প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সারাদেশে সর্বজনীন পেনশনব্যবস্থা চালু করতে দ্রুত প্রস্তুতি নিতে নির্দেশে দিয়েছেন। গত সপ্তাহে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে অর্থ মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে। চিঠি পাওয়ার পর আগামী মাস থেকেই তা কার্যকর করার লক্ষ্যে জোরেশোরে কাজ করছে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়। সম্পূর্ণ প্রস্তুতি শেষ করতে না পারলে প্রাথমিকভাবে পাইলট প্রকল্প হিসেবে ঢাকা এবং আরেকটি জেলায় চালু করা হতে পারে পেনশনব্যবস্থা।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, সর্বজনীন পেনশনব্যবস্থায় কী রাখা হবে তা নিয়ে একটি কর্মকৌশল প্রণয়ন করা হয়েছে। অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের পরামর্শে যার সংযোজন-বিয়োজন চলছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে সর্বজনীন পেনশনব্যবস্থার উদ্বোধন করার কথা আছে।
জানা গেছে, ২০১৭-১৮ অর্থবছর থেকে প্রতিবারই বাজেটে সর্বজনীন পেনশনব্যবস্থা চালুর বিষয়টি আনা হলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি। গত ২৪ জানুয়ারি জাতীয় সংসদে ‘সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থাপনা আইন-২০২৩’ পাস হয়। গত ১৩ ফেব্রুয়ারি সর্বজনীন পেনশন কর্তৃপক্ষ গঠনের দাপ্তরিক আদেশ জারি করা হয়। এরপর গত ৩ জুলাই অর্থ মন্ত্রণালয়ের আরেক আদেশে অর্থ বিভাগের বাজেট ও ব্যয় ব্যবস্থাপনা শাখার অতিরিক্ত সচিব কবিরুল ইজদানী খানকে সর্বজনীন পেনশন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান ও প্রবিধি, বাস্তবায়ন এবং রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান শাখার অতিরিক্ত সচিব মো. গোলাম মোস্তফাকে সদস্য হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। পরবর্তী আদেশ না দেওয়া পর্যন্ত তারা নিজ কাজের অতিরিক্ত এ দায়িত্ব পালন করবেন।
সর্বজনীন পেনশন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান কবিরুল ইজদানী খান দৈনিক আমাদের বার্তাকে বলেন, সর্বজনীন পেনশনব্যবস্থা চালু করার আয়োজনটা বড় মাপের। আমরা গুরুত্ব দিয়ে কাজ করছি। আশা করি দ্রুত এর সুফল পাওয়া যাবে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, আগামী মাসে (আগস্ট) সর্বজনীন পেনশনব্যবস্থা চালু করা হবে এমন লক্ষ্য নিয়েই প্রস্তুতি চলছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্বোধন করার কথা আছে।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, নির্বাচনের আগেই সর্বজনীন পেনশনব্যবস্থা চালু করতে সরকারের চেষ্টা থাকবে। বিষয়টি নিয়ে জনগণের মধ্যে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে আমি মনে করি।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকৌশল বিশ্লেষণ করে বলা যায়, সর্বজনীন পেনশন আইনের বিধিমালায় ছয় ধরনের স্কিম আছে। এসব হলো, বেসরকারি প্রাতিষ্ঠানিক চাকরিজীবী, প্রবাসী/অনিবাসী, শ্রমিক শ্রেণি, অপ্রাতিষ্ঠানিক জনগোষ্ঠী, সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিভুক্ত জনগোষ্ঠী এবং শিক্ষার্থী পেনশনার। প্রস্তুতি শেষ না হলে উদ্বোধনকালেই সব স্কিম চালু করা সম্ভব হবে না বলে জানিয়েছেন অর্থ বিভাগের কর্মকর্তারা। প্রতিটি স্কিম হবে স্বতন্ত্র। সব স্কিমে একটি ন্যূনতম চাঁদার হার নির্ধারিত থাকবে। কেউ ইচ্ছে করলে আর্থিক সক্ষমতার ভিত্তিতে চাঁদা বাড়িয়ে দিয়ে পেনশনও বেশি নিতে পারবেন। পেনশনভোগীদের স্মার্টকার্ড দেওয়ার কথা আছে। ৫ থেকে ১০ শতাংশ হারে বার্ষিক ইনক্রিমেন্টেও দেওয়ার কথা আছে। অন্যদিকে ‘সর্বজনীন পেনশনব্যবস্থা’ সারা দেশে চালু হওয়ার পর অন্তত পাঁচ বছর তা ঐচ্ছিক রাখার কথা আছে। এরপর তা বাধ্যতামূলক করা হবে বলে অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে।
কর্মকৌশলে বলা হয়েছে, জাতীয় পরিচয়পত্রকে ভিত্তি ধরে সর্বজনীন পেনশনব্যবস্থার আওতায় ১৮ থেকে ৫০ বছর বয়সী নাগরিকরা হিসাব খুলতে পারবেন। তবে বিশেষ বিবেচনায় ৫০ বছরের বেশিদের জন্য এ সুবিধা রাখার কথা চিন্তা করা হয়েছে। পেনশনধারীরা আজীবন (মৃত্যুর আগ পর্যন্ত) পেনশন সুবিধা পাবেন। বিদেশে কর্মরত বাংলাদেশিরাও এ ব্যবস্থায় আসতে পারবেন। ধারাবাহিকভাবে কমপক্ষে ১০ বছর চাঁদা দেওয়ার পেনশন পাওয়ার যোগ্য বলে ধরা হবে। কেউ কর্মক্ষেত্র পরিবর্তন করলেও পেনশন পদ্ধতি একই থাকবে। অর্থাৎ চাকরি পরিবর্তন বা স্থান পরিবর্তন করলেও তার অবসর হিসাবের স্থিতি, চাঁদা প্রদান ও অবসর সুবিধা অব্যাহত থাকবে। প্রবাসী কর্মীরা ত্রৈমাসিক ভিত্তিতেও চাঁদা জমা দিতে পারবেন। সুবিধাভোগীরা বছরে ন্যূনতম বার্ষিক জমা নিশ্চিত করবেন। না হলে পেনশনধারীর হিসাব সাময়িকভাবে স্থগিত করা হবে। পরে বিলম্ব ফিসহ বকেয়া চাঁদা দিলে আবারও সচল হবে। ৬০ বছর পূর্তিতে পেনশন তহবিলে পুঞ্জীভূত লভ্যাংশসহ জমার বিপরীতে নির্ধারিত হারে পেনশন দেওয়া হবে। নিবন্ধিত চাঁদা জমাকারী পেনশনে থাকাকালে ৭৫ বছর পূর্ণ হওয়ার আগে মারা গেলে জমাকারীর নমিনি বাকি সময়কালের (মূল জমাকারীর বয়স ৭৫ বছর পর্যন্ত) জন্য মাসিক পেনশন পাবেন। পেনশন কর্মসূচিতে জমা করা অর্থ এককালীন উত্তোলনের সুযোগ থাকবে না। তবে আবেদন করে জমা অর্থের সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ ঋণ হিসেবে নিতে পারবেন, যা সুদসহ পরে পরিশোধ করতে হবে। কমপক্ষে ১০ বছর চাঁদা দেওয়ার আগে নিবন্ধিত চাঁদাদানকারী মারা গেলে জমা করা অর্থ মুনাফাসহ নমিনিকে ফেরত দেওয়া হবে। পেনশনের জন্য নির্ধারিত চাঁদা ‘বিনিয়োগ’ হিসেবে গণ্য করে কর রেয়াত দেওয়া হবে। মাসিক পেনশন বাবদ প্রাপ্ত অর্থ আয়করমুক্ত থাকবে। নিম্ন আয়সীমার নিচের নাগরিকদের ক্ষেত্রে পেনশন কর্মসূচিতে মাসিক চাঁদার একটি অংশ সরকার অনুদান হিসেবে দেবে।
সর্বজনীন পেনশন পদ্ধতিতে সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত অথবা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের অংশ নেওয়ার সুযোগ রাখা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে কর্মী ও প্রতিষ্ঠানের চাঁদার অংশ কর্তৃপক্ষ নির্ধারণ করবে। তবে সরকার সিদ্ধান্ত না দেওয়া পর্যন্ত সরকারি ও আধা সরকারি বা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ব্যক্তিরা এই পেনশনব্যবস্থার আওতাবহির্ভূত থাকবেন।
অর্থ বিভাগের তথ্যানুযায়ী, বর্তমানে দেশের ছয় কোটির বেশি কর্মজীবীর মধ্যে ৮০ শতাংশের বেশি কাজ করেন বেসরকারি খাতে। বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত সাড়ে ১১ লাখের বেশি সরকারি চাকরিজীবী পেনশন সুবিধা পাচ্ছেন।
অন্যান্য দেশের উদাহরণ : চীনে তিন ধরনের পেনশনব্যবস্থা চালু রয়েছে। শহরে কর্মরত ব্যক্তিদের জন্য আরবান পেনশন সিস্টেম (ইউপিএস), সরকারি ও আধা সরকারি চাকরিজীবীদের জন্য সিভিল ও পাবলিক সার্ভিস পেনশন সিস্টেম (সিপিএসপিএস) এবং গ্রামে বেসরকারি চাকরিতে নিয়োজিত ব্যক্তিদের জন্য রুরাল পেনশন সিস্টেম (আরপিএস) চালু আছে। যুক্তরাজ্যে রাষ্ট্রীয়, পেশাগত, ব্যক্তিগত ও আনফান্ডেড এই চার ধরনের পেনশনব্যবস্থা চালু আছে। যুক্তরাষ্ট্রে রয়েছে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় সামাজিক নিরাপত্তা, চাকরিভিত্তিক, আনফান্ডেড এবং ব্যক্তিগত পেনশন। অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডে বাজেট থেকে সবাইকে পেনশন দেওয়া হয়। জাপান, হংকং, কোরিয়া ও তাইওয়ানের পরিস্থিতিও উন্নত দেশগুলোর মতোই। থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর ও ভিয়েতনাম পেনশন সংস্কার করছে। ফিলিপাইন, মিয়ানমার, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়াও অংশগ্রহণমূলক পেনশন পদ্ধতি চালু আছে।