কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সংঘর্ষে দেশের চলমান পরিস্থিতিতে সরকারকে পদত্যাগের আহ্বান জানিয়েছেন বিশিষ্ট গবেষক ও চিন্তাবিদ অধ্যাপক ড. সলিমুল্লাহ খান। তিনি বলেছেন, ‘এখন যেটা দরকার, পুরনো কথাকে ধার করেই বলি—রাজনৈতিক সমাধান। আর রাজনৈতিক সমাধানের প্রথম পদক্ষেপ হচ্ছে বর্তমান সরকারকে নিঃশর্তভাবে ক্ষমা প্রার্থনা করে পদত্যাগ করতে হবে। এছাড়া নতুন কোনো ধরনের ব্যবস্থায় আমরা যেতে পারব না।’
আটক শিক্ষার্থীদের মুক্তি, মামলা প্রত্যাহার এবং শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিতের দাবিতে গতকাল ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশের (ইউল্যাব) শিক্ষকদের সংহতি সমাবেশে সলিমুল্লাহ খান এ আহ্বান জানান।
আন্দোলনে নিহতদের বিষয়ে ড. সলিমুল্লাহ খান বলেন, ‘গুলিতে যারা মারা গেছেন তারা আমাদের পথপ্রদর্শক। আমরাও মারা যেতে পারি, গ্রেফতার হতে পারি সেটা মনে রাখতে হবে আপনাদের। আমরা বিশাল জনস্রোতের সঙ্গে আছি। কিন্তু আমরা ভেসে যাওয়ার জন্য আসিনি। বুদ্ধিজীবী হিসেবে আমাদের আত্মসমালোচনা দরকার। আমাদের এ সমস্যার পুরো পুঙ্খানুপুঙ্খ ব্যাখ্যা করা দরকার।’
সলিমুল্লাহ খান বলেন, ‘চলমান সংকটের উৎপত্তি কোথায় সেটাতে না গিয়ে সরকার এখন বলছে—এই দল, সেই দল নিষিদ্ধ করব। সেটা মূল সমস্যায় হাতই লাগবে না। শুধু সমস্যাকে আরো বাড়াবে। ক্যান্সারের সৃষ্টি করবে।’
কোটা সংস্কার আন্দোলনে রাষ্ট্রীয় মদদে হত্যাকাণ্ড হয়েছে, এমন মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘দেশের সিভিল সার্ভিস থেকে শুরু করে সব সরকারি চাকরিতে সবার বৈধভাবে প্রতিযোগিতা করার অধিকার থাকবে কি থাকবে না, সেই প্রশ্নটা অরাজনৈতিক প্রশ্ন নয়; এটা একটি রাজনৈতিক প্রশ্ন। কিন্তু রাজনৈতিক প্রশ্নে রাজনৈতিকভাবে সমাধানের দিকে না গিয়ে দেশের সরকার প্রথমে সেটা উপেক্ষা করতে চেয়েছে। পরে দমননীতি অবলম্বন করেছে। নিজেদের পেটোয়া বাহিনী দিয়ে এ হত্যাকাণ্ড শুরু। এ হত্যাকাণ্ড রাষ্ট্রীয় বাহিনীর দ্বারা হয়েছে এবং রাষ্ট্রীয় বাহিনীর সহযোগীদের দ্বারা হয়েছে। যাদের আমরা বলতে পারি প্রাইভেট বাহিনী।’
সরকার এখন এ হত্যাকাণ্ডকে জায়েজ করার জন্য নানা অজুহাত সামনে আনছে জানিয়ে এ গবেষক বলেন, ‘বলা হচ্ছে মেট্রোরেল স্টেশনে হামলা করা হয়েছে, সেতু ভবনে হামলা করেছে অথবা বাংলাদেশ টেলিভিশন ভবনে হামলা করেছে। সরকারের সর্বোচ্চ মহল থেকে এখনো বলা হচ্ছে, আমাদের উন্নয়নের প্রতীকগুলোকে ধ্বংস করার জন্য আমাদের রাজনৈতিক বিরোধীরা এ আন্দোলনে ঢুকে পড়েছে। কথাটা যদি ধরে নিই বা তাহলে যদি যুক্তির খাতিরে সত্যও হয়, তাহলে বলতে হবে দেশের মানুষ এটাকে সেই মুহূর্তে সমর্থন করল কেন? ধরুন মিরপুর-১০ বা অন্যান্য মেট্রোরেলে আক্রমণ করল কেন? অথবা যেকোনো ঔপনিবেশিক দেশের সঙ্গে যারা পরিচিত; এমনকি ইউরোপের দেশের ইতিহাস যারা পড়েছেন তারা জানেন মানুষ যেটিকে ক্ষমতার দম্ভের প্রতীক মনে করে সেটিতে হামলা করে।’
ন্যায়বিচারের প্রশ্ন তুলে ড. সলিমুল্লাহ খান বলেন, ‘এখন জনগণের কাছ থেকে ক্রমেই ধ্বনি উঠবে—ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় কখনো কি আপনারা বিশ্বাস করেন এ সরকার ন্যায়বিচার করতে পারবে? তারা এ হত্যাকাণ্ডের বিচার করবে না। কারণ তারা নিজেরাই হত্যাকারী। আপনি হত্যাকারীর কাছে কী করে বিচার চাইবেন। যারা নিজেরাই রাজাকার, অন্যকে বলে রাজাকার। পৃথিবীতে এর চেয়ে বড় প্রহসন কী আছে? যারা খুনি, তারা আমাদের বলে খুনি। যারা বিশ্বাসঘাতক, তারা আমাদের বলে বিশ্বাসঘাতক।’
ক্ষমতার সর্বোচ্চ কেন্দ্রে চারদিকে রাজাকার বসে আছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘ছাত্র যারা ২০০০ খ্রিষ্টাবের পর জন্মগ্রহণ করেছে তাদেরও তারা রাজাকার বলছে। আমরা এখানে দাঁড়িয়েছি যারা নিহত হয়েছে তাদের আত্মার মাগফিরাতের জন্য নয়; যারা বেঁচে আছে তাদের আত্মার মাগফিরাতের জন্য। আমাদের মাগফিরাতের মূল কথা হলো ক্ষমা। যারা নিহত ও আহত, যারা নিপীড়িত-নির্যাতিত এবং পলাতক আমরা তাদের প্রতিকার চাই। এ প্রতিকার সম্ভব হবে যখন দেশের সব জনগণ ওদের মতোই বেরিয়ে আসবে। বলা হচ্ছে এটা ছাত্র-যুবকদের আন্দোলন। কিন্তু এটি সারা দেশের আন্দোলনে পরিণত হয়েছে, পরিণত হতে চলেছে। আন্দোলন বন্ধ হয়নি, আন্দোলন বন্ধ হবে না।’
সলিমুল্লাহ খান নিজের অবস্থান তুলে ধরে বলেন, ‘আমরা লিখে দিয়েছি শিক্ষার্থীরা গ্রেফতার কেন, অবিলম্বে মুক্তি দাও। এটা আমাদের দাবি। আমরা বলছি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপদ শিক্ষার পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে হবে। যদি আমাদের ছাত্র-ছাত্রীরা আসতে না পারে আমরা কী পড়াব? কাকে পড়াব?