বৈষম্যবিরোধী ছাত্র- জনতার আন্দোলনের মুখে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর 'সর্বজনীন পেনশন স্কিম'-এর কার্যক্রম অনেকটাই স্থবির হয়ে পড়েছে। এই স্কিমটি শেষ পর্যন্ত টিকবে কী না-এই আস্থাহীনতার সংকট তৈরি হওয়ায় নতুন নিবন্ধনকারীর সংখ্যা এখন প্রায় শূন্যের কোটায় নেমে এসেছে। যারা ইতোপূর্বে নিবন্ধন নিয়েছেন তাঁরাও নিয়মিত চাঁদা পরিশোধ করছেন না।
ফলে গত সরকারের সময় ঢাকঢোল পিটিয়ে চালু করা সার্বজনীন পেনশন স্কিমটির ভবিষ্যত কি হবে, সেই ভাগ্য নির্ধারণে আজ সোমবার গভর্নিং বডির জরুরি সভা আহ্বান করেছে অর্থমন্ত্রণালয়। পদাধিকার বলে এই কাউন্সিলের সভায় সভাপতিত্ব করার কথা রয়েছে অর্থ ও বাণিজ্য উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদের। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের। জানা গেছে, গত সরকারের সময় সর্বজনীন পেনশন স্কিমে চারটি প্রকল্প চালু করা হয়েছিল। স্কিমগুলো হলো- প্রবাস (প্রবাসী বাংলাদেশীদের জন্য), প্রগতি, সুরক্ষা এবং সমতা। এ ছাড়া স্বায়ত্তশাসিত এবং আধা- স্বায়ত্তশাসিত সংস্থার কর্মচারীদের জন্য প্রত্যয় নামে একটি পঞ্চম স্কিম চালুর পরে শিক্ষকদের প্রতিবাদের কারণে তা বাতিল করা হয়। ফলে পুরো স্কিম এখন বেসরকারিখাত নির্ভর হয়ে পড়েছে। এ কারণে স্কিমের সফলতাও এখন প্রশ্নের মুখে পড়েছে।
অনেকে বিদ্যমান প্রেক্ষাপটে স্কিমটি চালিয়ে যাওয়ার যৌক্তিকতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন। কারণ, এই স্কিমটি চালানোর জন্য সরকারকে প্রতি মাসে একটা মোটা অঙ্কের অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে। অন্যদিকে, গ্রাহকরাও সর্বজনীন পেনশন স্কিমে আস্থা রাখতে পারছে না। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বেশ কয়েকজন গ্রাহক জানান, এই স্কিমটি চালু রাখতে হলে সরকারের পক্ষ থেকে সুনির্দিষ্ট ঘোষণা আসা উচিত। আসলে অন্তর্বর্তী সরকার এই স্কিমটি কিভাবে দেখছে, কিভাবে পরিচালনা করছে কিংবা তারা এটি নিয়মিত করবে কি না সে বিষয়ে গ্রাহকদের জানানো উচিত। আমরা সবাই অন্ধকারে আছি। এ কারণে নিয়মিত চাঁদা দিতেও সাহস করছি না। যদি এই স্কিমটি বাতিল করা হয় তাহলে আমাদের জমাকৃত টাকার কি হবে কিংবা কিভাবে ফেরত পাবো সে বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে ঘোষণা দিতে হবে।
জানা গেছে, স্কিমটি পরিচালনার জন্য গঠিত জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে বহন করতে হচ্ছে। পেনশন স্কিম কর্তৃপক্ষকে চালাতে মাসে প্রায় ৩০ লাখ টাকা ব্যয় করতে হয় সরকারকে। এর মধ্যে কর্তৃপক্ষের নির্বাহী চেয়ারম্যানের বেতনই সাড়ে ৩ লাখ টাকা। এর সঙ্গে যোগ হচ্ছে সার্বক্ষণিক ড্রাইভারসহ গাড়ি সুবিধা এবং প্রকৃত ব্যয় অনুযায়ী টেলিফোন ও মোবাইল সুবিধা। একইভাবে কর্তৃপক্ষের সদস্যদের বেতন নির্ধারিত রয়েছে ৩ লাখ টাকা। সঙ্গে সার্বক্ষণিক ড্রাইভারসহ গাড়ি সুবিধা এবং প্রকৃত ব্যয় অনুযায়ী টেলিফোন ও মোবাইল সুবিধা। প্রতি মাসে তারা এই অর্থ তুলে নিচ্ছেন। এরই বাস্তবতায় আজ সোমবার জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের গভর্নিং কাউন্সিলের অনুষ্ঠিত সভা আহ্বান করা হয়েছে।
সচিবালয়ের অর্থ মন্ত্রণালয়ে বিকেলে সভাটি অনুষ্ঠিত হবে বলে জানা গেছে। এ প্রসঙ্গে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অর্থ বিভাগের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, সভায় পেনশন স্কিমের বর্তমান অবস্থা অর্থ উপদেষ্টার কাছে তুলে ধরা হবে। এদিকে, এখন অনেকটাই স্থবির হয়ে পড়েছে সর্বজনীন পেনশন স্কিম। এক সময় প্রতিদিন যেখানে ৪-৫ হাজার মানুষ নিবন্ধন করতেন, এখন এক বছরের ব্যবধানে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৪-৫ জনে।
এমনকি, কোনো কোনো দিন একজন গ্রাহকও এই স্কিমের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছেন না। যারা প্রতি মাসে কিস্তি দিতেন, আগ্রহ হারিয়ে তারাও কিস্তির টাকা জমা দিচ্ছেন না। আর এদের সংখ্যাও একেবারে কম নয়। চাঁদা না দেওয়ার হার অনেক বলে জানা গেছে। এই স্কিমের হালনাগাদ তথ্য সম্পর্কে একজন কর্মকর্তা জানান, গত ৯ অক্টোবর পর্যন্ত পেনশন স্কিমে মোট নিবন্ধনধারী সংখ্যা ছিল তিন লাখ ৭২ হাজার ৩৭১ জন। এখন পর্যন্ত এদের কাছ থেকে চাঁদা হিসেবে পাওয়া গেছে ১৩০ কোটি ৩৭ লাখ ৯৪ হাজার টাকা। এই অর্থ সরকারি ট্রেজারি বন্ডে বিনিয়োগ করা হয়েছে। তিনি বলেন, বিগত ৫ আগস্টের আগে এই কর্মসূচিতে প্রতিদিন ৪-৫ হাজার মানুষ নিবন্ধন করতেন। বর্তমানে এর পরিমাণ ৪০-৫০ জনে নেমে এসেছে। কোনো কোনো দিন ৫ জনের বেশিও হয় না। তথ্য মতে, চারটি স্কিমের মধ্যে দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসরত ব্যক্তিদের জন্য নির্ধারিত সমতায় সবচেয়ে বেশি মানুষ নিবন্ধন করেছেন। এর সংখ্যা দুই লাখ ৮৫ হাজার ৮৮৪ জন।
এরপর সুরক্ষা স্কিমের নিবন্ধনের সংখ্যা ৬৩ হাজার ১২৫ জন, প্রগতিতে ২২ হাজার ৩৩২ জন এবং বিদেশীদের জন্য নির্ধারিত প্রবাসে মাত্র ৮৯৪ জন নিবন্ধন করেছেন। এখন বেশিরভাগ নিবন্ধনকারী নিয়মিত চাঁদা পরিশোধ করছে না। উল্লেখ্য, ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দে ১৭ আগস্ট তৎকালীন সরকার এই স্কিমটি চালু করে। সমতা, সুরক্ষা, প্রগতি ও প্রবাস-এই চারটি স্কিমের মাধ্যমে এর কার্যক্রম শুরু হয়। সম্প্রতি অর্থ উপদেষ্টার সঙ্গে পেনশন সংক্রান্ত বৈঠক শেষে অর্থ সচিব খারুজ্জাজ্জামান মজুমদার জানিয়েছিলেন, উপদেষ্টার অনুমোদনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সার্বজনীন পেনশন স্কিমটি আপাতত চলতে থাকবে। এ ছাড়া সর্বজনীন পেনশন স্কিম কর্তৃপক্ষের সদস্য গোলাম মোস্তফা জানিয়েছেন, সর্বজনীন পেনশনের প্রবাস, প্রগতি, সুরক্ষা এবং সমতা-এর অধীনে বিদ্যমান চারটি স্কিম এবং তাদের কার্যক্রম নিয়ে ইতোপূর্বে আলোচনা হয়েছে। তিনি বলেন, আমরা এখন পর্যন্ত আমাদের কার্যক্রম সম্পর্কে অর্থ উপদেষ্টাকে ব্রিফ করেছি। তার ভিত্তিতে তিনি পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত বর্তমান কাঠামো বজায় রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।