শিশুর শিক্ষায় করণীয় - দৈনিকশিক্ষা

শিশুর শিক্ষায় করণীয়

কে এম আব্দুল মজিদ, দৈনিক শিক্ষাডটকম |

শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড। শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য হলো দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করা। একটি জাতির শিক্ষা ব্যবস্থা যতো উন্নত জাতি হিসেবে তারা ততো সমৃদ্ধ। এ জন্য একজন ইংরেজ বলেছিলেন, ‘কোনো জাতি কতোটা উন্নত সেটার পরিমাপ করার জন্য ওই জাতির বড় বড় ভবন ও তারা কতোটা বিলাসবহুল জীবনযাপন করে তা দেখার প্রয়োজন নেই। তাদের শিক্ষাব্যবস্থার দিকে তাকালেই পরিষ্কার হবে যে, তারা কতোটা উন্নত।’ সুতরাং একটি জাতির শিক্ষাব্যবস্থাই হতে পারে, সেই জাতি কতোটা সভ্য বা অসভ্য, তা পরিমাপের মাপকাঠি।  

আমরা যদি গভীরভাবে লক্ষ্য করি, তবে দেখতে পাবো আইয়্যামে জাহেলিয়াতের যুগে মানুষ ছিলো কতো হিংস্র, বর্বর, পশু স্বভাবের। এমন কোনো অন্যায় কাজ ছিলো না, যা তাদের দ্বারা সংগঠিত হয়নি। কোনো কৌশল অবলম্বন করলে এই বর্বর, হিংস্র জাতিকে সভ্য মানুষে পরিণত করা যায়; মাদক, সন্ত্রাস ও সকল প্রকার দুর্নীতি, রাহাজানি, ধর্ষণমুক্ত করে লৌকিকভাবে জনগণকে প্রকৃত মানুষে রূপান্তর করা যায়, নবুয়ত লাভের পূর্বে নবী করীম হযরত মুহাম্মাদ (সা.) সেই চিন্তায় বিভোর ছিলেন। হেরা গুহার অন্ধকার কক্ষে বসে তিনি শুধু সেই পথ খুঁজতেন। 

 

পনেরো বছর আরাধনার পর হযরতের বয়স যখন ৪০ বছর পূর্ণ হলো; তখন একদিন হঠাৎ করে ফেরেস্তাকুল শিরোমণি হযরত জিব্রাইল (আ.) আল্লাহর বাণী নিয়ে এসে উপস্থিত হলেন মহানবীর কাছে। তিনি স্রষ্টার পক্ষ থেকে সঙ্গে নিয়ে এলেন এক অনুপম উপহার। যার দ্বারা দূর হবে সমস্ত অনাচার। সমাজ হবে কলুষমুক্ত। দূর হবে জাহেলিয়াতের অন্ধকার। তখনই চারদিকে ফুটে উঠলো আলো আর আলো। আল্লাহ তার বাণীতে উল্লেখ করলেন, হে মুহাম্মদ (স.) তোমার জাতিকে যদি কলুষমুক্ত করতে চাও, সমাজ থেকে যদি মদ, জুয়া, জেনা-ব্যভিচারের মূল উৎপাটন করতে চাও। তাহলে সর্ব প্রথম তোমার জাতিকে শিক্ষিত করতে হবে। কারণ, যে জাতি যতো শিক্ষিত সে জাতি হবে ততো উন্নত। আর সেই শিক্ষা যদি হয় আল্লাহর দেয়া শিক্ষা, সেই শিক্ষা যদি হয় প্রিয় নবী মুহাম্মাদ (স.)-এর দেয়া শিক্ষা; তবে জাতি ইহকালে যেমন হবে উন্নত, পরকালেও তেমনি হবে আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ নেয়ামত জান্নাতুল ফেরদাউসের সম্মানিত মেহমান।  

যে শিক্ষাব্যবস্থা চালুর মাধ্যমে আরবের অসভ্য বর্বর মানুষগুলোও পরিণত হয়েছিলো সোনার মানুষে। অশান্ত সমাজে প্রতিষ্ঠা হয়েছিলো শান্তির রাজত্ব। সেই শিক্ষা আমরাও চালু করতে পারি। এবার আমরা আমাদের শিক্ষাক্রমের দিকে নজর দেই। আমাদের দেশের সমগ্র শিক্ষাব্যবস্থাকে চারটি স্তরে ভাগ করা হয়েছে। যথা: ১. প্রাথমিক স্তর, ২. মাধ্যমিক স্তর, ৩. উচ্চ মাধ্যমিক স্তর, ৪. উচ্চশিক্ষা বা বিশ্ববিদ্যালয় ন্তর। 

শিশু শ্রেণি থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত আমাদের শিক্ষাক্রমে প্রাথমিক স্তর। যে স্তরে আমাদের কোমলমতি শিশু-কিশোরেরা লেখাপড়া করে। এই স্তরের শিশুরা হলো কাদামাটির মতো। তাদের যা শেখানো হবে, তা পাথরে খোদাই করে লেখার মতো তাদের হৃদয়ে গেঁথে যাবে। আমাদের দেশের জনসংখ্যার অনুপাতে ৯০ শতাংশের বেশি লোক মুসলমান, যাদের চাওয়া হলো তাদের সন্তানরা শিশুকাল থেকে যেনো অন্তত কোরআনটা সহিহ-শুদ্ধ করে পড়তে পারে। সুন্দর করে সূরা তেলাওয়াত করতে পারে। নামাজের তালিমটা যেনো তাদের ভালোভাবে দেয়া হয়। আর এটা একজন মুসলমানের ওপর ফরজ দায়িত্বও বটে। কিন্তু বড়ই পরিতাপের বিষয় স্বাধীনতা পরবর্তীকাল থেকে অদ্যাবধি যতোগুলো শিক্ষা কমিশন গঠিত হয়েছে, তাদের কোনো শিক্ষা কমিশনই শিশুদের কোরআন শিক্ষা ও নামাজ কায়েমের বিষয়টি গুরুত্ব দেয়নি। 

গ্রামে গ্রামে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, শিক্ষার্থীদের মিডডে-মিল খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে, উপবৃত্তি চালু হয়েছে, সুরম্য অট্টালিকায় শিক্ষার্থীদের পড়ালেখা করার ব্যবস্থা করা হয়েছে, কিন্তু সরকার মুসলিম অভিভাবকদের কাঙ্ক্ষিত প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেনি। ফলে, কাওমি মাদরাসা, হেফজখানা, নূরানি মাদরাসায় দিনকে দিন শিক্ষার্থীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। অপরদিকে, দেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থী কমতে কমতে শূন্যের কোঠায় নেমে আসছে। কোনো কোনো সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষার্থীর অভাবে বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। 

 

আসলে, শিক্ষাক্রম তৈরির জন্য সরকার যেসব শিক্ষা কমিশন গঠন করেছিলো তাদের কয়েকটি বিষয় গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন ছিলো বলে আমরা মনে করি। যেমন-১. শিক্ষাক্রমে শিক্ষার্থীদের ধর্মীয় পরিচয় অন্তর্ভুক্ত করা, ২. অভিভাবকদের জাতীয়তা তুলে ধরা, ৩. শিক্ষার্থীদের সংস্কৃতি বিবেচনায় রাখা, ৪. শিক্ষার্থীদের সৎ ও যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার পদক্ষেপ নেয়া, ৫. শিক্ষার্থীদের বিশ্বনাগরিক করে তোলা। আমাদের বিশ্বাস, কোনো শিক্ষাক্রমেই উপরিউক্ত বিষয়গুলো গুরুত্বের সঙ্গে ভাবা হয়নি। যার ফলে মুসলমানদের ধর্মীয় শিক্ষার ওপর বিরূপ প্রভাব পড়েছে। 

শিশুদের শিক্ষা পদ্ধতি যেমন হওয়া উচিত

আমাদের মতে, প্রাথমিক স্তরের শিক্ষাপদ্ধতি এমনভাবে ঢেলে সাজানো উচিত যেনো শিশুরা পঞ্চম শ্রেণির মধ্যে অন্তত সহিহ কোরআন তেলাওয়াত, নামাজের ফরজ-ওয়াজিব, সাধারণ মাসলা-মাসায়েল, হালাল-হারামসহ ইসলামের মৌলিক বিষয়গুলো শিখতে সক্ষম হয়। বাংলা ও ইংরেজি গল্পগুলো এমন হওয়া উচিত যা শিক্ষার্থীদের ধর্মীয় শিক্ষা ও অনুশাসন মেনে চলতে উদ্বুদ্ধ করে। গণিত বিষয় থেকে সুদকষা বাদ দিয়ে আয়-ব্যয় ও লাভ-ক্ষতির অংশ যোগ করা যেতে পারে। বিজ্ঞান বিষয়ে, সাধারণ বিজ্ঞানের পাশাপাশি মুসলমান বিজ্ঞানীদের অবদান সম্পর্কে ধারণা দিতে হবে। ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে নবী-রাসূল, সাহাবিদের ইতিহাস, ইসলামী শাসন ও সমাজ ব্যবস্থা সম্পর্কে ধারণা থাকতে হবে। ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষা বইয়ে আল্লাহর আনুগাত্য, রাসূলের আনুগত্য, পিতামাতা ও শিক্ষকদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া, বড়দের সালাম ও ছোটদের স্নেহ করা এমন বিষয় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।

পরিবার শিশুর জন্য শ্রেষ্ঠ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হলেও সচেতনতার অভাবে সব পিতামাতা সন্তানের প্রতি সঠিকভাবে দায়িত্বপালন করতে পারেন না। তাই প্রত্যেক প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অন্তত দুইজন মৌলভী শিক্ষক নিয়োগদানের ব্যবস্থা করলে শিশুদের বাল্যকালেই ইসলাম সম্পর্কে ধারণা দেয়া সম্ভবপর হবে। যদি, শিশুদের অন্তরে আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা জাগ্রত করে দেয়া যায়, তবে অদূর ভবিষ্যতে তাদের দ্বারা অন্যায় হবার সম্ভাবনা কম থাকবে। 
লেখক: অধ্যক্ষ, সলংগা ফাজিল (ডিগ্রি) মাদরাসা, সিরাজগঞ্জ

 

মিনিস্ট্রি অডিটরদের গরুর দড়িতে বাঁধবেন শিক্ষকরা! - dainik shiksha মিনিস্ট্রি অডিটরদের গরুর দড়িতে বাঁধবেন শিক্ষকরা! অ্যাডহক কমিটি সংক্রান্ত শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নতুন নির্দেশনা - dainik shiksha অ্যাডহক কমিটি সংক্রান্ত শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নতুন নির্দেশনা কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে সোহরাওয়ার্দী কলেজ যেনো ধ্বং*সস্তূপ - dainik shiksha সোহরাওয়ার্দী কলেজ যেনো ধ্বং*সস্তূপ জোরপূর্বক পদত্যাগে করানো সেই শিক্ষকের জানাজায় মানুষের ঢল - dainik shiksha জোরপূর্বক পদত্যাগে করানো সেই শিক্ষকের জানাজায় মানুষের ঢল শিক্ষাব্যবস্থার ত্রুটি সারানোর এখনই সময় - dainik shiksha শিক্ষাব্যবস্থার ত্রুটি সারানোর এখনই সময় কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক - dainik shiksha কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0037469863891602