আমাদের দেশে আর্থ-সামাজিক, ও ভৌগলিক কারণে অনেক শিক্ষার্থী সঠিকভাবে শিক্ষাঙ্গনে যাওয়ার উদ্দেশ্যটাই উপলব্ধি করতে পারেনা। বিশেষ করে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে। তাই, শিক্ষক হিসেবে আমি মনে করি একজন শিক্ষকের দায়িত্ব শুধু পাঠদান নয়। শিক্ষার্থীদের মেধার যথাযথ বিকাশের জন্য তিনি যা করতে পারেন-
(১) মনস্তাত্বিক কৌশল প্রয়োগ: একজন শিক্ষক শ্রেণিকক্ষে গিয়েই সকলের সঙ্গে কুশল বিনিময় করে মনস্তাত্ত্বিক কৌশল প্রয়োগ করবেন। এক নজর দেখে নিবেন কার মানসিক অবস্থা কেমন? কে একটু অস্বস্তি বোধ করছে। এ ক্ষেত্রে তার সঙ্গে একটু ফ্রি হয়ে তার শারিরীক ও মানসিক অবস্থার কথা জানা যেতে পারে।
এমনো হতে পারে তার মায়ের শরীর ভালো না, কিংবা সে একটু অসুস্থ্, তাই হুট করেই তার প্রতি বিরক্ত বা রাগান্বিত হওয়া যাবেনা। এক্ষেত্রে মনস্তাত্ত্বিক প্রক্রিয়া অবলম্বন করা যেতে পারে।
(২) বন্ধুসুলভ আচরণ : একজন শিক্ষার্থীকে মনের অজান্তেই আপনার বন্ধুর মত ভাবতে হবে। এমনো হতে পারে সে আপনাকে ভয় পাচ্ছে। হয়তো একটু একটু ইন্ট্রোভার্ট। তাই তার সঙ্গে বন্ধুসুলভ আচরণ করুন। একটু হাসি দিয়ে কথা বলুন, দেখবেন তার ভয়, জড়তা কেটে গেছে। প্রকৃত শিক্ষণ শিখনে শিক্ষককে প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করা একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কিন্ত শিক্ষার্থীর সঙ্গে ফ্রি না হলে সে আপনাকে প্রশ্ন করতে পারবেনা।
(৩) কাল্পনিক অভিনেতা হোন: প্রাসঙ্গিক বিষয়ে হঠাৎ একটা অভিনয় বা একটু মজা করলেন, দেখবেন শিক্ষার্থীদের দৃষ্টিভঙ্গি আপনার দিকে চলে আসছে। শিক্ষার্থীর মনোযোগ আনতে আপনি তাৎক্ষণিক অভিনেতা হয়ে যান। সকলের দৃষ্টি আবার ক্লাসে চলে আসবে।
(৪) সোহাগ মিশ্রিত শাসন : কোনো শিক্ষার্থীকে বিপথগামী হতে দেখলে, তার সঙ্গে ফ্রি হয়ে তাকে একটু আদর সোহাগ দিয়ে ডাক দিন। এমনো হতে পারে পারিপার্শ্বিকতার জন্য সে এই আবেগময় ডাকটির জন্য অপেক্ষা করছিলো।একদিন, দুইদিন, তিনদিন- দেখবেন, এক পর্যায়ে এই ডানপিটে ছেলেটিই আপনার পা ছুঁয়ে তার ভুল স্বীকার করছে।
(৫) পাঠ্যবহির্ভূত বই পড়তে উৎসাহ দেয়া : শুধু পাঠ্য বইয়ের সিলেবাস শেষ করে পরীক্ষায় ভাল করা যায়, কিন্ত জ্ঞানের পরিধি বিস্তৃত হয়না। তাই পাঠ্যবহির্ভূত বিভিন্ন বই পড়তে শিক্ষার্থীদের কে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। নিয়মিত লাইব্রেরি ওয়ার্কের ওপর জোর দেয়া যেতে পারে ।
(৬) প্রকৃতির অনুসন্ধান : শিক্ষার্থীদেরকে প্রকৃতির সান্নিধ্যে সময় কাটানোর জন্য উদ্বুদ্ধ করতে হবে। প্রকৃতি যেভাবে উজাড় করে নিজেকে বিলিয়ে দেয়, প্রকৃতির সান্নিধ্যে গেলে সেই ছোঁয়া পেয়ে তা বাস্তব জীবনে কাজে লাগাতে পারে। বৎসরে একবার শিক্ষা সফরের আয়োজন করা যেতে পারে।
(৭) নৈতিকতার শিক্ষা : শুধু সনদ অর্জনের পেছনে না ছুটে, নিজেকে প্রকৃত মানুষ করার জন্য শিক্ষার্থীদের কে নৈতিকতার ওপর জোর দিতে হবে। ধর্মীয় শিক্ষার উপকারিতা, পারিবারিক ও সামাজিক দায়িত্ববোধ সম্পর্কে তাদের কে অবগত করতে হবে। বৃদ্ধাশ্রম যেনো রেওয়াজে পরিণত হয়ে যাচ্ছে। সনদের হার যত বাড়ছে আদর্শ সন্তান সেভাবে বাড়ছে না। এক্ষেত্রে নৈতিকতার অবক্ষয়ই দায়ী।
(৮) সহপাঠ্যক্রমিক কার্যাবলী চালু: পুঁথিগত লেখাপড়ার পাশাপাশি সপ্তাহে একবার হলেও সহপাঠ্যক্রমিক কার্যাবলীর ওপর জোর দিতে হবে। আবৃত্তি, উপস্থিত বক্তৃতা, সাধারণ জ্ঞান, সাহিত্য ও বিজ্ঞানভিত্তিক কুইজের আয়োজন করা যেতে পারে। প্রয়োজনে বিভিন্ন ক্লাব খুলে তার চর্চা অব্যাহত রাখা যেতে পারে।
(৯) বিভিন্ন প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা : মাঝে মাঝে শ্রেণিকক্ষে বিভিন্ন ক্লাস টেস্টের মাধ্যমে প্রতিযোগিতার আয়োজন করা যেতে পারে। এবং বিজয়ীদের মধ্যে সামান্য অর্থায়নেও পুরস্কারের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এতে শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রতিযোগিতামূলক শিক্ষণ শিখন বৃদ্ধি পায়।
(১০) অভিভাবক সমাবেশ: বৎসরের বিভিন্ন সময় বিভিন্ন শ্রেণির অভিভাবকদের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি, মেধা বিকাশ, ফলাফল, আচরণিক অভীক্ষা ইত্যাদি নিয়া পারস্পরিক মতবিনিময় করা যেতে পারে।
ওপরের বিভিন্ন ধাপগুলো প্রয়োগ করলে শুধু একটি বিদ্যালয় নয়, শিক্ষার্থীরা প্রকৃত মানব সম্পদে পরিণত হয়ে উক্ত জনপদের সুনাম বয়ে আনতে পারে।
লেখক: সহকারী প্রধান শিক্ষক