পরিকল্পনার মধ্যেই রয়েছে অনিয়ম। সম্ভাব্য সমীক্ষা ছাড়াই নেওয়া হয়েছে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকার প্রকল্প। ফলে বাস্তবায়ন পর্যায়ে দেখা দিয়েছে নানা জটিলতা।
এমনকি কোথায়ও কোথাও নকশা পরিবর্তনও করতে হয়েছে। ফলে প্রকল্পটি বাস্তবায়নে বিরাজ করছে ধীরগতি। চার বছর পেরিয়ে গেলেও বাস্তব অগ্রগতি দাঁড়িয়েছে ৪৫ শতাংশ এবং আর্থিক অগ্রগতি আরও কম, অর্থাৎ ২৪ দশমিক ৫৪ শতাংশ। সেই সঙ্গে বর্ধিত মেয়াদেও বাস্তবায়ন হবে কিনা তা নিয়ে দেখা দিয়েছে শঙ্কা। রোববার (১৮ জুন) দৈনিক যুগান্তর পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়। প্রতিবেদনটি লিখেছেন হামিজ-উজ-জামান।
প্রতিবেদনে আরও জানা যায় ‘কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরাধীন ৬৪টি টেকনিক্যাল স্কুল ও কলেজের সক্ষমতা বৃদ্ধি’ প্রকল্পে পাওয়া গেছে এমন চিত্র। সম্প্রতি প্রকল্পটির নিবিড় পরিবীক্ষণ করেছে বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি)।
সংস্থাটির খসড়া প্রতিবেদনে বলা হয়, সরকারি খাতে উন্নয়ন প্রকল্প প্রণয়ন, প্রক্রিয়াকরণ, অনুমোদন ও সংশোধন পদ্ধতি, অক্টোবর ২০১৬-এর অনুচ্ছেদ ৪ দশমিক ১ অনুযায়ী এটি নিয়মবহির্ভূত কাজ। কেননা ওই অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ২৫ কোটি টাকার ঊর্ধ্বে প্রাক্কলিত ব্যয় সম্পন্ন বিনিয়োগ প্রকল্প গ্রহণের পূর্বে আবশ্যিকভাবে সম্ভাব্যতা সমীক্ষা করতে হবে। সেই সঙ্গে সরকারি খাতে উন্নয়ন প্রকল্প প্রণয়ন, প্রক্রিয়াকরণ, অনুমোদন ও সংশোধন নির্দেশিকা-জুন, ২০২২ অনুযায়ী চলমান প্রকল্পের সম্ভাব্যতা সমীক্ষা বা বেজলাইন সার্ভে সম্পন্ন করা হয়নি।
এসব না করায় তিনটি ৫ তলা ভবন এবং ১১টি সাত তলা ভবনের পৃথক ভূমির মান অনুযায়ী ডিজাইন পরিবর্তনের প্রয়োজন হয়েছে। এর ফলে প্রকল্প বাস্তবায়নে ধীর গতির সৃষ্টি হয় এক্ষেত্রে সময় বাঁচানোর জন্য প্রাক সম্ভাব্যতা সমীক্ষা করা না হলেও বাস্তব ক্ষেত্রে সময় আরও বেশি লাগছে।
এ কারণে প্রকল্প শুরুর চার বছর পরেও নানা জটিলতায় গত এপ্রিল মাস পর্যন্ত অগ্রগতি দাঁড়িয়েছে মাত্র ৪৫ শতাংশে।
আইএমইডির সচিব আবুল কাশেম মো. মহিউদ্দিন বলেন, এ বছর মূল্যায়ন করা প্রতিবেদনগুলো সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের পাঠিয়েই দায়িত্ব শেষ করা হবে না। এসবের মধ্যে যেসব ত্রুটি-বিচ্যুতি আছে সেগুলো সংশোধনের জন্য আলাদা চিঠি দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। প্রতিবেদন চূড়ান্ত হলেই সেটি করা হবে।
সাবেক পরিকল্পনা সচিব মামুন-আল-রশীদ শনিবার বলেন, এটা অবশ্যই একটি অনিয়ম। কেননা দ্রুত প্রকল্প পাশ করিয়ে নেওয়ার মানসিকতা থেকেই তড়িঘড়ি করে এসব কাজ করা হয়। সমীক্ষা ছাড়া প্রকল্প অনুমোদনের ক্ষেত্রে পরিকল্পনা কমিশন যেমন দায়ী, তেমনি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ও দায়ী। এ রকম ক্ষেত্রে উভয় পক্ষকেই জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে।
এছাড়া কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরের প্রচুর ইঞ্জিনিয়ার আছে। তারা নিজেরাই নিজেদের সম্পদ দিয়ে সমীক্ষা করতে পারত। এটা এক ধরনের অবহেলা। সময়মতো প্রকল্পট শেষ না হওয়ায় বর্তমান পরিস্থিতিতে প্রকল্পে ব্যয় বৃদ্ধির আশঙ্কা আছে।
সূত্র জানায়, এর আাগে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে যেসব সমস্যা খুঁজে পেয়েছে আইএমইডির মধ্যে সম্ভাব্যতা সমীক্ষা না করাটা ছিল অন্যতম। সংস্থাটির পক্ষ থেকে বলা হয়, প্রকল্প বাস্তবায়নে বিলম্বিত হওয়ার বেশ কিছু কারণ দীর্ঘদিন ধরেই বিরাজমান। যেমন সম্ভাব্যতা যাচাই ছাড়াই প্রকল্প গ্রহণ এবং প্রকল্প তৈরিতেই দুর্বলতা ও দক্ষতার অভাব অন্যতম।
এছাড়া যেনেতেনভাবে প্রকল্প তৈরি, বাস্তবায়ন পর্যায়ে কার্যকর তদারকির অভাব, নিয়মিত ও কার্যকরভাবে পিআইসি (প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি) এবং পিএসসি (প্রজেক্ট স্টিয়ারিং কমিটি) বৈঠক না হওয়া। সেই সঙ্গে জমি অধিগ্রহণে জটিলতা, দরপত্র প্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রতা, বৈদেশিক সহায়তাপুষ্ট প্রকল্পে উন্নয়নসহযোগীদের সময়ক্ষেপণও দায়ী।
পাশাপাশি রয়েছে প্রয়োজনীয় অর্থছাড় না হওয়া, প্রকল্প পরিচালকদের অদক্ষতা, ঘন ঘন প্রকল্প পরিচালক বদলি ইত্যাদি।
কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরাধীন ৬৪টি টেকনিক্যাল স্কুল ও কলেজের সক্ষমতা বৃদ্ধি প্রকল্প সম্পর্কে আইএমইডির নিবিড় পরিবীক্ষণ সমীক্ষার খসড়ায় বিভিন্ন মতামত দেওয়া হয়। এগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো, প্রকল্পের উদ্দেশ্য অর্জন নির্ভর করে নির্ধারিত কার্যক্রমের ফলাফলের ওপর। কিন্তু এ প্রকল্পের কাঙ্ক্ষিত অগ্রগতি লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কম।
প্রকল্পের ক্রমপুঞ্জিত (শুরু থেকে এখন পর্যন্ত) অগ্রগতি অনেক কম। এছাড়া চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে প্রকল্পের অনুকূলে মোট বরাদ্দ আছে ২৫০ কোটি টাকা। এপ্রিল মাস পর্যন্ত খরচ হয়েছে ১০০ কোটি টাকা, যা বরাদ্দের মাত্র ৪০ ভাগ। বর্তমানে বাকি ৬০ ভাগ অর্থের ব্যয় সম্ভব হবে কিনা সন্দেহ রয়েছে।
প্রকল্পটির দুর্বল দিক সম্পর্কে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের মাঠ পর্যায়ে জনবলের ঘাটতি রয়েছে। ফলে সুষ্ঠু মনিটরিং নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে না। এছাড়া প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক ও কর্মচারীদের অভাব প্রকট। প্রকল্পের প্রাক সম্ভাব্যতা সমীক্ষা করা হয়নি।
প্রকল্প দলিলে প্রকল্পের টেকসইকরণ নিয়ে কোনো দিকনির্দেশনা নেই। বিদ্যমান জায়গায় ভবন নির্মাণের ফলে খেলার মাঠ সংকুচিত হয়েছে।
এছাড়া প্রকল্প শুরুর পর এখন পর্যন্ত কোনো অডিট হয়নি। প্রকল্পের বাস্তব ও আর্থিক অগ্রগতি সন্তোষজনক নয়। ভবন নির্মাণের আগেই আসবাবপত্র ও যন্ত্রপাতি কেনায় সেগুলো সংরক্ষণের সমস্যা তৈরি হয়েছে। প্রকল্পটির ঝুঁকি সম্পর্কে প্রতিবেদনে বলা হয়, কাঙ্ক্ষিত অগ্রগতি না হওয়ায় নির্ধারিত সময়ে প্রকল্প সমাপ্তি এবং প্রকল্পের উদ্দেশ্য ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
সঠিক তদারকির অভাবে নির্মাণ কাজের গুণগতমান সংরক্ষণে ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। টেকসইকরণ পরিকল্পনার অভাবে প্রকল্প বাস্তবায়ন পরবর্তী পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণের ঝুঁকি তৈরি হয়েছে।
এসব বিষয়ে জানতে কারিগরি ও মাদরাসা শিক্ষা বিভাগের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি পরিচয় জানার পরই বলেন এখন কথা বলতে পারবে না। পরে কথা বলব।
সূত্র জানায়, ‘কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরাধীন ৬৪টি টেকনিক্যাল স্কুল ও কলেজের সক্ষমতা বৃদ্ধি’ প্রকল্পটির মোট ব্যয় ধরা হয়েছিল ১ হাজার ৪৯৩ কোটি ৬৫ লাখ টাকা। পরবর্তীতে প্রথম সংশোধনীর মাধ্যমে ৯৭ কোটি ৯৫ লাখ টাকা কমিয়ে ব্যয় ধরা হয়েছে ১ হাজার ৩৯৫ কোটি ৬৯ লাখ টাকা।
এদিকে বাস্তবায়নের মেয়াদ ধরা হয়েছিল ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত। পরবর্তী সময়ে ব্যয় বৃদ্ধি ছাড়া এক বছর মেয়াদ বাড়িয়ে ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত করা হয়। এতেও কাজ শেষ না হলে প্রথম সংশোধনীতে তিন বছর বাড়িয়ে ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত মেয়াদ করা হয়েছে।