ছাত্র-জনতার সরকার পতনের আন্দোলন ও গণ-অভ্যুত্থানের পর বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি সিলেটের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতেও অস্থিরতা বিরাজ করছে। প্রায় প্রতিদিনই সিলেটের কোনো না কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা ভিসি, অধ্যক্ষ, প্রধান শিক্ষক থেকে শুরু করে সাধারণ শিক্ষকদেরও অপসারণ দাবি তুলে আন্দোলন করছেন।
শুধুমাত্র প্রাথমিক বাদে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ, উচ্চবিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করছেন। আন্দোলনের মুখে সিলেটের বেশ কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভিসি, অধ্যক্ষ, প্রধান শিক্ষক এরই মধ্যে পদত্যাগ করেছেন। অনেক প্রতিষ্ঠানে দাবি আদায়ের লক্ষ্যে শিক্ষার্থীরা আন্দোলন চলমান রেখেছেন।
এদিকে প্রতিষ্ঠান প্রধানদের অপসারণের পাশাপাশি নিরাপদে হলে থাকার জন্যও বিক্ষোভ করছেন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরা। কারণ বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন শেষ হওয়ার পর থেকে সিলেটের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে মোটরসাইকেলে মহড়া এবং শিক্ষার্থীদের হল ছাড়ার নির্দেশ দেয়া হচ্ছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পাশাপাশি স্থানীয়দের নাম ভাঙিয়ে এ আতঙ্ক ছড়ানো হচ্ছে।
সর্বশেষ গতকাল সোমবার বেলা ২টায় শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে ঢুকে ক্যাম্পাস পার্শ্ববর্তী এলাকাবাসী শাহপরাণ হলের সামনে অবস্থান নেন। এ সময় তারা দাবি করেন, শাহপরাণ হলে ছাত্রলীগের ছেলেরা থাকত। তাই এই হলের সবাইকে বেরিয়ে যেতে হবে। শিক্ষার্থীদের সন্ধ্যা ৭টার মধ্যে হল ছাড়ার নির্দেশ দেন এলাকাবাসী। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো প্রশাসনিক কাঠামো না থাকায় কোনো কর্তৃপক্ষও এই সমস্যার সমাধান করতে আসেনি।
এর আগে গত রবিবার সকাল সাড়ে ১০টা থেকে সিলেটের ঐতিহ্যবাহী ব্লুবার্ড স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ হুসনে আরা বেগমের পদত্যাগের দাবিতে বিক্ষোভ শুরু করেন শিক্ষার্থীরা। তারা অধ্যক্ষকে রুমের মধ্যে তালাবন্ধ করে রাখেন। শিক্ষার্থীদের ক্ষোভের মুখে দুপুর ১২টার দিকে অধ্যক্ষ হুসনে আরা বেগম পদত্যাগপত্রে স্বাক্ষর করেন।
ব্লুবার্ড স্কুল অ্যান্ড কলেজের আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা জানান, অধ্যক্ষ হুসনে আরা বেগম ও শিক্ষক দীপক চৌধুরী বুলবুল আওয়ামী লীগপন্থি। দীর্ঘদিন ধরে তারা নানা অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গে জড়িয়ে আছেন। দেশের পরিস্থিতি পরিবর্তন হওয়ায় তারা অধ্যক্ষের পদত্যাগের দাবিতে কয়েক দিন ধরে আন্দোলন করে আসছিলেন। কিন্তু অধ্যক্ষ তাতে কর্ণপাত করছিলেন না। তাই বাধ্য হয়ে তারা কঠোর হয়েছেন।
একই দিন সিলেট নগরীর কিশোরী মোহন বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক গৌরা ঘোষের পদত্যাগের দাবিতে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ সমাবেশ করেন শিক্ষার্থীরা। তারা প্রধান শিক্ষকের অফিস কক্ষ ঘেরাও করে বিক্ষোভ করেন। বিক্ষোভকারী ছাত্রীরা জানান, প্রধান শিক্ষক গৌরা ঘোষ বিভিন্ন সময় ছাত্রীদের সঙ্গে অশালীন আচরণ করতেন।
তার অশালীন আচরণে এক ছাত্রীকে অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছিল। পরে এলাকাবাসী সালিশ করে তাকে জরিমানা করেছিলেন। কিন্তু তিনি ব্যক্তিগতভাবে এই জরিমানার টাকা না দিয়ে স্কুলের তহবিল থেকে পরিশোধ করেন। এ ছাড়া প্রধান শিক্ষক নিয়মবহির্ভূতভাবে ম্যানেজিং কমিটির নির্বাচন দিয়ে তার অনুগত সভাপতি নির্বাচিত করেন। পরে সভাপতির স্বাক্ষর নিয়ে ভাউচার বাণিজ্য শুরু করেন। এভাবে প্রধান শিক্ষক বিদ্যালয়টির লাখ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেন।
অন্যদিকে রবিবার সিলেটের গোলাপগঞ্জ উপজেলার ঢাকা দক্ষিণ সরকারি কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ এরশাদ আলী শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভের মুখে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। ওই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা জানান, গত ১ আগস্ট ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ এরশাদ আলী কলেজে ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের দোসরদের নিয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে সভা করেন।
তিনি ফেসবুকে আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীদের সন্ত্রাসী আখ্যা দিয়েও পোস্ট করেন। এসব কারণে তারা এরশাদ আলীর পদত্যাগ দাবি করেন। আন্দোলনের মুখে তিনি গত রবিবার পদত্যাগপত্রে স্বাক্ষর করে কলেজ ত্যাগ করেন। এরশাদ আলী ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ অক্টোবর ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসেবে যোগদান করেছিলেন।
তার পদত্যাগের বিষয়টি নিশ্চিত করে কলেজের সাবেক ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ আব্দুর রহীম বলেন, ‘আমরা সব শিক্ষক অধ্যক্ষকে সভা করতে নিষেধ করেছিলাম। কিন্তু তিনি আমাদের কারও কথা না শুনে উনার খেয়াল খুশিমতো আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে এই সভা করেছিলেন।’
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সিলেটের সভাপতি ফারুক মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগে শিক্ষার্থীরা শিক্ষকদের সঙ্গে যা করছেন সেটা কোনোভাবেই মানা যায় না। একজন শিক্ষক যদি দুর্নীতিগ্রস্ত হন তাহলে তার বিরুদ্ধে নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে শিক্ষা সংশ্লিষ্ট দপ্তরে অভিযোগ করা হোক।
অভিযুক্তের অভিযোগ প্রমাণ হলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ওই শিক্ষকের ব্যাপারে পদক্ষেপ নিবে। শিক্ষার্থীদের এ ধরনের কর্মকাণ্ডের কারণে তাদের ভালো কাজগুলো বিলীন হয়ে যাচ্ছে। তা ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও কোনো বহিরাগতদের হস্তক্ষেপের এখতিয়ার নেই। এলাকাবাসী পরিচয়ে শাবিপ্রবিতে শিক্ষার্থীদের হল ছাড়ার যে নির্দেশ দেয়া হয়েছে সেটা নিয়ম বহির্ভূত কাজ। এসবের কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে চেইন অব কমান্ড নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।’
তিনি বলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে এখন কোনো বিশৃঙ্খলা বা হামলা হলে পুলিশও আসবে না। কারণ পুলিশও এখন নিরাপত্তা সংকটে আছে। আলটিমেটলি এটা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার ওপর চরম প্রভাব ফেলবে। শিক্ষার্থীদের এই নিয়ম বহির্ভূত কাজের প্রভাব তাদের শিক্ষাজীবন ক্ষতিগ্রস্ত করবে। তাই খুব দ্রুত দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো