বেতন বাড়লে ক্রয়ক্ষমতা বাড়ে। এই ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি বাজারে নগদ অর্থের সরবরাহ বাড়িয়ে শেষ পর্যন্ত মূল্যস্ফীতি ডেকে আনে। এ পরিস্থিতিতে যাদের বেতন বাড়েনি, বাড়তি ব্যয়ের হাত থেকে রেহাই পান না তারাও। এভাবেই সমাজের বড় একটা অংশের আয় অপরিবর্তিত বা অপেক্ষাকৃত কম হলে, অন্যদিকে খরচ ক্রমাগত বাড়লে অধিক হারে আয় বৈষম্যও বাড়ে, যা শেষ পর্যন্ত দারিদ্র্যকে উসকে দেয়। ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (ইফ্রি) গবেষণা প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে এসেছে।
প্রতিবেদনে অর্থনীতিবিদ মো. আল-হাসান দাবি করেন, ২০১৫ সালে সরকারি কর্মচারীদের শতভাগ বেতন বাড়ে। সে কারণে ওই সময় বেসরকারি খাতের স্বল্প দক্ষতাসম্পন্ন অনেক কর্মীর জীবনযাপন সাময়িকভাবে দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যায়। শ্রমবাজারের নতুন সে পরিস্থিতির সঙ্গে বেসরকারি খাতের কর্মীরা নিজেদের মানিয়ে নিতে পারেননি। কারণ, শুধু সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন বাড়লেও বাড়তি দ্রব্যমূল্যের চাপ পড়েছে সবার ওপরই। ওই সময় বেসরকারি খাতের স্বল্প দক্ষতাসম্পন্ন কর্মীদের মজুরি বৃদ্ধির হার কম থাকায় পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি তাদের দারিদ্র্যসীমার নিচে ঠেলে দেয়।
গতকাল শনিবার বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) শীতকালীন অর্থনৈতিক সম্মেলনে গবেষণার প্রাথমিক ফলাফল তুলে ধরে ইফ্রি। এতে দাবি করা হয়, সবার মজুরি একই হারে না বাড়লে দারিদ্র্য বেড়ে যায়। এক্ষেত্রে মজুরি বৃদ্ধির সীমা ১০ শতাংশ বাড়লে দারিদ্র্য ৪০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে যেতে পারে। এ বিষয়ক একটি সিমুলেশন বা মডেলিংও করা হয়েছে। তবে গবেষণার এ ফলাফলটি এখনো প্রাথমিক পর্যায়েই রয়েছে বলেও জানানো হয়।
গবেষক আল-হাসানের দাবি, সমাজে একাংশের মজুরি বাড়লে উচ্চদক্ষতাসম্পন্ন কর্মীর সংকট থাকায় তারা নিজেদের বেতন বাড়িয়ে নিতে পারেন। কিন্তু স্বল্প দক্ষতাসম্পন্ন কর্মীর সরবরাহ বেশি থাকায় তাদের মজুরি তেমন বাড়ে না।
তিনি আরও বলেন, দেশে জাতীয় বাজেট প্রস্তাবে যখন সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন বাড়ানোর প্রসঙ্গ আসে, তখন সামগ্রিক পণ্যমূল্য দ্রুততার সঙ্গে ১০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে যায়।
দুভাবে এ পণ্যমূল্য বাড়ে বলেও জানান এই অর্থনীতিবিদ। প্রথমত, সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন বাড়ছে, এমন খবর দ্রুতগতিতে পণ্যমূল্য বেড়ে যায়। দ্বিতীয়ত, খবরটি যদি বাজেট প্রস্তাবের সময় আসে, তাহলে পণ্যমূল্য অতিরিক্ত হারে বাড়ে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১০ থেকে ২০১৬-১৭ সালের মধ্যে দেশের বেসরকারি খাতের সবচেয়ে দক্ষ কর্মীর মজুরি বেড়েছে ১৪০ শতাংশ; কিন্তু স্বল্প দক্ষ কর্মীর মজুরি বেড়েছে ৯০ শতাংশ। বিপরীতে সরকারি চাকরিজীবীদের মজুরি একই সময়ে বেড়েছে ১৩০ থেকে ১৫৫ শতাংশ।
দিনব্যাপী সম্মেলনের প্রথম অধিবেশনে দারিদ্র্য, অসমতা ও প্রবৃদ্ধিবিষয়ক তিনটি গবেষণাপত্র উপস্থাপন করা হয়। সভাপতিত্ব করেন ইস্ট-ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এ কে এনামুল হক। এর আগে সকালে উদ্বোধন অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক শ্যামল চৌধুরী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অতনু রাব্বানি প্রমুখ। সম্মেলনটি বিআইডিএস, বাংলাদেশ ইকোনমিক রিসার্চ নেটওয়ার্ক এবং অ্যাসোসিয়েশন ফর ইকোনমিক অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট স্টাডিস অন বাংলাদেশের যৌথ উদ্যোগে আয়োজন করা হয়।
সম্মেলনের প্রথম অধিবেশনে ‘স্থানীয় সরকারের ইউনিট খণ্ডিত করা হলে কি দারিদ্র্য বিমোচন হয়’ শীর্ষক গবেষণাপত্র উপস্থাপন করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আমিন মাসুদ আলী। সেখানে বলা হয়, স্থানীয় সরকারের ইউনিট খণ্ডিত করা হলে প্রাথমিকভাবে দরিদ্র্য কিছুটা কমতে পারে; কিন্তু খণ্ডিতকরণ নির্দিষ্ট সীমা অতিক্রম করলে পরবর্তীকালে তা আবার কিছুটা বাড়তে পারে। দেশের আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতির ওপর বিষয়টি নির্ভর করে না। যে জেলার সংসদ সদস্যদের ক্ষমতা বেশি, তারা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থে পৌরসভা বা ইউনিয়ন পরিষদ গঠন করেন। এক্ষেত্রে সরকারের ব্যয় বাড়ার পাশাপাশি সমন্বয়েও সমস্যা হয় বলে গবেষণাপত্রে উল্লেখ করা হয়।