কুমিল্লার বুড়িচং আনন্দ পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়। ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দে শুরু হয়েছিল ছয়তলা একাডেমিক ভবনের নির্মাণকাজ। এখনো তা শেষ করতে পারেননি দায়িত্বে থাকা ঠিকাদার। শ্রেণীকক্ষ সংকটসহ নানা কারণে ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে বিদ্যালয়টির শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের। বাধ্য হয়ে ক্লাস চালিয়ে যেতে হচ্ছে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনে। অথচ পরিত্যক্ত ভবনটিতে প্রায়ই খসে পড়ে পলেস্তারা, বেরিয়ে এসেছে ছাদের রড। তাই নতুন ভবনের কাজ দ্রুত শেষ করতে স্কুল কমিটির সভাপতি ও স্থানীয় প্রকৌশলীকে তাগাদা দিয়ে যাচ্ছেন প্রধান শিক্ষক একেএম আমিনুল ইসলাম। বুধবার (২৬ জুলাই) বণিক বার্তা পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়। প্রতিবেদনটি লিখেছেন ইয়াহইয়া নকিব।
প্রতিবেদনে আরো জানা যায়, রাজধানীর অদূরে গাজীপুরের রানী বিলাসমণি সরকারি বালক বিদ্যালয়ে শ্রেণীকক্ষের সংকট বহুদিন থেকেই। ল্যাব, লাইব্রেরিসহ প্রয়োজনীয় অনেক কিছুই নেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটিতে। তাই নির্মাণ করা হচ্ছে পাঁচতলা একটি একাডেমিক ভবন। দ্রুত এর কাজ শেষ না হলে শিক্ষার্থীদের ভোগান্তি বাড়বে বলে জানান বিদ্যালয়টির প্রধান শিক্ষক আকতার হোসেন মিয়া। ঢাকার মিরপুর সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়েও দীর্ঘ সময় ধরে ভবন নির্মাণের কাজ চলমান বলে জানান শিক্ষক মোজাম্মেল হক। দেশের অনেক সরকারি বিদ্যালয়ের চিত্রই প্রায় এক। বাধ্য হয়ে তাই পরিত্যক্ত ভবন বা ল্যাবে ক্লাস-পরীক্ষা চালিয়ে যাচ্ছে স্কুল কর্তৃপক্ষ।
সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোয় নতুন করে ২ লাখ ৮২ হাজার শিক্ষার্থী সংস্থান নিশ্চিতে উদ্যোগ নেয় সরকার। এর মধ্যে বছরে ৭৬ হাজার শিক্ষার্থী নবম শ্রেণীতে বিজ্ঞান বিভাগে অধ্যয়নের সুযোগ তৈরি অন্যতম লক্ষ্য। এজন্য একাডেমিক ভবন, হোস্টেল, বিজ্ঞান-কম্পিউটার ল্যাব, লাইব্রেরি ও শিক্ষক ডরমিটরি নির্মাণে ৩ হাজার ২৮৪ কোটি টাকার প্রকল্প হাতে নেয়া হয়। ২০১৭ খ্রিষ্টাব্দে এসব কাজ শুরু হয়ে ২০২১ খ্রিষ্টাব্দের জুনে অর্থাৎ সাড়ে চার বছরে শেষ হওয়ার কথা ছিল। তবে কাজ শেষ না হওয়ায় দুই দফায় মেয়াদ বাড়িয়ে এ বছরের জুন পর্যন্ত করা হয়। অথচ প্রকল্প সূত্রে জানা যায়, মার্চ পর্যন্ত সেই কাজের অগ্রগতি কেবল ১৬ শতাংশ আর ব্যয় হয়েছে বরাদ্দের ১৯ শতাংশ অর্থ। উপজেলা পর্যায়ে ১৩৭ স্কুলের মধ্যে কাজ শেষ হয়েছে মাত্র দুটির। জেলা পর্যায়ে ১৭২টি স্কুলের ভবন ছয়তলা নাকি ১০ তলা হবে, সাড়ে ছয় বছরে তা চূড়ান্ত না হওয়ায় কাজই শুরু করা যায়নি। আর দীর্ঘ সময় পর নির্মাণসামগ্রীর দাম বাড়ায় নতুন করে ভবন নির্মাণে রাষ্ট্রীয় সম্পদ অপচয় হওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে। অর্থ অপচয়ের পাশাপাশি প্রকল্পের দীর্ঘসূত্রতায় শিক্ষার্থীদের অনেক ক্ষতি হচ্ছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
প্রকল্পটির নথি ঘেঁটে দেখা যায়, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) বাস্তবায়ন করা প্রকল্পটিতে কোনো ধরনের সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়নি। তাই জমি অধিগ্রহণের জটিলতা না থাকলেও প্রকল্প বাস্তবায়নে লেজেগোবরে অবস্থা তৈরি হয়েছে। প্রকল্প বাস্তবায়নের শুরুর দিকেই জেলা পর্যায়ে ছয়তলার বদলে ১০ তলা ভবন নির্মাণের সিদ্ধান্ত হয়। তবে সেটি চূড়ান্ত হয়ে সংশোধনী আকারে প্রকল্পে সন্নিবেশিত হয়নি। এদিকে ১২৫টি স্কুলের বিদ্যমান ভবন ওপরের দিকে সম্প্রসারণের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হলেও প্রকৃতপক্ষে ১০২টিতে কাজের সুযোগ রয়েছে। বাকি ২৩টি স্কুলে ঊর্ধ্বমুখী সম্প্রসারণের কোনো ভবনই নেই। উপজেলা পর্যায়েও ১৪৮টি স্কুলে কাজের কথা ছিল। কিন্তু পাঁচটিতে কাজই শুরু হয়নি। ১৩৭টিতে কাজ চলমান থাকলেও ২৬টিতে কাজ হয়েছে ৪০ শতাংশের কম। আর ২৪টি হোস্টেল নির্মাণের কথা থাকলেও ১৮টিতে কাজ শুরুর প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। সব ধরনের অবকাঠামো উন্নয়নের গড় অগ্রগতি মাত্র ৩৫ শতাংশ।
সম্প্রতি প্রকল্পটির সার্বিক বিষয়ে সরকারের প্রকল্প মনিটরিংয়ের একমাত্র প্রতিষ্ঠান আইএমইডি একটি মূল্যায়ন প্রতিবেদন প্রস্তুত করেছে। সাড়ে চার বছরের প্রকল্পে সাত বছর সময় অতিবাহিত হলেও বেশি অগ্রগতি না হওয়াকে অন্যতম ঝুঁকি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে প্রতিবেদনে। বলা হয়েছে, নির্মাণ ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় প্রকল্প ব্যয় বৃদ্ধি এড়ানো যাবে না, এটাও একটি বড় ঝুঁকি। সম্ভাব্যতা যাচাই না করা এবং প্রকল্প চলমান অবস্থায় ছয়তলা নাকি ১০ তলা হবে, এমন সিদ্ধান্তহীনতাকে অন্যতম দুর্বলতা বলছে সংস্থাটি।
প্রতিবেদনের সমীক্ষায় দেখা যায়, ৪৭ শতাংশ ক্ষেত্রে নির্মাণকাজ তদারকির জন্য কোনো কমিটি করা হয়নি। কক্সবাজারের চকরিয়া সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের গেটে যেকোনো সময় দুর্ঘটনার শঙ্কা প্রকাশ করা হয় প্রতিবেদনে। রুমা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে কাজ চলমান থাকায় শিক্ষার্থীরা পরিত্যক্ত ভবনে ক্লাস করছে। এখানে কভিডের পর থেকে কাজ বন্ধ রয়েছে।
প্রকল্পের বিষয়ে আইএমইডির সংশ্লিষ্ট সেক্টরের মহাপরিচালক মু. শুকুর আলী বলেন, ‘মহানগর এলাকায় শিক্ষার্থী বেশি, তাই ছয়তলার বদলে ১০ তলা ভবন করার সিদ্ধান্ত নেয় মাউশি। তবে কোথায় ভবন লাগবে তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করলেও ডিপিপি সংশোধন করা হয়নি।’ জায়গা না থাকলেও ভবন সম্প্রসারণের তালিকা তৈরির বিষয়ে তিনি বলেন, ‘কিছু ক্ষেত্রে স্থানীয় এমপিরা তালিকা দিয়েছেন। আর অধিদপ্তরের তালিকার সঙ্গে এটার একটি গ্যাপ ছিল। ফিজিবিলিটি স্টাডি না হওয়ায় আগে থেকে কিছু কিছু সমস্যা চিহ্নিত করা যায়নি। তবে এখন থেকে স্টাডি করায় গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।’
প্রকল্পের অদক্ষতা, অব্যবস্থাপনা ও পরিচালনাগত দুর্বলতায় শিক্ষা ব্যবস্থায় অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব এডুকেশনাল ডেভেলপমেন্টের ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. মনজুর আহমেদ। তিনি বলেন, ‘এসব বন্ধের কোনো উদ্যোগ না নেয়ায় শিক্ষার্থীদের বিরাট ক্ষতি হচ্ছে।’
সর্বশেষ চলতি জুলাই পর্যন্ত ১০ তলা ভবন নির্মাণের বিষয়ে সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়নি বলে জানিয়েছেন প্রকল্প পরিচালক প্রফেসর মো. নাসির উদ্দিন। তিনি বলেন, ‘২০১৯ খ্রিষ্টাব্দে প্রকল্পের স্টিয়ারিং কমিটির বৈঠকে ১০ তলা ভবন করার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। কিন্তু প্রকল্পটির কাজ শুরু হতেই দেড় বছরের মতো সময় চলে যায়। আরো ছয় মাস চলে যায় প্রকল্প পরিচালক নিয়োগ দিতে। করোনাকালে আবার কাজ বন্ধ ছিল।’
এদিকে গত বছরের ৯ মার্চ প্রি-একনেক বৈঠকে পরিকল্পনা কমিশন ১০ তলা ভবনের যৌক্তিকতা জানতে চেয়েছে। গত ৩০ মার্চ বিষয়গুলো কমিশনকে জানানো হয়েছে। এখন প্রকল্পটি সময় বৃদ্ধির জন্য একনেক সভায় উত্থাপনের জন্য অপেক্ষমাণ। নতুন করে ২০২৬ খ্রিষ্টাব্দের ডিসেম্বর পর্যন্ত মেয়াদ বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। ফলে সাড়ে চার বছরের প্রকল্পের মেয়াদ গিয়ে ঠেকবে নয় বছরে। এতে প্রকল্প ব্যয় ৩৬ শতাংশ বা ২৪৩ কোটি টাকা বাড়ছে।
সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হতে এত সময় লাগার বিষয়ে মাউশির পরিকল্পনা ও উন্নয়ন উইংয়ের উপপরিচালক মুহ. খালেকুজ্জামান বলেন, ‘পরিকল্পনা কমিশনে প্রকল্প প্রক্রিয়াকরণ হতে একটু দেরি হয়। আর প্রকল্প তৈরি করে দেয়ার পর এটা পিডির দায়িত্ব। সংশোধিত প্রকল্প প্রস্তাবে মাত্র ১৮টি ভবন ১০ তলা করার সিদ্ধান্ত বর্তমানে কমিশনে পাঠানো হয়েছে। বাকি ভবনগুলো ছয়তলাই হবে।’