শেখ কামাল : বহুমাত্রিক প্রতিভার স্পন্দন - দৈনিকশিক্ষা

শেখ কামাল : বহুমাত্রিক প্রতিভার স্পন্দন

দুলাল আচার্য |

আজ ৫ আগস্ট, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বড় ছেলে শেখ কামালের ৭৫তম জন্মদিন। ১৯৪৯ খ্রিষ্টাব্দের এই দিনে তিনি গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। অর্থাৎ ভারতবর্ষ ভাগ হওয়ার পর সদ্য পাকিস্তান রাষ্ট্রে শেখ কামালের জন্ম হয়। সেই অর্থে পাকিস্তান রাষ্ট্রে শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে বাঙালির স্বাধিকার সংগ্রামের পরিক্রমা আর শেখ কামালের বেড়ে ওঠা অনেকটাই সমান্তরাল। বাঙালির ইতিহাসের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সন্তান হিসেবে তিনি খুব কাছ থেকেই বাঙালি জাতির অধিকার আদায়ের আন্দোলন-সংগ্রাম প্রত্যক্ষ করেছেন।

বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী ছিলেন শেখ কামাল। ঢাকার শাহীন স্কুল থেকে মাধ্যমিক এবং ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগ থেকে বিএ (অনার্স) সম্পন্ন করেন। ১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ আগস্ট ঘাতকের হাতে নিহত হওয়ার আগে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের এমএ শেষ পর্বের পরীক্ষার্থী ছিলেন। নিহত হওয়ার পর তার পরীক্ষার ফল প্রকাশ হয়। ছিলেন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যও। ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান ও ১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে বীরোচিত ভূমিকা পালন করেন শেখ কামাল। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম ওয়ার কোর্সে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হয়ে মুক্তিবাহিনীতে কমিশনন্ড লাভ করেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি জেনারেল এমএজি ওসমানির এডিসি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

সংস্কৃতিকে তিনি রাজনীতির সমীকরণ ভাবতেন। তাই সাংস্কৃতিক রাজনীতির ওপর গুরুত্ব দিয়েছিলেন শেখ কামাল। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, রাজনৈতিক অবস্থার পরিবর্তন চাইলে রাজনীতির সংস্কৃতি বদলাতে হয়। রাজনীতির সংস্কৃতিকে টেকসই করার জন্য তিনি সমাজের বিভিন্ন স্তরে, বিভিন্ন অঙ্গনে পরিবর্তনের চেষ্টা করেছিলেন। তিনি ‘ছায়ানট’-এর সেতার বাদন বিভাগের ছাত্র ছিলেন। মঞ্চ নাটক আন্দোলনের ছিলেন প্রথমসারির সংগঠক। ছিলেন নাট্যচক্রের নাট্যজনও। সংস্কৃতিমনা বন্ধুদের নিয়ে গড়ে তুলেছিলেন ‘স্পন্দন শিল্পী গোষ্ঠী’। শেখ কামাল ছিলেন ‘ঢাকা থিয়েটার’-এর প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম। অভিনয় শিল্পী হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যাঙ্গনে ছিলেন ব্যাপক পরিচিত। ক্রীড়া ও সংস্কৃতিকে তিনি গ্রহণ করেছিলেন আত্মোপলব্ধির সোপান হিসেবে। শেখ কামাল খেলাধুলা ও সংস্কৃতি চর্চার পাশাপাশি বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে সংগঠিত বাঙালি জাতির অধিকার আদায়ের সংগ্রামে ছিলেন আত্মনিবেদিত। মাত্র ২৬ বছর বয়সেই সর্বক্ষেত্রে তিনি তার অসামান্য মেধা ও অসাধারণ কর্মকাণ্ডের উজ্জ্বল স্বাক্ষর রেখে গেছেন। লোভ-লালসা তাকে কখনো স্পর্শ করতে পারেনি। তিনি সবসময়ই ব্যক্তির চেয়ে প্রতিষ্ঠানের স্বার্থ সুরক্ষায় কাজ করে গেছেন।

বাংলাদেশের আধুনিক ক্রীড়াঙ্গনের রূপকার বলা হয় শেখ কামালকে। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে তরুণ সমাজকে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ে তোলার অগ্রণী সৈনিক হিসেবে সংগঠিত করার জন্য তিনি খেলাধুলা এবং সাংস্কৃতিক-সামাজিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলায় উদ্যোগী হন। ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠা করেন আবাহনী ক্রীড়াচক্র, যা আজকের আবাহনী ক্লাব। স্বাধীনতা-উত্তর যুব ও ক্রীড়া উন্নয়নে শেখ কামাল যে অনন্য অবদান রেখে গেছেন তার স্মরণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ক্রীড়া মন্ত্রণালয় বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, শেখ কামাল জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ পুরস্কার, শেখ কামালের নামে কক্সবাজারের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়াম নির্মাণ, বিভিন্ন জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে আন্তর্জাতিকমানের স্টেডিয়াম ও ক্রীড়া কমপ্লেক্স নির্মাণ এবং শেখ কামালের জীবনের ওপর বিভিন্ন গ্রন্থের প্রকাশ। এ ছাড়া, শেখ কামালের স্বপ্নবাস্তবায়নে বাংলাদেশের ফুটবলকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। 

শেখ কামাল ছিলেন তার প্রজন্মের অগ্রবর্তী পথপ্রদর্শক। ছিলেন তিনি দূরদর্শী ও গভীর চিন্তাবোধের অধিকারী। শেখ কামাল মুক্তিযুদ্ধে সম্মুখসমরে অংশ নিতে চেয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে জেনারেল ওসমানীর এডিসি নিয়োগ করা হলে, সন্মুখযুদ্ধে যেতে না পারার কষ্ট তার ছিলো। তবে এডিসি হিসেবে মুক্তিবাহিনীতে গেরিলা বাহিনীর সংগঠনে ও তাদের প্রশিক্ষণে অসামান্য দক্ষতার পরিচয় দিয়েছিলেন। সদ্য প্রয়াত প্রবীণ সাংবাদিক আবদুল গাফফার চৌধুরী তার এক স্মৃতিচারণে উল্লেখ করেছিলেন। ‘বাবা বঙ্গবন্ধুর মতোই শেখ কামালও ছিলেন একজন অত্যন্ত সাহসী মানুষ। ২৬ মার্চ ভোরে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার পরপরই তিনি তার মাকে লুকিয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে বাড়ি থেকে পালিয়ে যান। তার সাহসী চিন্তা-চেতনা, সাংগঠনিক দক্ষতা এবং বিচক্ষণতা তাকে যুদ্ধ পরবর্তী বাংলাদেশে তরুণ সমাজের কাছে এক অনুসরণীয় ব্যক্তিত্বে পরিণত করেছিল।’ 

রাষ্ট্র বা সরকারপ্রধানের সন্তান হয়েও অত্যন্ত সাদাসিধে জীবনযাপন করতেন শেখ কামাল। ক্ষমতার বিন্দুতে থেকেও তিনি ছিলেন নির্লোভ, নির্মোহ। তার সারল্যতার পরিচয় মেলে সেই শৈশবেই। বঙ্গবন্ধুর বয়ানেই এই সারল্যতা ফুটে উঠেছে। একবার জেল থেকে মুক্তি পেয়ে বঙ্গবন্ধু প্রায় দেড় মাস টুঙ্গিপাড়ার গ্রামের বাড়িতে ছিলেন। এ সময় শেখ কামালকে নিয়ে আবেগঘন একটি দিনের ঘটনা আত্মজীবনীর ২০৯ পৃষ্ঠায় এভাবে উল্লেখ করেছেন বঙ্গবন্ধু। ‘একদিন সকালে আমি ও রেণু বিছানায় বসে গল্প করছিলাম। হাচু ও কামাল নিচে খেলছিলো। হাচু মাঝে মাঝে খেলা ফেলে আমার কাছে আসে আর ‘আব্বা’ ‘আব্বা’ বলে ডাকে। কামাল চেয়ে থাকে। একসময় কামাল হাচিনাকে বলছে, ‘হাচু আপা, হাচু আপা, তোমার আব্বাকে আমি একটু আব্বা বলি। আমি আর রেণু দু’জনই শুনলাম। আস্তে আস্তে বিছানা থেকে উঠে যেয়ে ওকে কোলে নিয়ে বললাম, ‘আমি তো তোমারও আব্বা।’...কামাল আমার কাছে আসতে চাইতো না। আজ গলা ধরে পড়ে রইলো। বুঝতে পারলাম, এখন আর ও সহ্য করতে পারছে না। নিজের ছেলেও অনেকদিন না দেখলে ভুলে যায়!’ 

শেখ কামালকে নিয়ে বঙ্গবন্ধুর আবেগঘন উচ্চারণ। একবার গ্রেফতার অবস্থায় ফরিদপুর কারাগার থেকে জাতির পিতাকে গোপালগঞ্জে আনা হয়েছিল মামলার তারিখে। তখন গোপালগঞ্জ থানা ঘাটে গিয়ে বঙ্গবন্ধু দেখেন তাদের নৌকা। পিতা, স্ত্রী ও সন্তানরা এসেছেন। এ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘এক বছর পরে আজ ওদের সাথে আমার দেখা। হাচিনা আমার গলা ধরল আর ছাড়তে চায় না। কামাল আমার দিকে চেয়ে আছে। আমাকে চেনেও না আর বুঝতেও পারে না। আমি কে? কামালও আমার কাছে এখন আসে। হাচু ‘আব্বা’ বলে দেখে কামালও ‘আব্বা’ বলতে শুরু করেছে।’

কারাগারের রোজনামচা বইয়ের ১৫৯ পৃষ্ঠায় শেখ কামালের প্রসঙ্গ উল্লেখ রয়েছে। ১৯৬৬ খ্রিষ্টাব্দের ১২ জুলাই বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কারাগারে দেখা করতে গেলে কামালের পড়াশোনা নিয়ে কথা হয়। বিষয়টি বঙ্গবন্ধু উল্লেখ করেছেন এভাবে, ‘রেণু বলল, কামাল খুব লেখাপড়া আরম্ভ করেছে। আগামীবারে মেট্রিক পরীক্ষা দেবে। সকলকে মন দিয়ে পড়তে বলে বিদায় নিলাম।’ পরের বছর কামালের মেট্রিক পরীক্ষার সময়কালে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘৬ এপ্রিল (১৯৬৭) থেকে আমার বড় ছেলে মেট্রিক পরীক্ষা দেবে। কোনো খবর পাই নাই কেমন পরীক্ষা দিলো।’ পরে আবার লিখেন, ‘কামাল এসেছিলো। বলল পরীক্ষা ভালো দিয়েছে। এই খবরটার জন্য ব্যস্ত ছিলাম।’

শেখ কামাল বর্তমান প্রজন্মের কাছে এক অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব হলেও স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি ও দেশবিরোধী চক্র জাতির পিতার পরিবার নিয়ে গোয়েবলসীয় কায়দায় বারবার মিথ্যাচার করে জনমানসে এক ভ্রান্ত প্রতিচিত্র আঁকার  চেষ্টা করেছিলো। কিন্তু সময়ের পথ ধরে ইতিহাসের প্রকৃত সত্য আজ প্রতিষ্ঠিত। কালো মেঘ ক্ষণিকের জন্য বাধাগ্রস্ত করলেও যেমন সূর্যোদয় রুখতে পারে না, ঠিক তেমনি সত্য আজ তার নিজস্ব শক্তি নিয়েই সব বাধা ডিঙিয়ে উদ্ভাসিত।

শেখ কামাল অফুরন্ত প্রাণশক্তির অধিকারী ছিলেন। বিরামহীনভাবে ছুটে চলা এ উদ্দীপ্ত কর্মনিষ্ঠ প্রাণের স্পন্দনকে চিরতরে স্তব্ধ করে দেয় খুনি ঘাতকচক্র। ১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনের জন্য প্রস্তুতিতেও ছিলেন শেখ কামাল। ১৪ আগস্ট রাত ১০টা পর্যন্ত ক্যাম্পাসে ছিলেন কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ নেতাদের সঙ্গে। খুনি ঘাতকচক্র শেখ কামালকে হত্যার মধ্য দিয়ে শুধু এক প্রতিশ্রুতিশীল তারুণ্য বা যুব অহংকারকেই হত্যা করেনি, হত্যা করেছিলো ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের এক সম্ভাবনাময় নেতৃত্বকে। ঘাতকরা তাকে নির্মমভাবে হত্যা করলেও স্বাধীন বাংলাদেশের উদ্দীপ্ত তারুণ্যের অগ্রদূত এবং ক্রীড়া-সাংস্কৃতিক অঙ্গনের অন্যতম পথিকৃত, বহুমাত্রিক গুণে-গুণান্বিত এই অসাধারণ ব্যক্তিত্ব, বাঙালির চিন্তা-চেতনায় ও জাতির ইতিহাসে চিরভাস্বর হয়ে থাকবেন। প্রজন্মের অহংকার শেখ কামাল, জন্মদিনে সশস্ত্র শ্রদ্ধা।

লেখক: সহকারী সম্পাদক, প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ (পিআইবি)

 

‘২৬ লাখ টাকা’র প্রধান শিক্ষক নাজমার শাস্তি দাবি আনন্দময়ী স্কুল ছাত্রীদের - dainik shiksha ‘২৬ লাখ টাকা’র প্রধান শিক্ষক নাজমার শাস্তি দাবি আনন্দময়ী স্কুল ছাত্রীদের জানুয়ারিতেই শিক্ষার্থীদের হাতে বই তুলে দেয়া হবে: গণশিক্ষা উপদেষ্টা - dainik shiksha জানুয়ারিতেই শিক্ষার্থীদের হাতে বই তুলে দেয়া হবে: গণশিক্ষা উপদেষ্টা ইএফটিতে বেতন: ব্যাংক হিসাব নিয়ে এমপিও শিক্ষকদের অসন্তোষ - dainik shiksha ইএফটিতে বেতন: ব্যাংক হিসাব নিয়ে এমপিও শিক্ষকদের অসন্তোষ পবিপ্রবিতে গাঁজাসহ ৫ মাদকসেবী আটক - dainik shiksha পবিপ্রবিতে গাঁজাসহ ৫ মাদকসেবী আটক ভর্তিতে লটারি বাতিলের দাবিতে সড়ক আটকে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ - dainik shiksha ভর্তিতে লটারি বাতিলের দাবিতে সড়ক আটকে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ প্রাথমিকের ১০ম গ্রেডের দাবি সর্বজনীন - dainik shiksha প্রাথমিকের ১০ম গ্রেডের দাবি সর্বজনীন কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক - dainik shiksha কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক ৬ষ্ঠ ও ৮ম শ্রেণির বাদপড়া শিক্ষার্থীদের রেজিস্ট্রেশনের সুযোগ - dainik shiksha ৬ষ্ঠ ও ৮ম শ্রেণির বাদপড়া শিক্ষার্থীদের রেজিস্ট্রেশনের সুযোগ দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0030078887939453