শুদ্ধ বাংলা চর্চাই হোক একুশের অঙ্গীকার - দৈনিকশিক্ষা

শুদ্ধ বাংলা চর্চাই হোক একুশের অঙ্গীকার

সন্তোষ দাস |

মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা রক্ষার্থে জীবন দিয়েছেন এ দেশের সূর্য সন্তানেরা। তাদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে বাংলা ভাষা তার স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো। ভাষা আন্দোলনের সোপান বেয়ে আমরা স্বাধীনতার সুবর্ণরেখা স্পর্শ করেছি। কিন্তু বায়ান্ন থেকে একাত্তর পর্যন্ত যে প্রখর চেতনা আর আবেগে আমরা ভাষা শহীদদের স্মরণ করেছি। বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় সচেষ্ট থেকেছি কেনো যেনো স্বাধীনতা উত্তরকালে সে চেতনা ধীরে ধীরে ফিকে হয়ে গেছে।

এখন অতি আধুনিক শহুরে মেকি সমাজে বাংলা ভাষা অবহেলিত। ভাষা আন্দোলন নিয়ে বাঙালির যে গর্ব ও অহঙ্কার ছিলো আজ যেনো তা অনেকটাই বিবর্ণ। 

এখনকার তরুণ সমাজ মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার ব্যাপারে একেবারেই উদাসীন। আমাদের পূর্বসূরিরা যে ভাষার জন্য জীবন দিলেন, আমরা পারছি না তার মর্যাদা রাখতে। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন একদিকে শোকের অন্যদিকে গর্বের। কারণ, ভাষার জন্য আন্দোলন শুধু বাঙালিরাই করেছে। রক্ত দিয়েছে বাংলার সালাম, বরকত, রফিক, শফিক, জব্বাররা। ১৯৫২-এর ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে ১৯৯৯ এর নভেম্বর পর্যন্ত শুধু আমরাই পালন করেছি দিবসটি।

অবশেষে ১৯৯৯-এর ১৭ নভেম্বর যখন জাতিসংঘের ইউনেস্কো একে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষার মর্যাদায় অভিষিক্ত করলো তখন থেকে দিনটি হয়ে গেলো বিশ্বের সবার। এতে একদিকে যেমন আমাদের ভাষার মর্যাদা বাড়লো, বাড়লো আমাদের গৌরব ও অহংকার। অন্যদিকে, বিশ্বের বহু জাতি অনুপ্রাণিত হলো তাদের নিজ নিজ মাতৃভাষা রক্ষায়। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর ওপর শক্তিশালীদের যে মোড়লপনা সেটা খর্ব হওয়ার সম্ভবনা তৈরি হলো। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর অনেক মৃতপ্রায় ভাষা বেঁচে থাকার প্রেরণা পেলো। সারা বিশ্বের প্রায় ২০০টি দেশ দিনটি পালন করছে। ১৯৫২’র ২১ ফেব্রুয়ারিতে যে অসাধারণ কাজটি আমরা করেছিলাম তা বিশ্ব মাঝে আমাদের গৌরব বাড়িয়েছে। এ অহংকার একমাত্র বাঙালির।   

কিন্তু এই গর্বের মধ্যেও একটি হতাশার দিক আছে। যখন দেখি এ দেশের সর্বত্র বাংলা ভাষার প্রচলন নেই অথবা শুদ্ধ বাংলা চর্চার তাগিদ নেই, তখন অহংকারের জায়গায় একটু হোঁচট লাগে। বেশি হতাশার জায়গাটি সৃষ্টি করেছে আমাদের তরুণ সমাজ। ২১’র চেতনা ওদের মধ্যে প্রায় অনুপস্থিত। আমরা যখন স্কুল-কলেজের ছাত্র ছিলাম তখন যে উৎসাহ উদ্দিপনায় ২১ পালন করতাম বা যে সংখ্যায় প্রভাতফেরিতে অংশ নিতাম তা এখন দেখা যায় না। দেশে লোক বাড়ছে কিন্তু প্রভাতফেরিতে লোক কমছে। তরুণরা এখন ওই সকাল ঘুমিয়ে কাটায় অথবা ব্যাচ কোচিং এ দৌড়ায়। ব্যাচ কোচিংয়ের স্যারেরা তাদের ব্যবসায়িক ক্ষতির সম্ভাবনায় এমন একটা জাতীয় দিবসে ছুটি পর্যন্ত দেয় না। তরুণদের মধ্যে চেতনা জাগ্রত না হওয়ার জন্য হয়তো আমরা বড়রাও কম বেশি দায়ী। 

শহরকেন্দ্রিক তরুণ-যুব সমাজের মধ্যে সুন্দর এবং শুদ্ধ করে বাংলা বলার ক্ষেত্রেও অনিহা। বাংলা হিন্দি এবং ইংরেজি মিলিয়ে খিচুড়ি করতে ওস্তাদ ওরা। কোনোটা ঠিক হয় না। এক্ষেত্রে একটা গল্প মনে পড়লো। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একবার জাহাজে করে বিদেশ থেকে ফিরছিলেন। একই জাহাজে বিলেত থেকে সদ্য ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করা এক বাঙালি যুবকও ছিলেন। যুবক যখন জানলেন জাহাজে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আছেন তখন তিনি ভাবলেন যাই কবিগুরুর সঙ্গে একটু গল্প করে আসি। যুবক ইঞ্জিনিয়ার রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ইংরেজিতে কথা বলছিলেন। কথার মাঝে একসময় তিনি কিছুটা কৈফিয়তের সুরে বললেন, ‘দীর্ঘদিন বিদেশে থাকতে থাকতে বাংলা ভুলে গিয়েছি। তাই ইংরেজি বলছি’। কবি তখন স্মিত হাস্যে বললেন, তাতে দুঃখ ছিলো না যদি ইংরেজিটাও শুদ্ধ করে বলতে।’

আমাদের তরুণ সমাজের অবস্থা অনেকটা ওই যুবক ইঞ্জিনিয়ারের মতো। এরা টিভি দেখে কিছু ইংরেজি আর হিন্দি শিখছে এবং সেটা বাংলার সঙ্গে মিশিয়ে ’হিংবাংলিশ’ করে ফেলছে। বেসরকারি বেতার, টিভির বা মঞ্চের উপস্থাপকরা ইংরেজি বাংলা মিশিয়ে বিকৃত উচ্চারণে কথা বলেন। এরা নিজেদেরকে স্মার্ট মনে করেন। এগুলো দেখে মনে হয় মাতৃভাষার যে গুরুত্ব, মর্যাদা তার কোনো অনুভূতিই তাদের মধ্যে নেই ।  রবীন্দ্রনাথ তার আমার ছেলেবেলায় লিখেছেন, ‘আগে চাই বাংলা ভাষার গাঁথুনি তারপর ইংরেজি শেখার পত্তন।’ নিজের ভাষার বুনিয়াদ ভালো করে গড়ে অবশ্যই অন্য ভাষা শেখা যায়। পৃথিবীর উন্নত জাতি তাদের নিজস্ব ভাষা, কৃষ্টি, সংস্কৃতির ব্যাপারে কোনো আপস করে না।  

আমারা আমাদের মাতৃভাষার জন্য জীবন দিতে পারলাম আর এখন কেনো পারবো না এর মর্যাদা রাখতে? আমরা ২১’র দিনে যতো কথা বলি, যতো লেখালেখি তা যদি সারা বছর মনে রাখি, আমরা যদি আমাদের তরুণ প্রজন্মের মধ্যে দেশপ্রেম জাগ্রত করতে পারি, নিজ ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতির প্রতি তাদের অনুরাগ সৃষ্টি করতে পারি তবেই বাংলাভাষার মর্যাদা রক্ষা পাবে এবং জাতি হিসেবে আমাদের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব টিকে থাকবে।

লেখক: শিক্ষক, ফকিরহাট, বাগেরহাট  

 

৪৭তম বিসিএসে প্রিলি ও লিখিত পরীক্ষার প্রশ্ন জমা দিতে হবে - dainik shiksha ৪৭তম বিসিএসে প্রিলি ও লিখিত পরীক্ষার প্রশ্ন জমা দিতে হবে মেডিক্যালে ভর্তিতে ‘অটোমেশন’ বাতিলের দাবিতে মানববন্ধন - dainik shiksha মেডিক্যালে ভর্তিতে ‘অটোমেশন’ বাতিলের দাবিতে মানববন্ধন অস্ত্র মামলায় স্কুলছাত্র কারাগারে - dainik shiksha অস্ত্র মামলায় স্কুলছাত্র কারাগারে কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে মাদরাসার ৪১ জাল শিক্ষকের এমপিও বাতিল - dainik shiksha মাদরাসার ৪১ জাল শিক্ষকের এমপিও বাতিল রাবিতে সার্টিফিকেট তুলতে এসে ছাত্রলীগ নেতা আটক - dainik shiksha রাবিতে সার্টিফিকেট তুলতে এসে ছাত্রলীগ নেতা আটক ভর্তি হয়ে প্রতারিত হলে দায় নেবে না ইউজিসি - dainik shiksha ভর্তি হয়ে প্রতারিত হলে দায় নেবে না ইউজিসি পঞ্চম গণবিজ্ঞপ্তি: কপাল খুললো ভুল চাহিদায় সুপারিশ পাওয়াদের - dainik shiksha পঞ্চম গণবিজ্ঞপ্তি: কপাল খুললো ভুল চাহিদায় সুপারিশ পাওয়াদের কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক - dainik shiksha কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক সরকারি-বেসরকারি স্কুলে ভর্তি আবেদন শেষ হচ্ছে কাল - dainik shiksha সরকারি-বেসরকারি স্কুলে ভর্তি আবেদন শেষ হচ্ছে কাল দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0066089630126953