দৈনিক শিক্ষাডটকম প্রতিবেদক : প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত দেশের বেশির ভাগ শিক্ষার্থীই বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া করে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সাম্প্রতিক এক জরিপে এমন তথ্য জানা গেছে। জরিপের তথ্য মতে, বর্তমানে সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া করছে ৪৬ দশমিক ৮৬ শতাংশ শিক্ষার্থী। বাকি ৫৩ দশমিক ১৪ শতাংশ শিক্ষার্থী পড়ে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। এর মধ্যে এমপিওভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ২৭ দশমিক ৬৮ শতাংশ লেখাপড়া করে। আর এমপিওবহির্ভূত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া করে ১৩ দশমিক ৯৬ শতাংশ শিক্ষার্থী। এর বাইরে উপানুষ্ঠানিক প্রতিষ্ঠানে ৬ দশমিক ৫০ শতাংশ ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে ৪ দশমিক ১৯ শতাংশ শিক্ষার্থী অধ্যয়ন করে।
শিক্ষা বিশেষজ্ঞরা সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার মান, পরিবেশ, আস্থাহীনতা ও শ্রেণিবৈষম্যকে (ধনী-গরিব) বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বেশির ভাগ শিক্ষার্থী পড়ার মূল কারণ হিসেবে দায়ী করছেন। এক্ষেত্রে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পরিবেশ ফিরিয়ে আনা, শিক্ষকদের দায়িত্বশীল আচরণ, শিক্ষা খাতে পর্যাপ্ত বরাদ্দ বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন তারা।
বিবিএস এবারই প্রথম পাঠদানরত প্রতিষ্ঠানের ধরন নিয়ে জরিপ করে। সম্প্রতি বিবিএস ‘বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিক ২০২৩’ প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে আসে। জরিপে দেখা যায়, দেশে বাংলা মাধ্যমে পড়ালেখা করছে ৮৮ দশমিক ৪০ শতাংশ শিক্ষার্থী। এর বাইরে ইংরেজি মাধ্যম শূন্য দশমিক ৬৯ শতাংশ, ইংরেজি ভার্সন শূন্য দশমিক ১৫ শতাংশ এবং অন্যান্য মাধ্যমে পড়ছে ১০ দশমিক ৭৭ শতাংশ শিক্ষার্থী। জরিপে আরও উঠে আসে সাধারণ শিক্ষায় ৯১ দশমিক শূন্য ২ শতাংশ, কারিগরি শিক্ষায় ১ দশমিক ২২ শতাংশ, ধর্মীয় শিক্ষায় ৭ দশমিক ২৯ শতাংশ এবং অন্যান্য শিক্ষায় শূন্য দশমিক ৪৮ শতাংশ শিক্ষার্থী পড়ালেখা করছে।
এখনো বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থী বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নের মূল কারণ হিসেবে অভিভাবকদের আস্থার অভাবকেই দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা। একই সঙ্গে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যে পরিমাণ বিনিয়োগ প্রয়োজন, সেই পরিমাণ বিনিয়োগ সরকার করছে না বলেও মনে করেন তারা। অভিভাবকরা মনে করেন, সরকারি প্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া করলে ভালো ভবিষ্যৎ গড়বে না। বেশি টাকা খরচ হলেও তারা ইংরেজি মাধ্যমে পড়ায়। আবার কেউ কেউ পরকালের প্রাপ্তির জন্য সন্তানদের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে পড়ালেখা করান। এ কারণেই মূল ধারায় সংযুক্ত কম হচ্ছে।
শিক্ষায় বৈষম্য দূর করাসহ এখনো সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা মান্য হচ্ছে না বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। শিক্ষা নাগরিকের সংবিধান স্বীকৃত মৌলিক অধিকার। সংবিধানের ১৭ অনুচ্ছেদে মূলত তিনটি বিষয় উল্লেখ আছে। ‘অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষা’ শীর্ষক এই অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, প্রথমত- সরকার একই পদ্ধতির গণমুখী ও সর্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থা এবং আইনের দ্বারা নির্ধারিত স্তর পর্যন্ত সব ছেলে ও মেয়েকে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষার ব্যবস্থা করবে। দ্বিতীয়ত- সমাজের প্রয়োজনের সঙ্গে শিক্ষাকে সঙ্গতিপূর্ণ এবং প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও সদিচ্ছাপ্রণোদিত নাগরিক সৃষ্টির ব্যবস্থা করতে হবে। তৃতীয়ত- আইনের দ্বারা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নিরক্ষরতা দূর করার ব্যবস্থা গ্রহণ করবে সরকার। সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, এই অনুচ্ছেদের তিনটি ধারার একটিও পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি।
বেসরকারি প্রতিষ্ঠান গড়ার ক্ষেত্রে নীতিমালা থাকা উচিত বলে মনে করেন ঢাকা কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. আয়েশা বেগম। আমাদের তিনি বলেন, এখন গ্রামেও কিন্ডারগার্টেন ও বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। তিনি বলেন, শিক্ষার মূল ভিত হচ্ছে প্রাথমিক শিক্ষা। এজন্য প্রাথমিক শিক্ষার দিকে বিশেষ নজর দিতে হবে। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো, বিশেষ করে গ্রামে শিক্ষার মান দুর্বল এবং রুগ্ন হওয়ায় গড়ে উঠছে কিন্ডারগার্টেন স্কুল। যারা তুলনামূলক বিত্তবান তারাই সন্তানদের এসব স্কুলে পড়ান। এ কারণে সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার মান ভালো হয় না।
অধ্যাপক আয়েশা বেগম বলেন, শিক্ষার মান বাড়াতে হলে প্রাথমিক শিক্ষায় সরকারকে নজর দিতে হবে। বিশেষ করে শিক্ষার মানোন্নয়ন ও পরিবেশ উন্নয়নে বরাদ্দ বাড়াতে হবে। শিক্ষকদের জন্য সময়োপযোগী নিয়মিত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা খুবই প্রয়োজন। কারণ অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, কোনো কোনো শিক্ষকও নিজেদের ছাত্রজীবনে হয়তো পূর্ণাঙ্গ শিক্ষার সুযোগ পাননি। গুরুত্বসহকারে শিক্ষকদেরও গড়ে তোলার দিকে মনোযোগ দিতে হবে। পাশাপাাশি শিক্ষকদের বার্ষিক মূল্যায়ন গুরুত্বসহকারে দেখতে হবে। তা হলে শুরুতেই শিশুদের শিক্ষার ভিত মজবুত হবে।