সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী অর্থাৎ প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের 'স্যার' বলে সম্বোধন করতে হবে কি হবে না এ নিয়ে লিখিত কোনো আদেশ- নির্দেশ নেই। এরপরও এ-সংক্রান্ত প্রশ্ন উঠলে 'স্যার' বলার বাধ্যবাধকতা নেই বলেই মত দেন নীতিনির্ধারকরা। কিন্তু মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা মাঝেমধ্যেই এ বিতর্ক উস্কে দিচ্ছেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারিভাবে লিখিত আদেশ জারি করলে এ সমস্যার সমাধান মিলতে পারে।
শুক্রবার দৈনিক সমকাল পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য জানা গেছে।
প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, গত বুধবার একটি কাজে রংপুরের ডিসির সঙ্গে কথা বলতে গেলে ডিসি চিত্রলেখা নাজনীনকে 'স্যার' না বলায় ক্ষুব্ধ হন বলে অভিযোগ করেন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেম বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ওমর ফারুক। ডিসির এমন আচরণে সেদিন সন্ধ্যায় ডিসির কার্যালয়ের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন এ শিক্ষক। তখন বিষয়টি জানাজানি হয়। এর পর থেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হচ্ছে।
এ বিষয়ে মন্তব্য জানতে চাইলে সাবেক সচিব আবু আলম মো. শহীদ খান বলেন, জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী নিজে এ বিষয়ে কথা বলেছিলেন। তিনি খুব সঠিকভাবেই বলেছিলেন, প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের স্যার বলার বাধ্যবাধকতা নেই। প্রতিমন্ত্রী এটা বলার পরও গণকর্মচারীরা কেন সেটা অনুসরণ করছেন না, এ বিষয়ে প্রতিমন্ত্রী কোনো উদ্যোগ নেবেন কিনা জানা দরকার।
সাবেক এ সচিব প্রশ্ন তোলেন, সরকারি কর্মচারীরা কি ভুলে যাচ্ছেন, তাঁদের বেতন-ভাতা জনগণের ট্যাক্সের টাকায় হয়? সরকারের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে লিখিত আদেশ থাকা উচিত কিনা- এমন
প্রশ্নের জবাবে সাবেক এ সচিব বলেন, স্যার ডাকা না ডাকা নিয়ে লিখিত কোনো আদেশ নেই এটা ঠিক। এখন এ বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় কী চায় সেটা জানা দরকার। সরকারি কাজে মৌখিক নির্দেশনার তেমন প্রভাব থাকে না। এ জন্য জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় লিখিত আদেশ জারি করতে পারে। তারা সেটা চায় কিনা সেটাই বিষয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক সালাহউদ্দিন এম আমিনুজ্জামান বলেন, স্যার শব্দটা প্রথা হিসেবে এমনভাবে ব্যবহার হচ্ছে, এটাকে হঠাৎ করেই আলাদা করা কঠিন। আমলাতন্ত্রের যে প্রাতিষ্ঠানিকতা তাতে স্যার শব্দটি ব্যবহার হয় সম্মতিসূচক বার্তা হিসেবে। যেমন সিনিয়র কোনো অফিসার জুনিয়রকে আদেশ বা নির্দেশ দিলে ইয়েস বা নো বলেন না, বলেন স্যার স্যার। অর্থাৎ তিনি সন্মত আছেন। তাই আমলাতান্ত্রিক কাঠামোতে শব্দটি উঠিয়ে দিলে কেমন হবে সেটা সংশ্লিষ্টরা ভেবে সিদ্ধান্ত নেবেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক ড. তৌহিদুল হকের মতে, দেশ স্বাধীন হলেও ঔপনিবেশিক মানসিকতা এখনও রয়ে গেছে। তাই সেবাগ্রহীতা এবং সেবা প্রদানকারীর মধ্যে একটি গ্রহণযোগ্য সম্বোধন ঠিক করে সরকার প্রজ্ঞাপন বা পরিপত্র জারি করতে পারে। এতে এ ধরনের সমস্যা সহজেই কাটবে বলে আমার বিশ্বাস।
এ বিষয়ে ২০২১ খ্রিষ্টাব্দের ৭ সেপ্টেম্বর সচিবালয়ে সাংবাদিকদের একটি অনুষ্ঠানে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী পরিষ্কার ভাষায় বলেছিলেন, সরকারি চাকুরেদের
স্যার বা ম্যাডাম বলে সম্বোধন করতে হবে- এমন কোনো নীতি নেই। তিনি বলেন, স্যার শব্দের অর্থ হচ্ছে মহোদয়, ম্যাডাম শব্দের অর্থ হচ্ছে মহোদয়া, অর্থাৎ জনাব, জনাবা আমাদের জাতির পিতার নির্দেশনা কী ছিল? 'যারা তোমাদের কাছে সেবা নিতে আসে তাদের দিকে তাকাও। তারা তোমার ভাইয়ের মতো, বাবার মতো, তোমার আত্মীয়ের মতো।' প্রতিমন্ত্রী সরকারি কর্মচারীদের উদ্দেশে আরও বলেন, আপনার আচরণ সরকারের আচরণ। সাধারণ মানুষ মনে করে আপনার আচরণ, আপনার অফিস প্রধানমন্ত্রীর অফিসের একটি অংশ।
সেদিনের ঘটনা প্রসঙ্গে ওমর ফারুক সাংবাদিকদের বলেন, কাজ শেষে বিদায়ের সময় ডিসিকে বলি, 'আপা ধন্যবাদ, ভালো থাকবেন।” উত্তরে ডিসি বলেন, 'এই চেয়ারে কোনো পুরুষ থাকলে তাঁকে আপনি কী বলতেন আমি বলি, 'তাঁকে ভাই বলতাম।' তখন ডিসি বলেন, 'এই চেয়ারকে সম্মান করে স্যার বলে ডাকা উচিত।'
রংপুরের ডিসি ড. চিত্রলেখা নাজনীন গতকাল বৃহস্পতিবার বলেন, এই বিষয়টি একটু অতিরঞ্জিত হয়ে ছড়িয়েছে। আমি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গেলে কেউ আপা, কেউ স্যার, কেউবা খালা বলে ডাবেন। আমি কখনও কাউকে স্যার বলতে বাধ্য করিনি। আমি সরকারি কর্মচারী, আমাকে স্যার বলতে হবে এমন কোনো কথা নেই।
উল্লেখ্য, মানিকগঞ্জের সিংগাইর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রুনা লায়লাকে স্যার না বলে আপা বলায় ইউএনওর নির্দেশে এক ব্যবসায়ীকে পিটিয়ে আহত করার অভিযোগ উঠেছিল সিংগাইর থানা পুলিশের বিরুদ্ধে। উপজেলার ধল্লা ইউনিয়নের জায়গীর বাজার বাসস্ট্যান্ড এলাকায় এমন ঘটনার অভিযোগ উঠেছিল ২০২১ খ্রিষ্টাব্দের ৮ জুলাই।
এ ছাড়া বছরের বিভিন্ন সময়ে সাংবাদিক, পেশাজীবী এবং সাধারণ সেবাগ্রহীতাদের সঙ্গে এমন ঘটনা ঘটতে দেখা যায়।