কুড়িগ্রামের রাজারহাট উপজেলার বিদ্যানন্দ নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে উপস্থিতির শিক্ষার্থীর চেয়ে উপবৃত্তি পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যাই বেশি। উপস্থিত ১৬ জন শিক্ষার্থী নিয়ে চলছে বার্ষিক পরীক্ষা। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটিতে থেকে ১৮ জন শিক্ষার্থী উপবৃত্তি পাচ্ছেন। যদিও খাতা-কলমে স্কুলটিতে ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত ১১২ জন শিক্ষার্থী ভর্তি দেখানো হয়েছে। প্রতিষ্ঠানে এমপিওভুক্ত ৬ জন শিক্ষক ও ২ জন কর্মচারী কর্মরত আছেন।
গত বৃহস্পতিবার সকালে সরেজমিনে দেখা যায়, বিদ্যানন্দ নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে কয়েকজন শিক্ষক রোদ পোহাচ্ছেন আর বিদ্যালয়ে সপ্তম শ্রেণির সাতজন শিক্ষার্থী ইংরেজি দ্বিতীয় পত্র আর অষ্টম শ্রেণির ১১ জন শিক্ষার্থী শারীরিক শিক্ষা বিষয়ে পরীক্ষা দিচ্ছেন। প্রতিষ্ঠানে ষষ্ঠ শ্রেণির কোনো পরীক্ষার্থী নেই। পরীক্ষার কক্ষেও নেই কোনো শিক্ষক।
তবে, স্কুলের হাজিরা খাতা অনুযায়ী ষষ্ঠ শ্রেণিতে ৩২ জন, সপ্তম শ্রেণিতে ৪০ জন এবং ৮ম শ্রেণিতেও ৪০ জন শিক্ষার্থী রয়েছে। এদের মধ্যে ১৮ জন শিক্ষার্থী উপবৃত্তি পাচ্ছেন। আর বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকসহ ৬ জন শিক্ষক, অফিস সহকারী এবং পিয়নসহ ৮ জন স্টাফ রয়েছেন।
অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী নাইম দৈনিক শিক্ষাডটকমকে বলেন, ‘আমাদের শ্রেণিতে ১৫জন শিক্ষার্থী আছে। এরমধ্যে ঢাকায় কাজ করতে গিয়ে ৩ জন মারা গেছে। দুই জন ঢাকায় কাজ করছেন এবং একজন বাড়িতে আছেন। আর আমরা বার্ষিক পরীক্ষা দিচ্ছি ৬ জন ছেলে এবং ৩জন মেয়ে।’
আরেক ছাত্রী মিথিলা দৈনিক শিক্ষাডটকমকে বলেন, আমরা পরীক্ষা দিচ্ছি ৯ জন। করোনার পর কেউ কেউ ঢাকা গেছে, কেউ বাড়িতে আছে আবার অনেকেই অন্য স্কুলে ভর্তি হওয়ায় এখানে শিক্ষার্থী কম।
সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী সাদিয়া আক্তার সুমি দৈনিক শিক্ষাডটকমকে বলেন, আমরা সপ্তম শ্রেণিতে ইংরেজি দ্বিতীয় পত্রে পরীক্ষা দিচ্ছি মাত্র ৭ জন। এরমধ্যে ৫ জন ছেলে এবং ২ জন মেয়ে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, উপজেলার বিদ্যানন্দ ইউনিয়নের একমাত্র বিদ্যাপীঠ বিদ্যানন্দ নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়টি ১৯৯১ খ্রিষ্টাব্দে স্থাপিত হয়। ওই বছরেই বিদ্যালয়টি এমপিওভুক্ত হয়। কিন্তু নদী ভাঙনের কারণে ২০১৭ খ্রিষ্টাব্দে ওই ইউনিয়নের তৈয়বখাঁ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে স্থানান্তর করা হয়। সেখানে কিছু দিন পাঠদান কার্যক্রম পরিচালিত হয়। কিন্তু নতুন জায়গা না পাওয়ার অযুহাতে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক লোকনাথ বর্মনসহ কয়েকজন শিক্ষক রাতের আধারে বিদ্যালয়টি উপজেলার পার্শ্ববর্তী নাজিমখাঁ ইউনিয়নের তালতলা রঞ্জিতসর গ্রামে স্থানান্তর করেন। অন্য ইউনিয়নে বিদ্যালয়টি স্থানান্তর করায় বিদ্যানন্দ ইউনিয়নের চরসহ আশে পাশের শিক্ষার্থীদের শিক্ষা সুযোগ বন্ধ হয়ে যায়। অপর দিকে বর্তমান স্থানে থাকা বিদ্যানন্দ নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের তিন কিলোমিটারের মধ্যে কালিরহাট উচ্চ বিদ্যালয়,ডাংরারহাট উচ্চ বিদ্যালয়,নাজিমখাঁ উচ্চ বিদ্যালয় এবং বাছড়া আজিজিয়া আলিম মাদরাসা রয়েছে। ফলে বিদ্যালয়টি শিক্ষার্থী সংকটে ভুগছে। অন্যদিকে বিদ্যালয় স্থানান্তরিত হওয়ায় বিদ্যানন্দ ইউনিয়নের বিদ্যানন্দ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়,পশ্চিম চর বিদ্যানন্দ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়,চর তৈয়বখাঁ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়,রতিদেব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়,চর রতিদেব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ চর তৈয়বখাঁ ও হয়বতখাঁ এনজিও পরিচালিত দুটি প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ পাশের রংপুর জেলার পীরগাছা উপজেলার ছাওলা ইউনিয়নের মধুপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রায় দু’ শতাধিক ছাত্র-ছাত্রী মাধ্যমিক শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এসব বিদ্যালয়ের আশেপাশে ৬-৭ কিলোমিটারের মধ্যে কোন নিম্নমাধ্যমিক বা মাধ্যমিক বিদ্যালয় নেই।
রতিমারী গ্রামের বাসিন্দা নছর উদ্দিন দৈনিক শিক্ষাডটকমকে বলেন, ‘এলাকার সন্তানদের পড়াশোনার জন্য বিদ্যালয়ের জায়গায় দেবো। তবু চাই হামার ইউনিয়নের স্কুল হামার এটে থাকুক।’
তেয়বখাঁ গ্রামের বাসিন্দা আজাহার আলী দৈনিক শিক্ষাডটকমকে বলেন, ‘হামার চরের এলাকায় কোন স্কুল না থাকায় প্রাইমারি পাস দিয়ে মেয়েদের বাল্যবিয়ে দেন অভিভাবকরা। আর ছেলেরা চরের মধ্যে কামলা দেয়, ঢাকা যায়। এ এলাকার সন্তানদের শিক্ষার জন্য স্কুলটি আমাদের এখানে পুনরায় আনা হোক।’
কমলা রাণী দৈনিক শিক্ষাডটকমকে বলেন, বর্তমান হামার ইউনিয়নের স্কুলটি অন্য ইউনিয়নে থাকায় শিক্ষার্থীর চেয়ে শিক্ষকের সুযোগ সুবিধা বেশি হইছে। তারা বসে বসে সরকারের বেতন ভাতা তুলছে। অথচ আমাদের এখানে স্কুল না থাকায় বাচ্চাদের পাশের স্কুলগুলোতে ভর্তি করানো হচ্ছে। আমাদের চর ও গ্রামের সন্তানদের পড়ালেখা নিশ্চিত করতে সরকার দ্রুত স্কুলটি ফিরিয়ে দিক।
দশম শ্রেণীর ছাত্রী আলো মনি দৈনিক শিক্ষাডটকমকে জানান, নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয় না থাকায় আমিসহ এলাকার অনেকেই দূরের স্কুলে ভর্তি হয়ে পড়াশোনা করছি। নিম্ন মাধ্যমিক স্কুল না থাকায় অনেকেই পড়াশোনা বাদ দিয়েছে।
বিদ্যানন্দ নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সিনিয়র মৌলভী শিক্ষক মামুনুর রশীদ দৈনিক শিক্ষাডটকমকে বলেন, নদী ভাঙনের পর বিদ্যালয়টি এখানে স্থানান্তর করা হয়। শিক্ষার্থী কম হওয়ার বিষয়ে তিনি জানান বাল্যবিয়ের প্রভাব না পড়লেও করোনার পরে ছেলেরা কর্মমুখী হওয়ায় ঝরে পড়ার হার বেড়েছে।
তবে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক লোকনাথ বর্মন দৈনিক শিক্ষাডটকমের কাছে এ বিষয়ে মন্তব্য করতে চাননি। তিনি বলেন, আপনাদের কোনো তথ্য দেয়া হবে না।
বিদ্যানন্দ ইউপি চেয়ারম্যান তাইজুল ইসলাম দৈনিক শিক্ষাডটকমকে বলেন, এই ইউনিয়নে ১৯৯১ খ্রিষ্টাব্দে চর বিদ্যানন্দ এলাকায় বিদ্যানন্দ নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়টি ৯৯ শতক জায়গায় স্থাপিত হয়। পরে ২০১৭ খ্রিষ্টাব্দে বিদ্যালয়টি নদী ভাঙনের কারণে জায়গায় নির্ধারণ করার আগেই প্রধান শিক্ষকসহ কয়েকজন রাতারাতি বিদ্যালয়টি নাজিমখাঁ ইউনিয়নে স্থানান্তর করেন। এই বিষয়ে মিটিং করে লিখিত অভিযোগ দিয়ে এবং প্রশাসনের কাছে গিয়েও কোন লাভ হয়নি। বর্তমানে যেখানে স্কুল আছে সেখানে নামমাত্র ছাত্র-ছাত্রী দিয়ে চললেও আমার এলাকায় স্কুল না থাকায় শত-শত ছাত্রছাত্রী শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। অথচ নদীর ওপারে বেশ কিছু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে সেখানকার শিক্ষকরা নিয়মিত নদী পার হয়ে পাঠদান করাচ্ছেন। আর নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক তাদের সুবিধার জন্য বাঁচ্চাদের পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এতে করে সবার জন্য শিক্ষা নিশ্চিত করতে সরকারের লক্ষ্য অর্জনের চেয়ে শিক্ষকদের বেতন ভাতা দিয়ে টাকার অপচয় হচ্ছে।
জানতে চাইলে উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আশরাফ-উজ-জামান সরকার দৈনিক শিক্ষাডটকমকে বলেন, আমি পরিদর্শনে গিয়ে ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত ২০-২২জন শিক্ষার্থী পেয়েছি। এই বিষয়ে অনেক লেখালেখি হয়েছে। কিন্তু রাজনৈতিক কারণে সমস্যার সমাধান হয়নি।
জানতে চাইলে উপজেলা নির্বাহী অফিসার নূরে তাসনিম দৈনিক শিক্ষাডটকমকে বলেন,বিদ্যানন্দ নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়টি বিদ্যানন্দ ইউনিয়নে নিয়ে যাওয়ার জন্য আমরা চেষ্টা চালাচ্ছি।