আধুনিক বাংলাদেশের সংস্কৃতিচর্চার অগ্রণী ব্যক্তিত্ব সন্জীদা খাতুন আজ নব্বই পূর্ণ করলেন। বাংলাদেশের জন্ম যে সংস্কৃতির আঁতুরঘরে, সেই বাঙালি সংস্কৃতির লালন ও পালনে তিনি অন্যতম দিশারি। ষাটের দশকে রবীন্দ্রসংগীতের ওপর রাষ্ট্রীয় হুমকি মোকাবিলার আয়োজন থেকে তাঁর উদয়। এখনও তিনি বাঙালি সংস্কৃতিতে পালন করছেন ধাত্রীর ভূমিকা। বাঙালির আত্ম অনুসন্ধান ও বাঙালি সংস্কৃতির বিকাশের জন্য নিরন্তর সংগ্রামে তাঁর অবদান জাতি মনে রাখে।
শুধু ছায়ানট নয়, সন্জীদা খাতুন সুদীর্ঘ যাত্রাপথে জাতীয় রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদ, ব্রতচারী সমিতি, নালন্দা বিদ্যালয় বা কণ্ঠশীলনের মতো সংগঠনের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। শিল্পী কামরুল হাসানের নেতৃত্বে ব্রতচারী আন্দোলনে যোগ দিয়েছেন। মুকুল ফৌজেও কাজ করেছেন। ১৯৬১ খ্রিষ্টাব্দে রবীন্দ্র জন্মশতবর্ষ উদযাপনের মধ্য দিয়ে বাঙালির সাংস্কৃতিক অধিকার আদায়ের যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল, তিনি ছিলেন তাঁর অন্যতম ভূমিকায়। ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ এবং তারপর দেশে নানা উত্থান-পতনের মধ্যে সব প্রগতিশীল ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সামনে ছিলেন তিনি।
এই বরেণ্য সংস্কৃতি সাধক, রবীন্দ্র গবেষক ও রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী ১৯৩৩ খ্রিষ্টাব্দের এই দিনে ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন। জাতীয় অধ্যাপক কাজী মোতাহার হোসেনের কন্যা তিনি। মায়ের নাম সাজেদা খাতুন। ছায়ানটের তিনি সভাপতি। এ ছাড়া অধ্যাপনা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। একাধারে রবীন্দ্র-নজরুল গবেষক, রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী, লেখক, সংগঠক ও শিক্ষাব্রতী সন্জীদা খাতুন।
তাঁর এই বিপুল কর্মময় জীবন বাঙালির মানস ও সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করেছে। সে কারণে আজ তাঁর জন্মদিন বিশেষভাবে উদযাপিত হবে ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে।
সন্জীদা খাতুন ১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতক এবং ১৯৫৫ খ্রিষ্টাব্দে ভারতের বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। পরে ১৯৭৮ খ্রিষ্টাব্দে একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘রবীন্দ্রসংগীতের ভাবসম্পদ’ গবেষণাপত্রে পিএইচডি ডিগ্রি নেন তিনি। তার পিএইচডি-উত্তর গবেষণা ‘ধ্বনি থেকে কবিতা’। স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জনের পর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৯৪ খ্রিষ্টাব্দে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা থেকে অবসর নেন।
১৯৬১ খ্রিষ্টাব্দে পাকিস্তানের সামরিক শাসনামলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন এবং রবীন্দ্রসংগীত নিষিদ্ধ করার প্রতিবাদের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতিসত্তা বিকাশের আন্দোলনের সূচনা হয়। সেই আন্দোলনের শুরু থেকেই নেতৃত্বের ভূমিকায় ছিলেন সন্জীদা খাতুন। তিনি ছায়ানটের সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন ২০০১ সাল থেকে।
কর্মময় জীবনের স্বীকৃতিস্বরূপ সন্জীদা খাতুন অর্জন করেছেন একুশে পদক, বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার, বেগম জেবুন্নেছা ও কাজী মাহবুবউল্লাহ জনকল্যাণ ট্রাস্টের স্বর্ণপদক ও সম্মাননা, সা’দত আলী আখন্দ পুরস্কার, অনন্যা পুরস্কার, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটির সম্মানজনক ফেলোশিপ, বাংলা একাডেমির রবীন্দ্র পুরস্কারসহ নানা গুরুত্বপূর্ণ স্বীকৃতি। তাঁর কীর্তি স্পর্শ করেছে ওপার বাংলাকেও। বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় সন্জীদা খাতুনকে তাদের সর্বোচ্চ সম্মান ‘দেশিকোত্তম’ উপাধি দিয়েছে। এ ছাড়া তিনি পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের ‘রবীন্দ্রস্মৃতি পুরস্কার’, কলকাতার টেগোর রিসার্চ ইনস্টিটিউট থেকে ‘রবীন্দ্রতত্ত্বাচার্য’ উপাধি পেয়েছেন।
লেখক ও সম্পাদক হিসেবেও অত্যন্ত সফল সন্জীদা খাতুন। তাঁর প্রকাশিত উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে– কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, রবীন্দ্রসংগীতের ভাবসম্পদ, ধ্বনি থেকে কবিতা, অতীত দিনের স্মৃতি, রবীন্দ্রনাথ: বিবিধ সন্ধান, ধ্বনির কথা আবৃত্তির কথা, স্বাধীনতার অভিযাত্রা, সাহিত্য কথা সংস্কৃতি কথা, জননী জন্মভূমি, রবীন্দ্রনাথ এবং রবীন্দ্রনাথ। তিনি ছায়ানটের ত্রৈমাসিক পত্রিকা ‘বাংলাদেশের হৃদয় হতে’র সম্পাদক। এ ছাড়া তিনি জাতীয় রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য, নালন্দা বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ও বাংলাদেশে ব্রতচারী আন্দোলনের নবযাত্রায় ব্রতচারী সমিতির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি।
জন্মদিন উদযাপন ধানমন্ডির ছায়ানট সংস্কৃতি ভবনে সকাল ১০টায় আনন্দ-আয়োজন শুরু হবে বলে জানিয়েছে ছায়ানট। আয়োজনে তাঁর নির্বাচিত প্রিয় সুর–বাণী–ছন্দের পরিবেশনা থাকবে। এছাড়া সন্জীদা খাতুনের বর্ণিল জীবনের বর্ণাঢ্য ৯ দশক পূর্তির মাহেন্দ্রক্ষণে ‘ঐতিহ্য’ দুই খণ্ডে প্রকাশ করেছে তাঁর রবীন্দ্রবিষয়ক বিপুল রচনার সংকলন ‘আমার রবীন্দ্রনাথ’। গ্রন্থ দুটির প্রচ্ছদ করেছেন শিল্পী ধ্রুব এষ। সন্জীদা খাতুন ৪০টির বেশি বই লিখেছেন।