শিক্ষকরা তাদের শিক্ষার্থীদের জীবন গঠনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। একজন শিক্ষক শিক্ষার্থীদের মধ্যে শুধুমাত্র কোনো নির্দিষ্ট বিষয়ের জ্ঞান বিতরণের দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ নয়, বরং তিনি তার শিক্ষার্থীদের কাছে জীবনের সর্ব ক্ষেত্রের একটি আদর্শমান, রোল মডেল এবং অনুপ্রেরণার নিরন্তর উৎস হিসেবে কাজ করে। বিষয়টি প্রায়শ উপেক্ষিত হলেও শিক্ষার্থীর ওপর শিক্ষকের ব্যাক্তিত্ত্বের গভীর এবং দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব অনস্বীকার্য। একজন শিক্ষকের আদর্শ ও সামঞ্জস্যপূর্ণ ব্যক্তিত্ব শিক্ষার্থীদের ওপর গভীর প্রভাব ফেলতে পারে যা তাদের ইতিবাচক মনোভাব, আচরণ এবং সামগ্রিক জীবনপাঠে প্রত্যয়ী করে তুলতে সাহায্য করে।
শিক্ষকের ব্যক্তিত্ব তার ছাত্রদের মানসিক গড়নে, দৃষ্টিভঙ্গি এবং জীবনবোধ সম্পন্ন করে তোলার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্যভাবে প্রভাবিত করতে পারে। হৃদয়গতভাবে উষ্ণ, সহানুভূতিশীল এবং যত্নশীল শিক্ষকরা এমন একটি শ্রেণিকক্ষের পরিবেশ তৈরি করেন যেখানে শিক্ষার্থীরা তাদের চিন্তাভাবনা এবং আবেগ প্রকাশ করতে নিরাপদ বোধ করেন। অন্যদিকে, যেসব শিক্ষক এসব ক্ষেত্রে উদাসীন তারা শিক্ষার্থীদের মানসিক গড়ন বা মননের জায়গাটাতে আলোকপাত করতে ব্যর্থ হতে পারেন। একটি ইতিবাচক শিক্ষক-ছাত্র সম্পর্ক স্ট্রেস এবং উদ্বেগের বিরুদ্ধে একটি বাফার হিসেবে কাজ করতে পারে, যা শিক্ষার্থীদের মধ্যে উন্নত মানসিক স্বাস্থ্য এবং সামগ্রিক সাফল্যের দিকে পরিচালিত করে।
অন্তর্গতভাবে উৎসাহী শিক্ষকরা তাদের শিক্ষার্থীদের মধ্যে একই রকম উৎসাহ জাগিয়ে তুলতে সক্ষম হন যা কার্যকর শিখনের একটি জরুরি অনুসঙ্গ। একজন শিক্ষক যিনি তার পাঠদানের বিষয়টিকে সত্যিকারভাবে ভালোবাসেন এবং শ্রেণিকক্ষে পাঠদানকে এনজয় করেন, তিনি শিক্ষার্থীদেরকেও পাঠে নিযুক্ত হতে এবং শিখতে অনুপ্রাণিত হতে, অনুপ্রাণিত করতে পারেন। বিপরীতভাবে, এ বিষয়ে অসচেতন একজন শিক্ষক অসাবধানতাবশত বিষয়ের প্রতি শিক্ষার্থীদের আগ্রহকে ধরে নাও রাখতে পারেন। আসলে শিক্ষকের ব্যক্তিগত উৎসাহ সংক্রামক হতে পারে, যা একটি ইতিবাচক শিক্ষার পরিবেশ তৈরি করে শিক্ষার্থীর সক্রিয় অংশগ্রহণ এবং কৌতূহলকে জাগ্রত রাখতে পারে।
শিক্ষার্থীর আত্মবিশ্বাস এবং আত্মমর্যাদা হ্রাস-বৃদ্ধিতেও শিক্ষকের রয়েছে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভূমিকা। একজন মানবিক শিক্ষকের কাছ থেকে ইতিবাচক শক্তিবৃদ্ধি, প্রশংসা এবং গঠনমূলক প্রতিক্রিয়া শিক্ষার্থীদের আত্ম মূল্যের দৃঢ় অনুভূতি তৈরি করতে সাহায্য করতে পারে।
বিপরীতভাবে, যিনি প্রায়শ সমালোচনামুখর অসহিষ্ণু, তিনি শিক্ষার্থীর আত্মবিশ্বাসের ভিতকে নিজের অজান্তেই দুর্বল করে দিতে পারে। এর ফলে, শিক্ষার্থী হীনমন্যতায় ভুগতে পারে করতে এবং ক্রমশ নিরুৎসাহিত হয়ে উঠতে পারে। একজন শিক্ষকের ব্যক্তিত্ব শিক্ষার্থীর আত্মবিশ্বাস গঠনে ইতিবাচকভাবে প্রভাবিত করতে পারে।
শিক্ষকরা শুধু বিষয়ভিত্তিক জ্ঞানের পরিবেশক নন; তারা নৈতিককতারও পথপ্রদর্শক। তাদের ব্যক্তিগত মূল্যবোধ, সততা এবং নৈতিক আচরণ তাদের শিক্ষার্থীদের জন্য উদাহরণ হিসেবে কাজ করে। একজন শিক্ষক যিনি সততা, সম্মান এবং সহানুভূতি প্রদর্শন করেন, সত্যিকার অর্থে তিনিই তার ছাত্রদের মধ্যে এই মূল্যবোধগুলো স্থাপন করতে পারেন, দায়িত্ববোধ এবং ভালো নৈতিক চরিত্রের বিকাশ ঘটাতে পারেন। বিপরীতভাবে, যে শিক্ষকের এই গুণাবলির অভাব রয়েছে সে অসাবধানতাবশত নেতিবাচক আচরণের মডেল হতে পারে, যা শিক্ষার্থীদের অবাঞ্ছিত উপায়ে প্রভাবিত করে।
শ্রেণিকক্ষের পরিবেশ শিক্ষকের ব্যক্তিত্ব দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয়। একজন শিক্ষক যিনি একটি ইতিবাচক এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক শ্রেণিকক্ষের পটভূমি তৈরি করতে পারেন যেখানে সমস্ত শিক্ষার্থীরা নিজেদের যোগ্যতা অনুযায়ী নিজেদেরকে মূল্যবান এবং সম্মানিত বোধ করে। বিপরীতভাবে, একজন শিক্ষক যিনি অসহিষ্ণুতা প্রদর্শন করেন, তিনি একটি বিভাজনকারী এবং অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ তৈরি করতে পারেন। একজন শিক্ষকের ব্যক্তিত্ব শ্রেণিকক্ষের জন্য এমন একটি টিউন সেট করে, যা শিক্ষার্থীদের সামগ্রিক শেখার অভিজ্ঞতাকে প্রভাবিত করে।
একজন শিক্ষকের ব্যক্তিত্ব শিক্ষার্থীদের একাডেমিক কর্মক্ষমতাকেও প্রভাবিত করতে পারে। গবেষণায় দেখা গেছে যে, শিক্ষার্থীরা ওইসব শিক্ষকদের দ্বারা পরিচালিত ক্লাসে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করার সম্ভাবনা বেশি থাকে যাদেরকে তারা সমর্থনকারী, যোগাযোগযোগ্য এবং যত্নশীল বলে মনে করে। যে ছাত্রদের তাদের শিক্ষকদের সঙ্গে ইতিবাচক সম্পর্ক রয়েছে তারা একাডেমিকভাবে সফল হওয়ার জন্য আরো বেশি অনুপ্রাণিত হতে থাকে এবং প্রয়োজনে সাহায্য নেয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। বিপরীতভাবে, একটি নেতিবাচক শিক্ষক-ছাত্র সম্পর্ক একজন শিক্ষার্থীর একাডেমিক অগ্রগতি এবং অর্জনকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে।
শিক্ষার্থীদের ওপর শিক্ষকের ব্যক্তিত্বের প্রভাবকে কোনোভাবেই এড়িয়ে যাওয়া যায় না। পাঠ্যক্রমের বাইরে, শিক্ষকের আচার-আচরণ, দৃষ্টিভঙ্গি এবং মূল্যবোধ একজন শিক্ষার্থীর চরিত্র, প্রেরণা এবং মানসিক সুস্থতাকে গঠন করতে পারে। সহানুভূতি, উদ্যম এবং কার্যকর যোগাযোগের মতো ইতিবাচক গুণাবলি প্রদর্শনকারী শিক্ষকরা তাদের শিক্ষার্থীদের একাডেমিক এবং ব্যক্তিগতভাবে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করতে অনুপ্রাণিত ও ক্ষমতায়ন করতে পারেন।
লেখক: প্রধান শিক্ষক, ঘোড়াশাল পাইলট হাই স্কুল, নরসিংদী