আজ ৫ ডিসেম্বর ‘বিশ্ব মৃত্তিকা দিবস’। মাটি সম্পদের গুরুত্ব বোঝাতে ও সচেতনতা তৈরিতে International Union of soil science ২০০২ খ্রিষ্টাব্দের ৫ ডিসেম্বর থেকে আন্তর্জাতিকভাবে বিশ্ব মৃত্তিকা দিবস পালন করে আসছে। মাটির গুরুত্ব অনুধাবন করে পরবর্তীতে জাতিসংঘ ২০১৩ খ্রিষ্টাব্দের ৫ ডিসেম্বরকে ‘বিশ্ব মৃত্তিকা দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করে। ভূ-পৃষ্ঠের ওপরের নরম আবরণকেই সাধারণত মাটি বলা হয়। এটি পৃথিবীর ভূত্বকের কঠিন-নরম দানাদার আবরণ। জলবায়ু ও জৈব পদার্থের সমন্বয়ে রূপান্তরিত শিলার ওপর গাছ জন্মানোর উপযোগী পরিবেশ তৈরি হয় মাটিতে।
এই মাটিই উদ্ভিদ ও প্রাণিকুলের জীবনধারনের একমাত্র অবলম্বন। মাটির মধ্যে চারটি উপাদান বিদ্যমান: অজৈব বা খনিজ উপাদান (৪৫ শতাংশ), বায়ু (২৫ শতাংশ), পানি (২৫ শতাংশ) এবং জৈব পদার্থ (৫ শতাংশ)। মাটির উপাদানগুলোর মধ্যে সবসময় বিভিন্ন ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া চলতে থাকে। মাটিতে জৈব পদার্থের পরিমাণ মাত্র ৫ ভাগ হলেও এই জৈব পদার্থ খুব গুরুত্বপূর্ণ। জৈব পদার্থ মূলত উদ্ভিদ ও প্রাণীজ উপাদান থেকেই গঠিত। মাটির নাইট্রোজেনের উৎস হচ্ছে এই পদার্থ। যদিও মাটিতে কোনো বিষাক্ত পদার্থ থাকলে নাইট্রোজেন তা দূর করে থাকে। মাটির উৎকর্ষ বা গুণগত মান ঠিক রাখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
মাটির উপাদান ঠিক না থাকলে মাটির গুণগতমানও ঠিক থাকে না। তথ্য মতে, পৃথিবীর ১০ ভাগেরও কম ভূমি চাষাবাদের অন্তর্গত। বাংলাদেশে মোট জমির প্রায় ৫২ ভাগ এলাকায় চাষাবাদ করা হয়। এই অল্প পরিমাণ ভূমিও আমরা পরিকল্পিত ব্যবহার ও চাষাবাদ করতে পারছি না। বিভিন্নভাবে মাটির দূষণ ঘটছে, মাটির ক্ষয় হচ্ছে। পরিকল্পিত ব্যবহারের মাধ্যমে মাটি সংরক্ষণ করতে না পারলে সেই মাটি থেকে সুফল পাওয়া যায় না। শুধু প্রাকৃতিক কারণে শিলা-খনিজের চূর্ণবিচূর্ণ হওয়ায় মাটি ক্ষয় নয়, মাটির উর্বরতা শক্তি নষ্টও এক ধরনের মাটি ক্ষয়। প্রাকৃতিকভাবে মাটি ক্ষয় সাধারণত দুভাবে হয়ে থাকে। ১. স্বাভাবিক বা ভূতাত্ত্বিক মাটি ক্ষয় ২. ত্বরান্বিত মাটি বা ভূমি ক্ষয়। এ ছাড়া মানুষের নানাবিধ কর্মকাণ্ডের ফলে ব্যাপকভাবে মাটি ক্ষয় হচ্ছে। সজীব ও অজীব দুষক দ্বারা মাটির নানাভাবে দূষণ ঘটছে। জীব সংক্রান্ত দূষণ, পরিপোষক দূষণ, অজৈব পদার্থজনিত দূষণ, জৈব পদার্থজনিত দূষণ, অ্যাসিড দূষণ, প্লাস্টিক-পলিথিন দূষণ, তেজস্ক্রিয় দূষণ, বর্জ্যরে দূষণ, কীটনাশক দূষণ ইত্যাদি। শিল্পকারখানার কঠিন বর্জ্যরে কারণে মাটি ব্যাপকভাবে দূষিত হয়ে থাকে।
মাটির ওপরই পৃথিবী নামক ছোট্ট গ্রহে মানুষের বসবাস। মাটির ওপরই দাঁড়িয়ে আছে আকাশচুম্বী পাহাড়-পর্বত, দিগন্ত বিস্তৃত সবুজ ক্ষেত্র, নদীর স্রোতধারা, সর্বোপরি সবকিছু। একদিক দিয়ে চিন্তা করলে মানুষ মাটিরই সন্তান। মাটির ওপরই মানুষের জীবন-জীবিকা। আবার জীবনলীলা সাঙ্গ শেষে এই মাটির বুকে চিরকালের আশ্রয়। মাটির ওপর কতো অত্যাচার করা হয়, ক্ষতবিক্ষত করা হয় মাটির দেহ। তবু মাটি কোনো প্রতিবাদ করে না। সবকিছু নীরবে সয়ে যায়। যদিও এই মাটিকে নিয়ে আমরা মোটেও চিন্তা করি না। অন্যসব দূষণ নিয়ে চিন্তা করলেও মাটি দূষণ নিয়ে খুব একটা আলোচনা করা হয় না।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে উপকূলীয় অঞ্চলে লবণাক্ততার প্রভাব, অতিরিক্ত জনসংখ্যা বৃদ্ধির প্রভাব, জমিতে অতিরিক্ত রাসায়নিক সারের প্রয়োগ, নানাবিধ দূষণ, কৃষির অপরিকল্পিত নিবিড়করণ, উচ্চফলনশীল নানা শস্যের চাষ বৃদ্ধি ইত্যাদি কারণে মাটি দূষণ ঘটছে ও মাটির উর্বরতা শক্তি কমে যাচ্ছে।
বৈশ্বিক উষ্ণতা ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে মানবসভ্যতা আজ নানাবিধ সমস্যার সম্মুখীন। মানুষের নানা কর্মকাণ্ডেই মাটি বিষাক্ত ও অনুর্বর হয়ে পড়ায় তা মানব সভ্যতার জন্য হুমকি তৈরি করছে। আমাদের মৌলিক চাহিদার প্রতিটি উপাদানই কোনো না কোনোভাবে মাটির সঙ্গে যুক্ত। প্রায় ৯৬ ভাগ খাদ্যই মাটি থেকে পাওয়া য়ায়। এক তথ্য মতে, পৃথিবীতে বছরে প্রায় সোয়া কোটি হেক্টর জমির অবক্ষয় হচ্ছে। এর ফলে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের প্রায় এক চর্তুথাংশ মানুষ মাটি অবক্ষয়জনিত কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। মাটির গুরুত্ব বলে শেষ করা যাবে না। মাটি পরিবেশের অন্যতম উপাদান এবং প্রাণী, উদ্ভিদ ও অণুজীবের মূল ভিত্তি। মাটি জীববৈচিত্র্যের আধার, পানি বিশোধনকারী ও জমাকারী। মাটি খাদ্য তৈরির মূল ভিত্তি ও উদ্ভিদের পুষ্টির যোগানদাতা। মাটি কার্বন গ্রহণকারী ও জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অবস্থা উপশমে সাহায্যকারী। সর্বোপরি মাটি সম্ভাবনার ভান্ডার ও মাটির বুকে সমগ্র প্রাণিকুলের বসবাস।
পৃথিবীর জনসংখ্যা বাড়ছে। তাই মাটির অবক্ষয় ও মাটি দূষণ রোধে এখনই ব্যবস্থা না নিলে তা সমগ্র মানবজাতির জন্য ভয়াবহ বিপদ ডেকে আনবে। বাংলাদেশের মাটিও ভালো নেই। বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি হলো কৃষি। মাটির অতিরিক্ত ব্যবহার, দূষণ, লবণাক্ততার প্রভাব, অপরিকল্পিত শস্য আবর্তনসহ বিভিন্ন কারণে জমির উর্বরতা শক্তি কমে যাচ্ছে। এক তথ্য মতে, লবণাক্ততার কারণে ১৮ জেলার ৯৩ উপজেলার ১০ লাখ ৫৬ হাজার হেক্টর কৃষিজমির মাটি কমবেশি দূষিত হয়ে পড়েছে। জৈব উপাদানের ঘাটতি ধরা পড়েছে প্রায় ৫২ লাখ হেক্টর কৃষিজমিতে। প্রতিবছর জমিতে রাসায়নিক সারের ব্যবহার বাড়ছে বিপরীতভাবে একটু একটু করে কৃষি জমির পরিমাণ কমছে। জমির জৈব পদার্থই মাটির প্রাণ। এটি গাছের পুষ্টি ধরে রাখা, পানি ধারণক্ষমতা বৃদ্ধি, বায়ু চলাচল বৃদ্ধি ও মাটির নিবিড়তা বৃদ্ধি করে। জলবায়ু পরিবর্তনের বিপদ সার্বিক মাটি ব্যবস্থাপনার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে মাটিতে জৈব সার রিসাইক্লিং হচ্ছে না।
অনেক সময় দেখা যায়, কৃষিজমিতে অনুমাননির্ভরভাবে সার প্রয়োগ করা হয়। যার ফলে অতিরিক্ত সার প্রয়োগের ফলে জমির উর্বরতা শক্তি নষ্ট হয়ে যায়। অতিরিক্ত সার ও কীটনাশকের প্রয়োগ পরিবেশ বিপর্যয় ত্বরান্বিত করে থাকে। তাই প্রকৃতি বুঝে জমির উর্বরতা রক্ষায় কৃষককে আরো সচেতন হতে হবে। কৃষি কর্মকাণ্ড যেনো মাটি, পানি ও ফসলের বাস্তুতন্ত্রকে নষ্ট না করে সেদিকে সংশ্লিষ্ট সবাইকে নজর দিতে হবে। ইটভাটায় ইট তৈরিসহ বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজে মাটির ওপরের স্তর নষ্ট করা হচ্ছে। জুম চাষ ও মাটি কাটার কারণে ভূমিধস হচ্ছে। অপরিকল্পিত নগরায়ণের কারণে মাটির স্বাস্থ্যহানি ঘটছে। বিভিন্ন কারণে মাটির গুণগত মান নষ্ট হওয়ার কারণে মাটিতে নাইট্রোজেন, ফসফরাস, পটাসিয়াম, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ, সালফার, বোরন ইত্যাদি পদার্থ সঠিক মাত্রায় পাওয়া যাচ্ছে না। উপকূলীয় মাটিতে লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে ফসল উৎপাদন কষ্টসাধ্য, ব্যয় সাপেক্ষ ও কোনো কোনো ক্ষেত্রে অসম্ভব হয়ে পড়ছে। পরিস্থিতি বিবেচনায় জাতিসংঘ মাটিদূষণকে ‘গুপ্ত ঘাতক’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। মাটির দূষণ ও ক্ষয় বাড়তে থাকলে তা সার্বিক পরিবেশের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। তাই খাদ্য ও পানি নিরাপত্তার সঙ্গে মাটির নিরাপত্তাকেও সমান গুরুত্ব দিতে হবে।
বায়ুদূষণ ও পানি দূষণের থেকে ভয়াবহ হচ্ছে মাটিদূষণ। কঠিন বর্জ্য মাটি দূষণের প্রধানতম কারণগুলোর একটি। প্রধানত তিনটি উপায়ে মাটি দূষণ রোধ করা সম্ভব। ১. আইনের যথাযথ প্রয়োগ করে ২. প্রযুক্তিগত উপায়ে ৩. ব্যক্তিগত উপায়ে। আইন প্রয়োগের মাধ্যমে প্লাস্টিক-পলিথিনসহ কঠিন বর্জ্যরে ব্যবহার কমানো সম্ভব। প্রযুক্তিগত উপায়ে কঠিন বর্জ্য পদার্থ সংগ্রহ করে তা রিসাইক্লিং বা প্রক্রিয়াজাত করে মাটির দূষণ যেমন রোধ করা সম্ভব তেমনি রিসাইক্লিংয়ের মাধ্যমে সার, বিদ্যুৎসহ বিভিন্ন জিনিস তৈরি করার মাধ্যমে বর্জ্য সম্পদে পরিণত করা সম্পদ।
শহরগুলোতে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা উন্নত করার মাধ্যমে দূষণ রোধ করা সম্ভব। অবিশ্লেষ্য পদার্থ যেমন পলিথিন ও প্লাস্টিক ব্যবহার কমানোর পাশাপাশি এর রিসাইক্লিং প্রায় প্রতিটি দেশে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হচ্ছে। উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশসমূহে বিভিন্ন ধরনের বর্জ্যকে সম্পদে পরিণত করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে বহু আগে থেকেই। বিশ্বে প্লাস্টিক ও পলিথিন জাতীয় দ্রব্যের সর্ব্বোচ ব্যবহার করে অতঃপর রিসাইক্লিং করা হয়। বাংলাদেশের যশোরে শহরের বর্জ্য বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে ভাগ করে তারপর তা থেকে জৈবসার, বায়োগ্যাস ও বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে।
এ ছাড়া বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় বর্জ্য সম্পদে পরিণত করা এবং প্লাস্টিক-পলিথিন রিসাইক্লিং প্রক্রিয়া ক্ষুদ্র পরিসরে দেখা যাচ্ছে। তবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে এ ব্যাপারে এগিয়ে আসতে হবে। দূষণ রোধ করে বর্জ্য, প্লাস্টিক-পলিথিন সম্পদে পরিণত করার প্রয়াসকে এগিয়ে নিতে হবে। তাহলে মাটি দূষণসহ সব ধরনের দূষণ রোধ করা সম্ভব হবে।
লেখক: শিক্ষক