মেহেরপুরের গাংনী উপজেলার প্রায় সব মাধ্যমিক স্কুল বন্ধ ছিল। ছাত্ররা বাড়ি ফিরে যাচ্ছে। প্রশ্ন করলে তারা বলল, স্যাররা শিক্ষক সমিতির জমি থেকে দখলদারকে উচ্ছেদ করতে গেছেন। তাই ক্লাস হলো না। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, প্রায় সব স্কুলই বন্ধ।
গতকাল মঙ্গলবার এভাবেই স্কুল ফাঁকি দিয়ে ৭০০-৮০০ শিক্ষক মেহেরপুর-কুষ্টিয়া সড়কের বাঁশবাড়িয়া গ্রামে জড়ো হয়ে সেখানে গাংনী বেসরকারি মাধ্যমিক স্কুল শিক্ষক সমিতির জমির ওপর দীর্ঘদিন ধরে বসবাসরত একটি পরিবারকে উচ্ছেদ করতে যান। পূর্ব ঘোষণা দিয়ে বেলা ১১টার দিকে শিক্ষকরা ওই বাড়ির ওপর চড়াও হন। তখন পরিবারের লোকজন স্থানীয়দের সহায়তায় শিক্ষকদের ওপর চড়াও হলে উভয়পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ বাধলে ১৫ শিক্ষকসহ ৫০ জন আহত হন। যদিও এ জমি নিয়ে পাল্টাপাল্টি মামলা চলমান।
সংঘর্ষে গাংনী মডেল মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও গাংনী উপজেলা বেসরকারি মাধ্যমিক স্কুল শিক্ষক সমিতির সভাপতি আফজাল হোসেনসহ একই স্কুলের রহিদুল ইসলাম, হিজলবাড়িয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক আলমগীর হোসেন মিঠু, মিকুশিশ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক বদিউজ্জামান ও শাহিনুর রহমান, আরবিজিএম মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ইমরান হোসেনসহ ১৫ শিক্ষক আহত হয়েছেন। অন্যপক্ষের আহতরা হলেন বাঁশবাড়িয়া গ্রামের ইয়াদ আলীর ছেলে শহিদুল ইসলাম, হাবিবুর রহমানের ছেলে মোজাম্মেল হক, ছাবদার আলীর মেয়ে সুমাইয়া খাতুন, হাবিবুর রহমানের ছেলে নিজাম উদ্দীন, হাবিবা খাতুন, সোহেলী খাতুন, মাছুরা খাতুনসহ ৩৫ জন। গুরুতর জখম হওয়ায় আহতদের মধ্যে বেশ কয়েকজনকে কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।
প্রত্যক্ষদর্শী বাঁশবাড়িয়া গ্রামের আকরাম হোসেন জানান, বেলা ১১টার দিকে শিক্ষকরা লাঠিসোটা নিয়ে জমির দখলে বাড়িঘরের ওপর হামলা চালালে উভয়পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ বাধে। এ সময় পুলিশকে খবর দেওয়া সত্ত্বেও পুলিশ তাৎক্ষণিক ঘটনাস্থলে যায়নি। শিক্ষকরা ঘরবাড়ি ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়ার পর পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে উভয়পক্ষকে নিবৃত্ত করে পরিস্থিতি শান্ত করে।
সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, বাঁশবাড়িয়া ২৭২৭ খতিয়ানের ৪৭৮ নং দাগের ৪২ শতক জমির মধ্যে ১৫ শতক জমির ওপর টিনের বেড়া দিয়ে নির্মিত দুটি কক্ষে বসবাসরতরা প্রাণভয়ে পালিয়ে গেছে। ঘর দুটি ভাঙচুর করে নিশ্চিহ্ন করা হয়েছে। আঘাতে ঝাঁজরা হয়ে যাওয়া টিনগুলো অন্যত্র পড়ে আছে। ভেঙে ধ্বংস করা বাড়ির হাঁড়িপাতিল, আসবাবপত্রসহ ভাতের চাল পড়ে আছে মাটিতে। গাংনী উপজেলা চেয়ারম্যান আবদুল খালেক, গাংনী মেয়র আহম্মদ আলী এবং গাংনী থানার ওসি আবদুর রাজ্জাক ঘটনাস্থলে পৌঁছে তখন শিক্ষক নেতাদের শান্ত করার চেষ্টা করছেন। অন্যদিকে-শিক্ষকরা দখলদার হাবিবুর রহমানসহ শিক্ষকদের ওপর হামলাকারীদের দ্রুত গ্রেপ্তারের দাবিতে মেহেরপুর-কুষ্টিয়া সড়কে অবস্থান নিয়ে আছেন। পরে সবার আশ্বাসে শিক্ষকরা দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে অবস্থান ত্যাগ করেন।
জ্যাতি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির ছাত্র সাজ্জাদ হোসেন, হিজলবাড়িয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির ছাত্র শফিকুল ইসলাম জানায়, স্কুলে ক্লাস হয়নি। সরকারি ছুটি নয়, তারপরও স্কুল বন্ধ ছিল। ছাত্ররা বলল, স্যাররা শিক্ষক সমিতির সম্পত্তি দখল নিতে গেছেন। তাই প্রায় সব বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে মঙ্গলবার ক্লাস হয়নি।
এ ব্যাপারে জানতে মেহেরপুর জেলা শিক্ষা অফিসার আব্বাস উদ্দিনকে মোবাইল ফোনে একাধিকবার যোগাযোগের জন্য ফোন করা হয়। গাংনী উপজেলা শিক্ষা অফিসার পদ শূন্য থাকায় তিনি দায়িত্বে আছেন। কিন্তু শিক্ষা অফিসার আব্বাস উদ্দিনকে না পাওয়ায় স্কুল ফাঁকি দিয়ে শিক্ষকদের জমি দখল এবং ১৫ শিক্ষক আহত সম্পর্কে তার বক্তব্য পাওয়া সম্ভব হয়নি।
জমির মালিকানা দাবি করে হাবিবুর রহমানের ছেলে কুতুবউদ্দিন জানান, গাংনী পৌর এলাকার বাঁশবাড়িয়া-৪৭ মৌজার ২৭২৭ খতিয়ানের ৪৭৮ দাগের ১৫ দশমিক ৭৫ শতক জমির মধ্যে তার বাবা ১০ দশমিক ৫০ জমির ক্রয় করেন এবং পৈতৃক সূত্রে ৫ দশমিক ২৫ শতক জমি পান। খাজনা খারিজ দলিল মূলে জমির স্বত্বদখলীয় তারা। ১৯৯৬ সালে জমিটি বিক্রির জন্য জনৈক ইব্রাহিম ম-লের কাছে বায়না করলেও জমিটি বিক্রি করেননি। অথচ সেই বায়নানামা ধরে ইব্রাহিম ম-ল ভুয়া দলিল করে শিক্ষক কর্মচারী কল্যাণ সমিতির কাছে ১৯৯৭ সালে জমিটি বিক্রি করেন। সেই দলিলের সূত্র ধরে শিক্ষক কর্মচারী কল্যাণ সমিতি জমিটি নিজেদের বলে দাবি করছে। এ নিয়ে আদালতে পাল্টাপাল্টি মামলা আছে। অথচ শিক্ষকরা মামলার রায়ের অপেক্ষা না করে পূর্বঘোষণা দিয়ে জোরপূর্বক জমির দখল নিতে তাদের উচ্ছেদ করতে আসেন। এমন ঘটনা আশঙ্কায় তারা পুলিশকে আগে থেকেই বিষয়টি লিখিতভাবে জানিয়েছিলেন।
অন্যদিকে শিক্ষক সমিতির নেতা হিজলবাড়িয়া মাধ্যমিক স্কুলের প্রধান শিক্ষক, গাংনী উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক, গাংনী উপজেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মুনতাছির জামান মৃদুলের বাবা মনিরুজ্জামান জানান, ৩৫ বছরের সম্পত্তি ওটা। সেখানে সীমানা প্রাচীর আছে। পাকা স্থাপনা আছে। এর মধ্যে টিনের ঘর বানিয়ে হাবিবুর জমির দখল নিয়েছে। সেই দখল উচ্ছেদ করে জমির দখলস্বত্ব নিতে ৭০০-৮০০ শিক্ষক জড়ো হয়েছিলেন সেখানে। তখন হাবিবুরের লোকজনরা শিক্ষকদের ওপর হামলা চালায়। ধারালো অস্ত্রের আঘাতে ১৫ শিক্ষক জখম হয়েছেন। তিনি জানান, হামলাকারীদের বিরুদ্ধে গাংনী থানায় মামলা করা হবে।
গাংনী থানার ওসি আবদুর রাজ্জাক জানান, সংঘর্ষের সংবাদ পেয়ে তিনিসহ পুলিশ দল ঘটনাস্থলে পৌঁছে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন। জমিজমার বিষয়টি আদালত ফয়সালা করবে। কেউ আইন হাতে তুলে নেবেন না। সংঘর্ষের ঘটনায় অভিযোগ পেলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
গাংনী উপজেলা চেয়ারম্যান আবদুল খালেক বলেন, ঘটনাস্থলে পৌঁছে শিক্ষকদের শান্ত করা হয়। শিক্ষকরা মানুষ গড়ার কারিগর। তারা আইন হাতে তুলে নেবে এটা কাম্য নয়। উভয়পক্ষকে জমির বৈধ সব কাগজ নিয়ে উপজেলায় এলে আমরা জমির বৈধ মালিক চিহ্নিত করে এর স্থায়ী সমাধান দেব।