইন্সট্রাক্টর, পিটিআই, মাদারীপুর